X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাইকোর্ট বলেছেন বন্ধের কথা, জরিমানায় দায় সারে জেলা প্রশাসন

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
২৭ মার্চ ২০২৩, ০৮:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৮:০০

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর এলাকা একসময় পেয়ারা এবং কাঞ্চন ধানের জন্য খ্যাত ছিল। অথচ এখন ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিবর্ণ সেই এলাকা। এখানে গড়ে উঠেছে ৩০টির বেশি ইটভাটা। এর মধ্যে ২৫টিরই পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের ছাড়পত্র নেই। এরপরও এসব ভাটায় বছরের পর বছর তৈরি হচ্ছে ইট। পুড়ছে বনের কাঠ। এতে বাতাসের বিষে বিবর্ণ হচ্ছে পরিবেশ, বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা।

গত ১৩ নভেম্বর দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা পেয়ে সাতকানিয়া উপজেলার একটি ইটভাটা বন্ধ করেছিল প্রশাসন। এরপর আর কোনও ইটভাটা বন্ধ করা হয়নি। তবে বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার তালিকা করে তা জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিয়ে দায় সেরেছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার অজুহাতে ইটভাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি উচ্চ আদালত বন্ধের কথা বললেও কয়েকটি ভাটাকে জরিমানা করে দায় সারছে জেলা প্রশাসন।

জেলার ১৫টি উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে অনুমোদনহীন ভাটার সংখ্যা তিন শতাধিক। পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন আছে ১২০টির। অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও নেয়নি পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

এসব ভাটায় পুড়ছে কাঠ ও কয়লা, বাতাসে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব ইটভাটার অনুমোদন আছে সেগুলোতেও আছে শুভংকরের ফাঁকি। জেলার বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে পাহাড় কেটে কিংবা ফসলি জমিতে। অনেক ইটভাটা রয়েছে লোকালয়ে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং বিভিন্ন বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে।

এ ছাড়া তথ্য গোপন করে পৌর এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেক ইটভাটা। এমনকি হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষেও গড়ে উঠেছে ইটভাটা। যেগুলো নদী, জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ১০ দিনের ব্যবধানে তিন দফা অভিযানে সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ উপজেলায় পাঁচ ইটভাটাকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ২০ মার্চ বাঁশখালী উপজেলার এমবিএম এবং এনটিবি নামে দুই ইটভাটাকে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো এবং কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে ইট তৈরির অভিযোগে এসব জরিমানা করা হয়। 

এর আগে সাতকানিয়া উপজেলায় তিনটি ইটভাটাকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তার আগে চন্দনাইশে দুটি ইটভাটাকে এক লাখ টাকা করে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

জেলা পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার ১৫ উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে ফিক্স চিমনি (৮৯-১২০ ফুট উঁচু) ইটভাটা আছে ২৭৩টি, জিগজ্যাগ চিমনি আছে ১১৬টি এবং পরিবেশ ফ্রেন্ডলি টেকনোলজির ইটভাটা আছে ১১টি। ইটভাটা পরিচালনার জন্য ছাড়পত্র আছে ১২০টির। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে আরও ২৯৩টি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে অনুমোদনহীন অর্থাৎ অবৈধভাবে।

বাতাসের বিষে বিবর্ণ হচ্ছে পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী উপজেলায় ১২টি ইটভাটার মধ্যে সবগুলোর অনুমোদন আছে। তবে আনোয়ারায় দুটির মধ্যে একটি, পটিয়ায় দুটির মধ্যে একটি, সন্দ্বীপে ১১টির মধ্যে ৯টি, বাঁশখালীতে ১২টির মধ্যে ১০টি, বোয়ালখালীতে পাঁচটির মধ্যে চারটি, মীরসরাইয়ে ১৫টির মধ্যে ৯টি অবৈধ। 

এ ছাড়া সীতাকুণ্ডে আটটির মধ্যে ছয়টি, চন্দনাইশে ৩২টির মধ্যে ২৫টি, লোহাগাড়ায় ৪৮টির মধ্যে ৪৫টি, ফটিকছড়িতে ৫৫টির মধ্যে ৪৩টি, সাতকানিয়ায় ৭০টির মধ্যে ৪৫টি, রাউজানে ৩৭টির মধ্যে ২৯টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টির মধ্যে ৬৬টি ও হাটহাজারীতে ৩৫টির মধ্যে ২০টি অবৈধ।

