X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

টানেল যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় বাংলাদেশ 

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
১৩ মে ২০২৩, ১১:৫৬আপডেট : ১৩ মে ২০২৩, ১৩:৪৯

কয়েক মাস পর টানেল যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’-এর কাজ ইতোমধ্যে ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হলেই উদ্বোধন করা হবে বহু প্রতীক্ষিত টানেল। ইতোমধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে যানবাহনের টোল হার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেল চালু হলে যোগাযোগ, পর্যটন ও অর্থনীতির গতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ওয়ান সিটি টু টাউন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একধাপ এগিয়ে যাবে। টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিধি বাড়বে। টানেলের এক প্রান্তে চট্টগ্রাম শহর, অপর প্রান্তে রয়েছে আনোয়ারা উপজেলা। শহরের খুব কাছে থাকলেও এ উপজেলা এতদিন অবহেলিত ছিল। টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে আরেকটি শহরে রূপ নিচ্ছে আনোয়ারা। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে টানেল সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৩ মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতি গতি পাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশপথ (ফাইল ছবি)

প্রকল্প ব্যয়

টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। গত ১৭ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প ব্যয় ৩১৫ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা করা হয়। কাজের সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। 
 
যানবাহন চলাচল

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টানেল দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

বঙ্গবন্ধু টানেলে ভেতরের চিত্র

টানেলের ইতিবৃত্তি

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এরমধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে। 

গত বছরের ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল প্লাজা (ফাইল ছবি)

টোল হার

টানেলের ভেতর দিয়ে চলতে হলে কোন গাড়িকে কত টাকা টোল দিতে হবে, তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রাইভেটকার বা জিপ গাড়িকে গুনতে হবে ২০০ টাকা, পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ আসনের কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসনের বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩ এক্সেল) ৫০০ টাকা, এছাড়া ভারী যানবাহন ট্রাকের (৫ টন) ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫.১ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৮.০১ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ৮০০ টাকা, ট্রেইলার (ফোর এক্সেল পর্যন্ত) ১ হাজার টাকা এবং ফোর এক্সেলের অধিক ট্রেইলারের জন্য এক হাজার টাকার পাশাপাশি প্রতি এক্সেলের জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা হারে টোল দিতে হবে। টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত বছরের ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টানেলের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার গাড়ি চলাচল করতে পারবে না। টানেলের নিরাপত্তা তথা দুর্ঘটনা এড়াতে এসব ছোট যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হবে না। পাশাপাশি পায়ে হেঁটেও পার হওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে টানেল দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে উৎসাহিত করা হবে।

কর্ণফুলী নদীর নিচে বঙ্গবন্ধু টানেল (ফাইল ছবি)

টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানেলের শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৯৬.৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন টানেলে বড় ধরনের কাজ নেই। যানবাহন চলাচলের নিরাপত্তার খুঁটিনাটি বিষয় দেখা হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে এপ্রিলের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি। টানেল কবে উদ্বোধন করা হবে তা ঠিক করবে মন্ত্রণালয় থেকে।’

টানেল প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানেল হবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেওয়ার রোডম্যাপ। টানেল থেকে চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশ সুবিধা পাবে তা নয়, এশিয়ান সড়ক নেটওয়ার্ক ও পূর্বমুখী বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। শিল্পায়ন অনেক বেশি গতি পাবে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের পাশে থেকেও অবহেলিত আনোয়ারা উপজেলা রূপ নেবে নতুন শহরে। টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজারেও সড়ক যোগাযোগ এবং অর্থনীতিতে এই টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানেল চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। টানেলের সড়ক একসময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। এমন মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কিছু দিন পর সমুদ্রের পাড়ে বে-টার্মিনাল চালু হবে। সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মযজ্ঞ হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে কাজ করবে, যার প্রভাব নগরীতে পড়বে। টানেলের অপর প্রান্তে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে জনসমাগম।’

/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
বঙ্গবন্ধু টানেলের ওয়্যারহাউসে আগুন
টানেলে অনিয়ন্ত্রিত গতি, ধরবে কে?
সর্বশেষ খবর
পটুয়াখালীর খালে ভাসছে ‘টর্পেডো’সদৃশ বস্তু, স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক 
পটুয়াখালীর খালে ভাসছে ‘টর্পেডো’সদৃশ বস্তু, স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক 
বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান
বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান
হাওরে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, কৃষকদের জন্য ৮ পরামর্শ
হাওরে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, কৃষকদের জন্য ৮ পরামর্শ
‘জেসিকে দেখে কর্মকর্তারা নাখোশ ছিল, ক্রিকেটারদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই’
‘জেসিকে দেখে কর্মকর্তারা নাখোশ ছিল, ক্রিকেটারদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই’
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে