X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে শিল্প হয়ে উঠলো জাহাজ ভাঙার কাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
১১ মার্চ ২০২২, ১০:৫৯আপডেট : ১১ মার্চ ২০২২, ১৩:০৯
গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ২৬২টি পুরনো জাহাজ আমদানি করা হয়েছে। এসব জাহাজের আমদানি খরচ ১২ হাজার ২০৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ফলে করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সীতাকুণ্ড এলাকার জাহাজ ভাঙা শিল্প। দেশের স্টিল রি-রোলিং মিলগুলোতেও বেড়েছে উৎপাদন। রডের চাহিদা বাড়ায় জাহাজ ভেঙে পাওয়া স্ক্র্যাপের (কাঁচামাল) চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে ব্যবসা আগের মতো চাঙা হবে বলে আশা  ব্যবসায়ীদের।

জাহাজ ভাঙা শিল্পের যাত্রা শুরু যেভাবে
১৯৬০ সালে গ্রিক জাহাজ ‘এমভি আলপাইন’ জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলে অকেজো হয়ে আটকে পড়েছিল। পাঁচ বছর জাহাজটি আটকে ছিল বঙ্গোপসাগরের তীরে। এরপর ‘চিটাগং স্টিল হাউজ’ জাহাজটি সাগর থেকে তুলে ভাঙার কাজ শুরু করে। তখন থেকে সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙার কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জাহাজ ‘আল আব্বাস’ বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এটি উদ্ধার করে ফৌজদারহাট সাগর তীরে আনা হয়। ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস লিমিটেড জাহাজটি কিনে নেয় এবং বাংলাদেশে বাণিজ্যিক শিপ ব্রেকিং চালু করে।

আশির দশকে জাহাজ ভাঙার কাজ বাড়তে থাকে। এই সময়ে এটি শিল্প হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা জাহাজ ভাঙার কাজে বিনিয়োগ শুরু করেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এটি লাভজনক শিল্প হিসেবে পরিচিত। পুরনো বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তারা এখন যুক্ত হচ্ছেন এই শিল্পে।

জাহাজের স্ক্র্যাপ থেকে রড তৈরি
দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে রডের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বছরে দেশে রডের চাহিদা ৫৮ লাখ টন। চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ রড তৈরির স্ক্র্যাপ (কাঁচামাল) সরবরাহ হয় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে। রডের প্রধান কাঁচামাল পুরনো জাহাজের স্ক্র্যাপ। পাশাপাশি বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করেও রড উৎপাদন করে বিভিন্ন স্টিল রি-রোলিং মিল। দেশে রি-রোলিং মিলের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি। এরমধ্যে বড় আকারের ৫০টি। বড় আকারের এসব মিলের মধ্যে আবার ৩০টি অটো স্টিল মিল। এসব মিলে রড তৈরি হয়। বাকি রি-রোলিং মিলগুলোর বেশিরভাগ ছোট ও মাঝারি।

পুরনো জাহাজ থেকে প্রতিবছর ৩০-৩৫ লাখ টন স্ক্র্যাপ পাওয়া যায়। ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে ইস্পাত শিল্প; বিশেষ করে স্টিল রি-রোলিং মিলে সরবরাহ হচ্ছে এসব স্ক্র্যাপ। ভাঙা জাহাজের বড় ক্রেতা চট্টগ্রামসহ দেশের ১৩০টির বেশি ছোট-বড় স্টিল রি-রোলিং মিল।

বেকারদের কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়
দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ছাড়াও দেশের বড় অঙ্কের রাজস্বের জোগান দিচ্ছে জাহাজ ভাঙা শিল্প। প্রতি বছর আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য করের মাধ্যমে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে সরকার। যা এককভাবে দেশের কোনও শিল্পের সর্বোচ্চ রাজস্ব। পাশাপাশি প্রতিদিন এখানে বেকারদের কর্মসংস্থান বাড়ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাঁচ লক্ষাধিক লোকজন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত খুব সহজে শ্রমিক পাওয়া যাওয়ার কারণে জাহাজ ভাঙা শিল্প বিকশিত হয়েছে। তবে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেন না মালিকপক্ষ। এমনকি জাহাজ ভাঙতে গিয়ে কোনও শ্রমিক অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচও মেলে না।

আব্দুস সাত্তার নামে এক শ্রমিক জানিয়েছেন, এখানে যেসব শ্রমিক জাহাজ ভাঙার কাজ করেন তাদের অধিকাংশই আহত হন। কারও কারও হাত-পায়ের আঙুল কেটে যায়। সেই সঙ্গে চোখ-কানের সমস্যা হয়। দীর্ঘমেয়াদে কেউ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে কোনও ধরনের চিকিৎসা খরচ দেন না মালিকপক্ষ।