জেলা পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবস্থা বন্ধ করা, ইটের বিকল্প ব্লক উৎপাদন ও ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ, ভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক এবং ব্লক তৈরিতে লাইসেন্সের অপ্রয়োজনীয়তা, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ করা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও ফটিকছড়িতে। এখানে পাহাড়ের মাটি কেটে এবং ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে তৈরি করা হচ্ছে ইট। 

অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর পাশ ঘেঁষেও গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইটভাটা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হালদা পাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ২০২১ সালের ১১ মার্চ রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোকামিপাড়ার দক্ষিণ সীমান্তে হালদা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা এম আলী ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয় প্রশাসন। গত বছর আবারও চালু করা হয় এই ইটভাটা। এ ছাড়া হালদার পাড়ে উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখিল গ্রামে শান্তি ব্রিকস, একই ইউনিয়নের মইশকরম গ্রামে হালদার পাড়ে আজমির অটো ব্রিকসসহ আরও কয়েকটি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে নিয়ম না মেনে। বিশেষ কায়দায় নদীর বুক কেটে এসব ভাটার জন্য তোলা হয় মাটি ও বালু। নদী থেকে তোলা এসব মাটি ও বালু দিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট। এসব ইটভাটা হালদা নদী ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

এ প্রসঙ্গে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর সুরক্ষা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, হালদা পাড়ের একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অর্থাৎ পাড়ের কাছাকাছি প্রাণী ও উদ্ভিদ আবাসস্থল ধ্বংস, ভূমি ও পানি প্রাকৃতিক, পরিবেশ নষ্ট করতে পারে এমন কোনও স্থাপনা করা যাবে না। নদী ও মৎস্যসহ নদীর নানা জীববৈচিত্র্যের জন্য ইটভাটা চরম হুমকি। একসময় হালদার পাড় ঘেঁষে ১৩-১৪টি ইটভাটা ছিল। এর মধ্যে ১০-১২টি বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও যেসব ইটভাটা রয়েছে, সেগুলো বন্ধে আমরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু নানা প্রভাব খাটিয়ে এসব ইটভাটা চলছে। হালদা নদীর পাড়ে থাকা ইটভাটা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা মনে করেছিলাম, পরিবেশ অধিদফতর সব অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করবে। অথচ প্রশাসন উচ্ছেদ না করে জরিমানা করে দায় সারছে। জরিমানা করা মানে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের সহযোগিতা করা, অবৈধতাকে বৈধতা দেওয়া। ইটভাটার নামে ভূমিদস্যুরা চন্দনাইশে পাহাড় ধ্বংস করছে। এলাকার অনেক চাষাবাদের জমি ইটভাটার আওতায় এনে ধ্বংস করা হয়েছে। টপ সয়েল বলতে এখানে কিছুই নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।’

অধিকাংশ ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ ও কয়লা, এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় এখানকার মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না উল্লেখ করে জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘কালো ধোঁয়ায় গাছপালা মরে যাচ্ছে। একসময় চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকায় কাঞ্চন ধান চাষ হতো। পেয়ারা বাগান ছিল। সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো চট্টগ্রামে একই অবস্থা। নান্দনিক এই নগরীকে গিলে খাচ্ছে ইটভাটা। অবৈধ ইটভাটাগুলোকে জরিমানা না করে বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উচ্চ আদালতের আদেশ মেনে কাজ চলছে বলে দাবি করেছেন পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আদালতের আদেশে কোন সংস্থার কী কাজ, তা বলা আছে। আমাদের কাজ আমরা করেছি। যেসব ইটভাটা অবৈধ সেগুলোর তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসনকে দিয়েছি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রামে সম্প্রতি যেসব ইটভাটাকে জরিমানা করা হয়েছে তার বেশিরভাগ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জরিমানা নয়, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনার পর অধিকাংশ ইটভাটার মালিক উচ্চ আদালতে রিট করেন। আমরা অভিযানে গেলে তারা উচ্চ আদালতের ওই আদেশের কপি আমাদের সামনে হাজির করেন। এই কারণে উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে গাছ পোড়ানো ও মাটি কাটার অপরাধে জরিমানা করা হয়।’

/এএম/
সম্পর্কিত
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
সর্বশেষ খবর
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