মহামারিকালে টানা ১৩ মাস ধরে করোনাভাইরাস পরীক্ষার দুই কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের পর যখন বিষয়টি জানাজানি হয় তখন নিজে বাঁচতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে খুলনার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। এই দুর্নীতির তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি নিজেই। তখন দায়সারা তদন্ত করে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের (ল্যাব) ওপর দায় চাপিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
তার নেতৃত্বে করা দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদনর ওপর ভিত্তি করে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন নিয়াজ মোহাম্মদ। এরপর সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও জিডির কপি নিজেই জমা দেন খুলনার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভাগীয় কার্যালয়ে। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে শুধুমাত্র ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন। এরপর দুদকের দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়েন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। হয়ে যান মামলার অভিযোগকারী থেকে আসামি। সর্বশেষ গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জনের দায়িত্বে থাকা এই সরকারি কর্মকর্তাকে বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকালে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর মহাখালীতে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ার পরও তাকে বরখাস্ত না করায় প্রশ্ন উঠেছে।
চলতি বছরের ২৭ জুলাই ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও খুলনার সাবেক সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদের যোগসাজশে ৭৯ লাখ ও ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের যোগসাজশে এক কোটি ৮২ টাকাসহ মোট দুই কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, খুলনার এই দুই সাবেক সিভিল সার্জন পরস্পর যোগসাজশে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সরকারি রসিদ বইয়ের বিপরীতে ডুপ্লিকেট রসিদ বই ব্যবহার করে বিদেশগামী যাত্রী ও সাধারণ কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ল্যাবে পাঠাতেন। তবে ল্যাবে যে পরিমাণ নমুনা পাঠানো হতো তার থেকে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে পরীক্ষার ফির টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১-এর জুলাই পর্যন্ত মোট ফি আদায় করা হয়েছিল চার কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টাকা। তবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছিল এক কোটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি দুই কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন, খুলনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) প্রকাশ কুমার দাস, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) মো. রওশন আলী, ক্যাশিয়ার তপতী সরকার ও আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. এস এম মুরাদ হোসেন।
রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) কথা হয় এ মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক খুলনার বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খন্দকার কামরুজ্জামানের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপে জানা যায় কীভাবে এ মামলার অভিযোগকারী থেকে মামলার আসামি হলেন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
এই তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘উল্লেখিত সময়ের ১৩ মাসে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ সুজাত আহমদের সহ বাকিরা প্রায় ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। পরে সুজাত আহমদের বদলি হলে তার জায়গায় আসে তৎকালীন সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ। তিনি যোগদানের পরও চলতে থাকে আত্মসাৎ। তিনি জেনেশুনে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আত্মসাতে সহায়তা শুরু করেন।’
দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে নমুনা প্রেরণের ফরওয়ার্ডিংয়ে নমুনার সংখ্যা লেখার জায়গা ফাঁকা রেখে তারিখবিহীন স্বাক্ষর করে অন্যান্য আসামিদেরকে উক্ত ফাঁকা জায়গায় ইচ্ছামতো সংখ্যা ও তারিখ বসিয়ে ডুপ্লিকেট রসিদ বইয়ের মাধ্যমে ল্যাবে প্রেরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। পরে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে সেই অনুযায়ী ইউজার ফির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। অর্থাৎ প্রকৃত আদায় করা ফি জমা না করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনা জানাজানি হওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে তার অধীনস্থ হাসপাতালের ডাক্তারদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নিজে কমিটির সভাপতি হয়ে প্রভাব বিস্তার করে তার ইচ্ছামতো তদন্ত করে এককভাবে ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাসের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপিয়ে প্রতিবেদন দেন। একইসঙ্গে নিজে অভিযোগকারী হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
দুদক কর্মকর্তা বলেন, এরপর দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে তার আসল কর্মকাণ্ড। তিনি বিদেশ গমনেচ্ছুদের নমুনার প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করে অসৎ উদ্দেশে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো নমুনার ফরওয়ার্ডিংয়ের অনুলিপি সংরক্ষণ না করে বা সরিয়ে ফেলে অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে কোভিড-১৯ রোগীদের ইউজার ফির সরকারি মোট দুই কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার মধ্যে তার কর্মকালে এক কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।’
এদিকে, আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর অভিযুক্ত গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ আদালত থেকে দুই সপ্তাহের জামিন নেন। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিম্ন আদালত উপস্থিত হয়ে স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন। এ দিন জামিন পেতে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পরে দুই পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক ও দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জামিন আদেশের কপি তুলে বিষয়টি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন জামিন দেখিনি। যদিও আদালত চাইলে তাকে জামিন দিতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জামিন দেওয়ার মানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া।’
এদিকে করোনা পরীক্ষার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে ওএসডি করা হয়েছে। তাকে স্বাস্থ্য অধিদফতর মহাখালীতে সংযুক্ত করে। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. জিল্লুর রহমান। বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী যেখানে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ কে সাময়িক বরখাস্ত না করে শুধুমাত্র ওএসডি করায় সাধারণ মানুষকে আইনের নামে ‘আইওয়াশ’ করা হয়েছে বলে মনে করছেন দুদকের ওই আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী আমরা যেটা দেখি সরকারি কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী যদি কোনও ফৌজদারি অপরাধে চার্জশিটভুক্ত আসামি হন তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার হবেন। পরে মামলার রায়ে যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন। আর যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হবেন। কিন্তু এখানে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে ওএসডি করা হয়েছে। এটা আসলে আইন না সাধারণ মানুষকে আইওয়াশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।’
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে সাময়িক বরখাস্ত না করে ওএসডি কেন করা হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আমাদের সিনিয়র সচিব স্যারের নির্দেশে তাকে ওএসডি করা হয়েছে। আমি নির্দেশিত প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র সাক্ষর করেছি। এ বিষয়ে বলতে পারবেন আমাদের সিনিয়র সচিব ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।’
এ বিষয়ে জানতে সিনিয়র সচিব ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠালেও সাড়া মেলেনি।