শিপ ব্রেকার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, এখানে ১৬০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আছে। ৫৮টি ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙা হয়। করোনার ধাক্কা সামলে এখন জাহাজ ভাঙা শিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ব্যবসাও আবার আগের মতো চাঙা হয়েছে। অগ্রিম আয়কর আটকে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে প্রচুর অর্থ আটকে ছিল। এখন অগ্রিম আয়কর কিছু কিছু ছাড় করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে আমাদের।

বিএসবিআরএ’র সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনার ধাক্কা কেটে গেছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। উদ্যোক্তারা চান ব্যবসা আরও চাঙা হোক। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড দেশের ইস্পাত চাহিদার ৭০ শতাংশই পূরণ করছে। আমরা সরকারকে প্রতি বছর প্রায় ১২শ কোটি টাকা রাজস্ব দিচ্ছি। কিন্তু বড় রাজস্বের জোগানদার হয়েও তেমন সহযোগিতা পাই না।

শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ সরবরাহ কেমন এই প্রশ্নের জবাবে অটো বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে বছরে অন্তত ৫৮ লাখ মেট্রিক টন রডের চাহিদা রয়েছে। শিপইয়ার্ডের স্ক্র্যাপ থেকে বিলেট তৈরি করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মিলগুলোতে তৈরি করা হয় রড। শিপইয়ার্ডের স্ক্র্যাপ চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত না হওয়ায় বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ এনে বিলেট তৈরি করতে হয়। এরপর তা রি-রোলিং মিলগুলোতে গলিয়ে তৈরি করা হয় রড। দেশে ভালো মানের অটো স্টিল রি-রোলিং মিল আছে ৩০টি। এসব মিল থেকে উৎপাদিত রড দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। আবার অটো স্টিল মিলগুলোর উন্নতমানের বিলেট তৈরির সক্ষমতাও আছে। যা বিদেশে রফতানি করা হয়।

‘লাল’ কমলা শ্রেণি বিতর্ক
ভারতে জাহাজ ভাঙা শিল্প ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত হলেও বাংলাদেশে কমলা শ্রেণিভুক্ত। অভিযোগ রয়েছে চাপের মুখে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে লাল থেকে কমলা শ্রেণিভুক্ত করেছে পরিবেশ অধিদফতর।

গত ১০ অক্টোবর পরিবেশ অধিদফতরের এক সভায় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রেণি কমলা (খ)-তে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিনের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শ্রেণি পরিবর্তনের আগে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে হয়। শ্রেণি পরিবর্তনের ফলে এ ধরনের সমীক্ষার প্রয়োজন হবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি জাহাজ পুরনো হওয়া মানে অনেক ক্ষেত্রে বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হওয়া। জাহাজে অ্যাসবেসটস, ভারী ধাতু, খনিজ তেল, জাহাজের তলা ও ব্যালাস্ট ওয়াটার, পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটি হাইড্রোকার্বন, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, পোড়া তেল ও অর্গানোটিনসহ বেশ কিছু বিপজ্জনক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে তা পরিবেশ এবং মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে লাল শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে বিএসবিআরএ’র সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজ ভাঙা শিল্প অনেক আগে থেকেই কমলা শ্রেণিভুক্ত ছিল। একটি উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান সহায়ক কোনও শিল্প রেড তথা লাল শ্রেণিভুক্ত থাকতে পারে না। কিছু সময়ের জন্য লাল শ্রেণিভুক্ত ছিল। বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বুঝতে পেরে কমলা শ্রেণিভুক্ত করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাজ ভাঙার কারণে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেসব জাহাজ ভাঙতে নিয়ে আসা হয়, তার মধ্যে বিষাক্ত বর্জ্য থাকে। যা মানুষ এবং পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এজন্য পরিত্যক্ত জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশে আনার আগেই রফতানিকারক দেশকে জানাতে হবে যে সেটি বর্জ্যমুক্ত কিনা। এরপর বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতর ছাড়পত্র দিলেই সেটিকে ভাঙার জন্য নেওয়া যাবে। এই নিয়ম মেনেই জাহাজ ভাঙছেন আমদানিকারকরা।


/এএম/টিটি/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধজাহাজ
দুবাই থেকে বিমানে দেশে ফিরবেন ‘এমভি আবদুল্লাহ’র দুই নাবিক
বহুমাত্রিক চাপের কারণে নাবিকদের ছাড়তে বাধ্য হয় জলদস্যুরা: নৌ প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল