দীর্ঘ ১১ বছরেও শেষ হয়নি চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের কাজ। নগরকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষায় ২০১৪ সালে এই খাল খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। গত ১১ বছরে খনন হয়েছে দুই কিলোমিটার। অথচ খালটির দৈর্ঘ্য দুই দশমিক নয় কিলোমিটার। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খননকাজ শেষ করার আশা করছেন চসিকের কর্মকর্তারা।
চসিক সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ১৯৯৫ সালে করা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দুই দশমিক নয় কিলোমিটারের খালটি খননের সুপারিশ করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চসিক। ২০১৪ সালের ২৪ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ওই সময়ের মধ্যে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া এবং জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ থমকে যায়।
২০১৭ সালের নভেম্বরে একনেকে প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করে আবারও অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। এ সময় এক লাফে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়ে যায় এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল সংশোধনে প্রকল্প ব্যয় আট দশমিক চার শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ১০৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয় হবে প্রায় ২৫ দশমিক ২৩৫ একর জমি অধিগ্রহণে। তখন চার বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে কাজ শেষ করতে বলা হয়। এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। এখন ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দুই দশমিক নয় কিলোমিটার খালটি হবে ৬৫ ফুট চওড়া। দুই পাশে ২০ ফুট করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের দুটি রাস্তা হবে। ছয় ফুট প্রস্থের দুটি করে ওয়াকওয়ে হবে। প্রকল্পটির ১৫ দশমিক ১৬ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে চার কিলোমিটার, নয়টি ব্রিজের মধ্যে ছয়টি, পাঁচ দশমিক আট কিলোমিটার সড়কের মধ্যে তিন দশমিক ৮০ কিলোমিটার ও দুই দশমিক নয় কিলোমিটার খালের মধ্যে দুই কিলোমিটারের খননকাজ শেষ হয়েছে। খালটি বারইপাড়া হাইজ্জারপুল থেকে শুরু হয়ে নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজের পাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে।
চসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, খাল খননের কাজ শেষ হলে পূর্ব-পশ্চিম, দক্ষিণ শুলকবহর, চান্দগাঁও, নাসিরাবাদ, মোহরা, পূর্ব-পশ্চিম ষোলশহর, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া ও চাক্তাই সংলগ্ন এলাকার মোট আট ওয়ার্ডের ১০ লাখ বাসিন্দা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে বলে আশা করা যায়।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। এখন নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ বাড়লে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ছিল, প্রকল্পের অধীন পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায়নি, মামলাসহ নানা জটিলতার কারণে কাজ দীর্ঘায়িত হয়। বর্তমানে খননকাজ ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে নগরের দুই হাজার ২৬৪ হেক্টর এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে।’
এদিকে, বর্ষা এলেই শুরু হয় জলাবদ্ধতা। বছরের পর বছর এ সমস্যা কমার পরিবর্তে বেড়েছে। বর্তমানে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে নগর। সড়ক অলি-গলি এবং বাড়িঘর ডুবে দুর্ভোগের শেষ থাকে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের এটিসহ ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এর মধ্যে আট হাজার ৬২৬ কোটি টাকায় ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুই হাজার ২৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এ ছাড়া এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের কাজ করছে সিটি করপোরেশন।
বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা নগরের জন্য অভিশাপ বলে উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির শাহজাহান চৌধুরী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামে আর জলাবদ্ধতা দেখতে চাই না। বিগত সময়ে খালখনন ও জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে অর্থ লুটপাট হয়েছে। নগরের ৫১টি খাল দখল হয়ে গেছে। দখলদারদের কবল থেকে এসব খাল উদ্ধার করতে হবে।’
জলাবদ্ধতায় ভোগান্তির কথা জানিয়ে বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিট বৃষ্টি হলেই বহদ্দারহাটসহ নগরের বেশিরভাগ এলাকা ডুবে যায়। পানি ঢুকে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এ সমস্যা বছরের পর বছর চলছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ আর টাকা বাড়ে। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলে না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের কাজ দ্রুত শেষ করতে চাই আমরা। যাতে আগামী বর্ষায় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারি। এজন্য নতুন খাল খননের পাশাপাশি নগরের ৩৬টি খাল সিডিএর প্রকল্পের অধীন আছে। এর বাইরে আরও ২১টি খাল রয়ে গেছে। এসব খাল সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হবে। যাতে পানি সহজেই নিষ্কাশন হয়।’
গত শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) নগরের খাল খনন প্রকল্প পরিদর্শন করেন শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। পরিদর্শন শেষে উপদেষ্টা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চট্টগ্রামে খাল খননের নামে দুর্নীতি ও বিপুল অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। শহরের ভেতরে খালগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ শুরু করেছি ও এই কাজ এগিয়ে যাবে। এবারের বর্ষায় আমরা যতদূর জলাবদ্ধতা কমিয়ে আনতে পারি এবং সেটার মধ্য দিয়ে আগামী বর্ষার আগে জলাবদ্ধতা দূর হবে। এই বছর নগরের ২১টি খাল পরিষ্কারের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।’