X
রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
১ আষাঢ় ১৪৩২

ফিরতি যাত্রায়ও ভোগান্তি

আসাদ আবেদীন জয়
১৪ জুন ২০২৫, ২১:৩১আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ২১:৫৯

গত ৫ জুন থেকে শুরু হয় ঈদুল আজহার ছুটি, যার শেষ দিন আজ (শনিবার) ১৪ জুন। দীর্ঘ এই ছুটিতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে নিজ নিজ বাড়ির পথে যাত্রা করে রাজধানীর কর্মজীবী মানুষেরা। ছুটি কাটাতে মূলত ৫ জুন থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেও কেউ কেউ এর আগেই নিজ গন্তব্যে যাত্রা করেন। সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান পথে গন্তব্যে রওনা হন রাজধানীর বাসিন্দারা।

সড়কপথে ছুটি শুরুর আগের দিকে যাত্রা স্বস্তির হলেও দিন পার হওয়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে নানা ধরনের ভোগান্তি। এরমধ্যে বাসের টিকিট না পাওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট উল্লেখযোগ্য। এসব কারণেই ঘরমুখো মানুষের স্বস্তির যাত্রা পরিণত হয় ভোগান্তিতে। আনন্দের ঈদযাত্রা অনেকের জন্যই ছিল ভোগান্তিতে ম্রিয়মাণ।

শনিবার (১৪ জুন) রাজধানীর গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও যাত্রাবাড়ী এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জানা যায় ঈদযাত্রায় যাত্রীদের ভোগান্তির কথা।

গাবতলী বাস টার্মিনালে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী মিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার ঢাকায় আসার কথা ছিল সকাল ৬টায়। রাত ৯টার বাসে উঠেছিলাম। সময় বেশি ধরেই ভেবেছিলাম সকাল ৬টায় পৌঁছাবো। কিন্তু এসে পৌঁছালাম দুপুর আড়াইটায়। ভয়াবহ জ্যাম ছিল। যমুনা সেতু, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ, এলেংগা মূলত এই চারটা জায়গায় জ্যাম থাকার কারণে এতো সময় লেগেছে। যাওয়ার সময়ও একই ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তখন সময় আরও বেশি লেগেছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টার কাছাকাছি। 

মো. মাসুম মিয়া চাকরি করেন একটি পোশাকের শো রুমে। বাড়ি তার গাইবান্ধা। তিনি বলেন, আমি বাড়ি গিয়েছি ঈদের পরেরদিন। তখন গাবতলী থেকে বাসে উঠেছিলাম দুপুর ২টায়। বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছি সন্ধ্যা ৬টায়। আর আসার জন্য গতকাল বাসে উঠেছি রাত সাড়ে ১০টায়। আর আসলাম বিকাল তিনটায়। এই হচ্ছে ভোগান্তির অবস্থা। বিভিন্ন জায়গায় জ্যামে পড়তে হয়েছে। কিন্তু যমুনা সেতুতে সবচেয়ে বেশি। ওখানেই মনে হয় ৪/৫ ঘণ্টা চলে গিয়েছে।

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নাইব হাসান এসেছেন দিনাজপুর থেকে। তিনি জানান, তার অফিস শুরু হবে সোমবার থেকে। একদিন হাতে সময় রেখেই এসেছেন কর্মস্থলে। তিনিও যাত্রাপথে ভোগান্তির কথা জানিয়ে বলেন, আগেও বাড়িতে যেতাম কিন্তু এরকম ভোগান্তি হতো না যমুনা সেতুতে, এবার যেরকম হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আমার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। কিন্তু আসলাম সাড়ে ১২টায়। যমুনা সেতুর টোল প্লাজায় ৪/৫ ঘণ্টা করে অতিরিক্ত সময় লাগছে। সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। তাহলে আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না।

মিরপুরের একটি হোস্টেলের কর্মচারী আরিফ হোসেন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে। তিনি বলেন, নিয়মিত যাতায়াত করা গণপরিবহনের টিকেট পাইনি। পরে একটা লোকাল বাসে করে এসেছি। রাস্তায় যানজট না থাকলেও বাস পেতে সময় লেগেছে।

