বনদস্যুদের থাবায় দিন দিন ছোট হয়ে আসছে বান্দরবানের থানচির সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই বনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও অবাধে চলাফেরা করছে স্থানীয়রা। বনদস্যুরা গাছ কেটে নিয়ে গেলেও নিয়মিত অভিযান চালায় না বন বিভাগ। এমনকি এখন পর্যন্ত একটি মামলাও করেনি তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন রক্ষায় উদাসীন বন বিভাগ। উল্টো এই বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে বনাঞ্চলকে ধ্বংস করছে সংঘবদ্ধ কাঠ পাচারকারী ও বনদস্যুরা।
পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলছেন, দিন দিন ছোট হয়ে আসছে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট। রক্ষা করতে না পারলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে পাহাড়ি এই অঞ্চল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাঙ্গু বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। তার উৎপত্তি বান্দরবানের গহীনে সাঙ্গু-মাতামুহুরি রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে। এই নদী ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত আন্ধারমানিক থেকে লিকরি পেরিয়ে সাঙ্গু নদী থেকে আরও দূরে মাতাদুসরি, ব্রুংক্ষিয়াং, তংক্ষিয়াং, লাগপাই ও থাকব্রো ঝিরির সঙ্গে মিলেছে। ১৮৮০ সালে সংরক্ষিত ঘোষিত এই বনাঞ্চল দেশের একমাত্র কুমারী বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮০ সালে এই বনাঞ্চলের আয়তন ছিল ৮২ হাজার ৮০ একর। তবে বর্তমানে আয়তন কমেছে। কারণ এরই মধ্যে অনেক স্থানে বসতি গড়ে উঠেছে। বড় কিছু গাছ কেটে নিয়ে গেছে বনদস্যুরা। এছাড়া নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গাছ নষ্ট হয়েছে। তবে কী পরিমাণ গাছ নষ্ট হয়েছে, সে হিসাব নেই বন বিভাগের কাছে। কারণ এখনও কোনও জরিপ করেনি তারা।
২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত সাঙ্গু বনাঞ্চলের ওপর জরিপ চালায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, এই বনাঞ্চল আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ফলে ১১৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী এবং বিরল প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
২০১৬ সালে এই বনাঞ্চলের চিত্র বিশ্লেষণ করেছে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)। স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে এর চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়। এতে বলা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বনাঞ্চলের ৮৬৭ হেক্টরের চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হেক্টর ভূমির গাছপালা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার দেখা গেছে। আরও কিছু স্থানে কম গাছপালা দেখা গেছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালে এই বনাঞ্চলের তিন হাজার ফুট গাছ বান্দরবানের একটি সমিল থেকে জব্দ করেছিল বন বিভাগ। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। এমনকি মামলাও হয়নি। বিভাগীয় কার্যালয়ে এ নিয়ে একটি মামলাও নেই। এখনও নানা কৌশলে গাছ কাটলেও বনদস্যুদের ধরার কোনও উদ্যোগ নেই।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্টের দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় কর্মকর্তা ফরিদ মিয়ার নেতৃত্বে থানচির ইয়াংরি এলাকা থেকে কয়েক হাজার ফুট গাছ জব্দ করা হয়। পরে সেগুলো নিলামে বিক্রি করা হয়। এ ঘটনায় থানচি রেঞ্জ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছিল। তবে কোনও মামলা হয়নি।
বর্তমানে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্টের আয়তন কত জানতে চাইলে বান্দরবানের অঞ্চলের বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘অনেক বছর ধরে জরিপ হয়নি। তাই আয়তন আমাদের জানা নেই। তবে এটা সত্য, আয়তন কমেছে। কারণ সেখানে ইতোমধ্যে অনেকগুলো পাড়া ও বসতি গড়ে উঠেছে। আমরা জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেবো। জরিপের পর বলতো পারবো কী পরিমাণ বন, প্রাণী ও পাখি কমেছে।’
