X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজা মৃত্যুদণ্ড, তবু কেন বাড়ছে গণপিটুনি?

আবদুল্লাহ আল মারুফ, কুমিল্লা
২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:০০আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:০০

কুমিল্লায় সাত দিনের ব্যবধানে গণপিটুনিতে চার জন নিহত হয়েছেন। কোথাও চুরির অভিযোগে আবার কোথাও চুরির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের। জেলার তিনটি ঘটনায় চার জন নিহত হলেও গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন একজন। 

সবশেষ গত মঙ্গলবার রাতে সিলেট নগরের মিরাবাজারের আগপাড়া এলাকায় ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার শুরু করে স্থানীয়রা। চিৎকার–চেঁচেমেচির শব্দ পেয়ে আশপাশের বাসিন্দারা এগিয়ে এসে দেখেন, প্রবাসী দুদু মিয়ার বাড়ি থেকে চার যুবক বের হচ্ছেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন ওই যুবকদের আটক করে ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনি দেন। পরে জানা যায়, আহত একজন শিল্পাঞ্চল পুলিশের সদস্য।

এর আগে গত রবিবার সকালে সিলেট নগরের লালবাজার এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে এক যুবককে (৩৮) গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। তবে তার কাছে ছিনতাইয়ের টাকা পাওয়া যায়নি। আহত যুবককে চিকিৎসার জন্য এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গত বছরের ৩ মার্চ মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বনপারিল গ্রামে ডাকাতির অভিযোগে গণপিটুনিতে দুই যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় আরও এক যুবক গুরুতর আহত হন। নপারিল গ্রামে হাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ইউসুফ আলীর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছিল।

অবশ্য এর আগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ সারা দেশে ছেলেধরা ও চুরির সন্দেহে গণপিটুনিতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। কাউকে সন্দেহ হলেই গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। এ ধরনের ঘটনায় যেকোনো নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মানুষ যাতে আইন হাতে তুলে না নেয়, সেজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করা উচিত। গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিও মৃত্যুদণ্ডের সাজার মুখোমুখি হতে পারেন সেটিও জানানো উচিত। অনেকে না জেনে গণপিটুনিতে অংশ নিচ্ছেন বলেও দাবি তাদের।

বাংলা ট্রিবিউনের কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ১২ জানুয়ারি মুরাদনগর উপজেলার দারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রামে শ্বশুরের ঘরে ভাত খেতে বসা থেকে তুলে নিয়ে জামাই নুরু মিয়া ও তার বন্ধু ইসমাইল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় একটি পক্ষের দাবি, তারা ডাকাত। আরেকটি পক্ষের দাবি, তারা ডাকাত নয়। দুই পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, গণপিটুনিতে তাদের হত্যার রাতে উপজেলার কোথাও ডাকাতি কিংবা চুরির ঘটনা ঘটেনি। তাদের কাছে কোনও অস্ত্র পাওয়া যায়নি। ডাকাতি করতে কোথায় গেছেন, তাও কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। থানায় খবর নিয়ে জানা গেছে, তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনও থানায় কোনও অভিযোগ নেই।

একই ঘটনায় আহত হন শাহাজাহান মিয়া। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। শাহাজাহান মিয়া বলেন, ‘আমরা ডাকাতি করতে যাইনি। নুরু মিয়ার সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। খেতে বসেছিলাম, সেখান থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় দুজনকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই আমি।’

পুলিশ জানায়, শাহাজাহানের বিরুদ্ধে মুরাদনগর থানায় কোনও মামলা নেই। ডাকাতির ঘটনায় তার কোনও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। 

গত ১২ জানুয়ারি চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে আশিকুর রহমান (১৯) নিহত হন। তিনি চান্দিনার মহারং এলাকার বাবুর্চি মিজানুর রহমানের ছেলে।

পুলিশ জানায়, আশিকুরের বিরুদ্ধে থানায় কোনও অভিযোগ ছিল না। তাকে হত্যার দুই দিন পর পৌর এলাকার মহারং জামে মসজিদের সামনে মানববন্ধন করে হত্যাকারীদের বিচার চান এলাকাবাসী।

আশিকুরের মা আয়েশা বেগম বলেন, ‘আমার নিরপরাধ ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