অন্তরা পরিবহনে পটুয়াখালী থেকে ঢাকা এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই আসতে হয়েছে। ৬০০ টাকার ভাড়া ৯০০ নিয়েছে। বাড়তি ভাড়ার কারণে গতকাল বাস বন্ধ ছিল। এরপরও আজ সেই বাড়তি ভাড়াই নিয়েছে। কাল থেকে অফিস খোলা। আজ না গেলে সমস্যায় পড়তে হবে। সেজন্য অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই এসেছি।

বাসে রামগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছেন ব্যবসায়ী নাসির হোসেন। তিনি বলেন, রামগঞ্জ থেকে হাজীগঞ্জ আসার ভাড়া ৩৫০ টাকা। আল আরাফাহ বাস সকল যাত্রীদের থেকে নিয়েছে ৫০০ টাকা। হাজীগঞ্জ থেকে ঢাকার ভাড়া বেশি নেয়নি। তবে যাওয়ার সময় সুরমা এক্সপ্রেস বাস ২৫০ টাকার ভাড়া ৪০০ টাকা নিয়েছে।

গাবতলী বাস টার্মিনালের সেন্টমার্টিন সি ভিউ এক্সপ্রেস বাসের কাউন্টার মাস্টার মো. হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের গাড়ি পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী এসব এলাকা থেকে আসে। তো ওখান থেকে আসতে আমাদের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। গড়ে মোটামুটি ৫ ঘণ্টা করে বেশি সময় লাগছে ঢাকায় আসতে। যে গাড়িটা সকাল ৬টায় পৌঁছানোর কথা সেটা আসছে সাড়ে ১১টায় ১২টায়। যমুনা সেতুতে এই সময়টা লাগছে। এছাড়া বাইপাইল, ইপিজেড এসব জায়গায়ও থেমে থাকছে।

তিনি আরও বলেন, আবার দক্ষিণাঞ্চল থেকে যে গাড়িগুলো আসছে সেগুলোও ৪-৫ ঘণ্টা দেরিতে আসছে। এগুলো রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় জ্যাম আর হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় এসে আটকে যায়।

ফিরতি যাত্রায়ও ভোগান্তি নিজেদের ব্যবসায়িক লস আর যাত্রীদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা শুধু আসার সময় হয়নি, যাওয়ার সময়ও একই ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। আর আমাদেরও লস গুনতে হয়েছে। কারণ আমরা যদি দশটি ট্রিপ দিতে পারতাম সেখানে আমরা ৭/৮ ট্রিপ দিয়েছি। জ্যামে বসে থাকলে তেলও বেশি খরচ হয়, যেহেতু এসি বাস। আবার শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বাস আসতে লেট করলে অনেকে টিকিট ক্যানসেল করে দেয়, এটাও তো লস।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সন্ধ্যায় তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে উত্তরবঙ্গের মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে লিখেন, 'শুধুমাত্র সংকীর্ণ টোল প্লাজার কারণে উত্তরবঙ্গের মানুষ যমুনা সেতুর পূর্বে ২০ কিলোমিটারের অধিক রাস্তা জ্যামে আটকে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় সেই জ্যামে। তারপরও কারও টনক নড়ে না।'

'ঢাকা থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় রেলে যেতে এখনও ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। সাধারণত ঢাকা-বগুড়া-রংপুর হয়ে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় যাওয়ার কথা। অথচ তাদেরকে রাজশাহী- নওগাঁ-নাটোর হয়ে ট্রেনে করে প্রায় ২০০ কিলোমিটার অধিক রাস্তা ঘুরে যেতে হয়। যেখানে বগুড়া হয়ে রংপুর দিয়ে ট্রেন লাইন থাকলে এই ২০০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হতো না।'

স্ট্যাটাসে তিনি আরও লিখেন, এই ঈদে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে আমার সময় লেগেছে ১৭ ঘণ্টা। আসতে সময় লেগেছে ১৫ ঘণ্টা। কারও ২০ ঘণ্টাও পেরিয়ে গেছে। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ঢাকা থেকে দেশের এক প্রান্তে যেতে যদি এত দীর্ঘ সময় লাগে তাহলে উন্নয়নের গল্প খুবই অপ্রাসঙ্গিক।'

কেবল ঢাকা ফেরার পথেই না, যাওয়ার পথেও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে যাত্রীদের। তারা জানিয়েছেন, ঢাকা ফেরার পথে যেমন তারা ভোগান্তিতে পড়েছেন ঠিক একইভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাওয়ার পথেও।

মূলত ৪ জুন রাত থেকে মহাসড়কে বাড়তে থাকে যানবাহনের চাপ। এতে করে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। এদিন মধ্যরাতে যমুনা সেতু থেকে রাবনা বাইপাস পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, গাড়ি দুর্ঘটনা ও যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ ২৩ কিলোমিটার যানজট। এতে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন।

এই পথে যাতায়াতকারী যাত্রী ও গাড়ির চালকরা জানিয়েছেন, মূলত যমুনা সেতুর টোলপ্লাজার কারণে এই দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

যদিও ঈদযাত্রায় যমুনা সেতুর প্রস্তুতি নিয়ে (৪ জুন) যমুনা সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল বলেছিলেন, যানজট নিরসনে যমুনা সেতু পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে ৯টি করে ১৮টি টোল বুথ স্থাপনসহ মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা চারটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর ওপর কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এ জন্য দুইটি রেকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

৫ জুন সকাল ৯টা থেকে রাজধানীর উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এতে করে সময় মতো ছেড়ে যেতে পারেনি এখানের বাসগুলো। যাত্রীরা জানিয়েছিলেন, সকাল ৮টার দিকে বাস ছাড়ার কথা থাকলেও ৯টা বেজে গেলেও বাস আসতেই পারেনি।

একই দিন দক্ষিণবঙের প্রবেশপথ খ্যাত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সকাল ১০টার পর শ্রীনগর উপজেলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় যান চলাচল ছিল ধীরগতির। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় টোল আদায়ের দীর্ঘ লাইনের কারণে এই ধীরগতি আসে। যদিও সেতুর টোল প্লাজার বুথে নিরবচ্ছিন্নভাবেই টোল আদায় করা হয়। 

এদিকে ৫ ও ৬ জুন যারা অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি আর যাদের টিকিট ছিল না, তারা ছুটে বেড়িয়েছেন টিকিটের খোঁজে। এসময় কেউ কেউ বাধ্য হয়ে খোলা ট্রাকে করে যাত্রার প্রস্তুতি নেন।

/এমএস/
সম্পর্কিত
নৌপথে ফিরতি যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়
সিরাজগঞ্জের মহাসড়কে ১৫ কিলোমিটার যানজট
টানা ১০ দিনের ছুটি শেষ, রবিবার খুলছে সরকারি অফিস
সর্বশেষ খবর
ইরান–ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে
ইরান–ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে
ভোগান্তি ছাড়াই দৌলতদিয়া ঘাট পার হয়েছে যাত্রীরা
ভোগান্তি ছাড়াই দৌলতদিয়া ঘাট পার হয়েছে যাত্রীরা
হাজারীবাগে বাবার ছুরিকাঘাতে তরুণ নিহতের অভিযোগ
হাজারীবাগে বাবার ছুরিকাঘাতে তরুণ নিহতের অভিযোগ
কোরবানির চামড়া: সরকার নির্ধারিত দাম পাচ্ছেন না আড়তদাররা
কোরবানির চামড়া: সরকার নির্ধারিত দাম পাচ্ছেন না আড়তদাররা
সর্বাধিক পঠিত
এত বড় জাহাজ এর আগে মোংলায় আসেনি
এত বড় জাহাজ এর আগে মোংলায় আসেনি
পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় ট্যুর এক্সপার্ট গ্রুপের অ্যাডমিন গ্রেফতার
পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় ট্যুর এক্সপার্ট গ্রুপের অ্যাডমিন গ্রেফতার
ফেনীতে চিকিৎসকের চেম্বার ভাঙচুর-লুটপাট করলেন যুবদল নেতা
ফেনীতে চিকিৎসকের চেম্বার ভাঙচুর-লুটপাট করলেন যুবদল নেতা
সারা দেশে একদিনে গ্রেফতার ১৪৫২
সারা দেশে একদিনে গ্রেফতার ১৪৫২
আবারও বেড়েছে স্বর্ণের দাম
আবারও বেড়েছে স্বর্ণের দাম