বন ধ্বংসের পেছনে বন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘দুর্গম এলাকা হওয়ায় সাঙ্গু বনাঞ্চলে আমাদের পক্ষে যাওয়া সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
বনাঞ্চলের আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাঙ্গু নদীর দুই পাড়ে একসময় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো শতবর্ষী গাছ। এখানে রয়েছে প্রায়-বিলুপ্ত প্রজাতির গোদা, গর্জন, চম্পা, জারুল, গুটগুটিয়া, মাদার ট্রি, মোমবাতি, চাপালিশ ও গামারসহ নানা প্রজাতির শতবর্ষী গাছ। থানচি থেকে সাঙ্গু নদীপথে তিন্দু, রেমাক্রি, বড় পাথর হয়ে বড় মদক, ছোট মদক, নারিশ্যা ঝিরি, ইয়াংরিং, লিকরি, আন্ধারমানিক, রেমাক্রি ও তিন্দুতে যাওয়ার পথে গাছগুলো দেখা যেতো। গত কয়েক বছর বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গাছগুলো কেটে ফেলেছে সংঘবদ্ধ কাঠ পাচারকারীরা। গাছ পাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একটি মামলা করেনি বন বিভাগ। এখনও নানা কৌশলে গাছ কাটা অব্যাহত আছে। তাদের ধরার কোনও উদ্যোগ নেই।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বনাঞ্চল সংলগ্ন বড় মদক, ছোট মদক, রেমাক্রি ও তিন্দু এলাকার জামাল সওদাগর, নাজিম সওদাগর, মহিউদ্দীন, সালাউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন গাছ কেটে পাচার করছে। সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে নদীপথে চট্টগ্রামে গাছ পাঠাচ্ছে তারা। ইয়াংরিং, নারিশ্যা ঝিরি, আন্ধারমানিক ও লিকরি এলাকায় গাছ কেটে নেওয়ার সাক্ষী হিসেবে শিকড় ও গোড়া পড়ে আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে থানচির গাছ ব্যবসায়ী মহিউদ্দীন ও সালাউদ্দিন জানান, আগে অনেকে গাছ কেটেছে। কিন্তু বর্তমানে কাটার কোনও সুযোগ নেই। আমাদের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।
স্থানীয়দের দাবি, বনাঞ্চল রক্ষায় কাঠুরিয়াদের সরানো, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, বড় মদক, ছোট মদক, রেমাক্রি ও তিন্দু এলাকায় জোত পারমিট ও কাঠ পরিবহন বন্ধ এবং উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। পাশাপাশি থানচির সড়ক এবং নদীপথ বন্ধ করতে হবে।
তিন্দু ইউনিয়নের বাসিন্দা মেনলে ম্রো বলেন, ‘সারা বছরই গাছ কেটে নদীপথে নিয়ে যেতে দেখি। স্থানীয় অনেকে গাছ কাটায় জড়িত। বন বিভাগ ব্যবস্থা নিলে এভাবে গাছ কাটার সুযোগ পেতো না তারা।’
তদন্ত করে রেঞ্জ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিতে হবে উল্লেখ করে থানচির হেডম্যানপাড়ার অনুপম মারমা বলেন, ‘পাশাপাশি গাছ ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। এছাড়া গাছ কাটা বন্ধ হবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এই বনাঞ্চলে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১১ প্রজাতির বিরল পাখির অস্তিত্ব আছে। বনাঞ্চলে ঢুকতে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। অথচ বিনা অনুমতিতে অবাধে বনে ঢুকছে মানুষ। বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে গাছ কাটা হচ্ছে। অথচ কোনও মামলা নেই। বিষয়টি উদ্বেগের। এই বনাঞ্চল ধ্বংস হলে পরিবেশের বহুমাত্রিক বিপর্যয়সহ সাঙ্গুর পানি কাঠামোর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।’
গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনায় কোনও মামলা নেই কেন জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন, ‘গাছ কাটার ঘটনায় একটি মামলাও না হওয়া উদ্বেগের বিষয়। আন্ধারমানিক ও লিকরির কিছু স্থানে গাছ কাটার খবর পেয়েছি। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবো আমি।’