দেবিদ্বার থানার ওসি কমল কৃষ্ণ ধর বলেন, ‘আশিকুরের বাড়ি চান্দিনা হলেও ঘটনাস্থল ছিল দেবিদ্বার। আশিকুরের বাবা পাঁচ জনকে আসামি করে দেবিদ্বার থানায় মামলা করেছেন। এ ঘটনার তদন্ত চলছে। অপরাধীদের গ্রেফতারে তৎপরতা অব্যাহত আছে।’

এ ঘটনার আগে ৭ জানুয়ারি চান্দিনা উপজেলায় চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত মোজাম্মেল হোসেন সুমন বাড়েরা ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে। এ ঘটনায় ৮ জানুয়ারি তার মা অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। 
 
চান্দিনা থানা পুলিশ জানায়, মোজাম্মেল হোসেনের বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই। কোনও অভিযোগও নেই। তিনি চট্টগ্রামে স্ত্রী নিয়ে থাকতেন। শনিবার বাড়ি আসার পথে চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

চান্দিনা থানার ওসি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘গণপিটুনিতে চান্দিনায় দুজন নিহত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাইনি। মোজাম্মেল হোসেনের মা মামলা করেছেন। আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’

গণপিটুনির শাস্তি কী, এটি কোন ধরনের অপরাধ?

কুমিল্লা জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনও মানুষ ডাকাত কিংবা ১০ খুনের আসামি হলে তার শাস্তি আদালত দেবেন। গণপিটুনি সামাজিক অপরাধ। এটি হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য হয়। অপরাধী শনাক্ত হলে দেশের আইনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তারপরের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।’

হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাই অপরাধী উল্লেখ করে এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘যদি কেউ আত্মরক্ষায় প্রতিহত করতে যায় সেটিও আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। তা কিন্তু ভিন্ন বিষয়। কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে হত্যা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালত কিংবা দেশের আইন এমনকি কোনও জ্ঞানী মানুষ এটিকে কোনোভাবেই সমর্থন করেন না।’
 
গণপিটুনির সামাজিক প্রভাব

গণপিটুনির ফলে সমাজে কেমন প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝি দিন দিন বেড়েই চলছে। সমাজ এখন আর স্থিতিশীল অবস্থায় নেই। এসবের কারণে মানুষ প্রিয়জন হারায়। শিশু পিতৃশূন্য হয়। স্ত্রী স্বামীহারা হন। বাবা-মা তার আদরের সন্তান হারান। এতে অভাবের সংসারে অভাব যেমন বাড়ছে তেমনি আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভীতির জায়গা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গণপিটুনির এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তা সমাজে শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। এখনই এর প্রতিরোধ না করলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।’

গণপিটুনি প্রতিরোধের উপায়

আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘গণপিটুনির নেপথ্যে হতাশা, পূর্বশত্রুতা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণ রয়েছে। এগুলো থেকে উত্তরণে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সেজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের সন্দেহ কমিয়ে বিশ্বাস ও আস্থা বাড়াতে হবে। অন্যথায় সমাজে আতঙ্ক ছড়াবে। সমস্যার সমাধান হবে না।’

এসব বিষয়ে কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘চান্দিনায় যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, ওসব ঘটনায় সুনির্দিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেগুলো গণপিটুনি নয়, হত্যাকাণ্ড। আসামিদের গ্রেফতার তৎপরতা অব্যাহত আছে। তবে মুরাদনগরের ঘটনাটি গণপিটুনি। এটি নিয়ে তদন্ত চলছে।’ 

জনসাধারণের প্রতি আইন হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে পুলিশকে জানান। তা না হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে জানান। নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। আইন হাতে তুলে নিলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দেশে ডাকাতির ধরন

আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডা‌কাতি হলো পাঁচ কিংবা ততধিক ব্যক্তি একত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করলে তাকে ডাকাতি বলা যায়। একজন কিংবা দুজন অথবা তিন জনকে ডাকাতির অপবাদ দেওয়া যায় না। শর্ত হচ্ছে তাদের সঙ্গে অবশ্যই অস্ত্র থাকতে হবে এবং প্রকাশ্যে ঘটনা ঘটবে। মুরাদনগরের ঘটনায় তিন জন ছিল। একে ডাকাতি বলা যায় না। তাদের সঙ্গে অস্ত্রও পাওয়া যায়নি। এটিকে পিটিয়ে হত্যা বলা যায়। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’

/এএম/
সম্পর্কিত
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ১০ বছরের কারাদণ্ড
মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে হত্যা, ভাতিজার যাবজ্জীবন
সর্বশেষ খবর
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী