X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

২০০ বছর ধরে কেন বিখ্যাত টাঙ্গাইলের চমচম?

এনায়েত করিম বিজয়, টাঙ্গাইল
০১ মার্চ ২০২২, ০৯:২৭আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২২, ২৩:২৫

ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতি ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। ঐতিহ্যবাহী এ জনপদের লোক-ঐতিহ্য নিয়ে প্রবাদে বলা হয়- ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথাতো জানে সবাই। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। তাইতো পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’।  
 
পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস। ইতিহাস বলছে- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। 

এর আগে ১৬০৮ সালে পোড়াবাড়ি গ্রামটিকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সে সময়কালে ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র পোড়াবাড়ি বাজার। তখন পোড়াবাড়ি ঘাটে ভিড়তো বড় বড় সওদাগরি নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার। এ বাজারে যোগ হয় সুস্বাদু চমচম, গড়ে ওঠে মিষ্টির বাজার। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। 

পোড়াবাড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বর্তমানে খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে পোড়াবাড়ি নয়, বর্তমানে টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনি বাজার মিষ্টি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ি মিষ্টি ঘরে এখনও নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়। এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। আর যেখানে চমচমের জন্ম সেই পোড়াবাড়িতে এখন রয়েছে হাতেগোনা মাত্র চার থেকে পাঁচটি মিষ্টির দোকান।

চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চমচম একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন, যা যে কোনও বয়সের লোকের কাছে লোভনীয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজা, জন্মদিনে, পরীক্ষায় ফলাফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনে জয়ী, নতুন চাকরি, শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনও সর্বমহলে প্রচলিত রয়েছে। শহরের পাঁচআনি বাজারের প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় পোড়াবাড়ির চমচম। বেশিরভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই এ চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের কাজের সহায়তার জন্য রয়েছে একাধিক সহযোগী। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়।

তবে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চমচম এখনও কেন এত জনপ্রিয়, সে তথ্য জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুন সালেহীন বলেন, ‘ছোট বেলায় দেখেছি হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। এখন অনেকগুলো দোকান হয়েছে। শৈশবে মিষ্টির স্বাদ ও বর্তমানের স্বাদ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে মিষ্টির গুণগত মান আগের তুলনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় পোড়াবাড়ির চমচম অনেক সুস্বাদু। দীর্ঘ পরিক্রমায় এখনও সেই সুনাম ধরে রেখেছেন চমচম ব্যবসায়ীরা।’  

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, ‘আমার বাবা ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমার পরের জেনারেশনে আমার ছেলেও আছে। মূলত এই পোড়াবাড়ির চমচমের উৎপত্তি হয়েছে সেই বিটিশ আমল থেকে।’

চমচমের জনপ্রিয়তা এবং স্বাদ ও মান বিষয়ে স্বপন ঘোষ বলেন, চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে- চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর জলেরও একটা বিষয় আছে। দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনও ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এসব কারণেই চমচম বিখ্যাত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। তবে তৎকালীন সময়ে মিষ্টির যে ফ্লেভার ছিল, সেটা বর্তমানে নেই। আমরা চেষ্টা করছি আগের ফ্লেভার ধরে রাখতে। তারপরও টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির মিষ্টির চেয়ে কোথাও আর ভালো মিষ্টি তৈরি হয় না।’

 জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার সুমির ঘোষ বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ থেকে মিষ্টি ব্যবসায় নিয়োজিত। এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। এজন্য আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। সারাদেশে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ’ টাকায়। মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টি অন্যান্য দোকানের চেয়ে ভিন্ন। এজন্য বিক্রিও হচ্ছে বেশি।’

গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্ণাধার দ্বীপ দাস বলেন, ‘মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। এই মিষ্টির টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য বহন করে। তাই আমরাও সেই ঐতিহ্য রক্ষায় মিষ্টির মান অনেক ভালো করি। মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চিনির দাম বেড়ে গেছে। আর প্যাকেট ছাড়া মিষ্টির ওজন দিতে হচ্ছে। এজন্য মিষ্টির দাম কিছু বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ’ টাকায়। প্রতি কেজিতে থাকে ১৪ থেকে ১৬ পিস করে মিষ্টি।’

 বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। টাঙ্গাইলের মোদক উপাধি প্রাপ্তরাও মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আর জেলার পরিচিতি নির্ধারক চমচমের পাশাপাশি এখন রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপি, সন্দেশ, দানাদার, দই, খির, রসমালাই, কালোজাম, খাজা, বাতাসা, কদমা, নই টানা ইত্যাদি মিষ্টিও মন ভিজিয়েছে খাদ্য রসিকদের। কিন্তু টাঙ্গাইলের মিষ্টি মানেই পোড়াবাড়ির চমচম। 

/টিটি/
সম্পর্কিত
যশোরে তিনটি খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে মামলা
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৫ টন চাল জব্দ, বিএনপি নেতা আটক
খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ না করায় রাজশাহী বিভাগে ৬১টি চালকলের লাইসেন্স বাতিল
সর্বশেষ খবর
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
বাজেটে ভর্তুকি দিলেও এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা
বাজেটে ভর্তুকি দিলেও এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা
সর্বাধিক পঠিত
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