হারিয়ে গেছে হরিহর নদ। যারা একসময় এই নদে সাঁতার কেটেছেন, মাছ ধরেছেন, জমিতে সেচ দিয়েছেন—তারা এখন কেবল স্মৃতিচারণ করছেন। তাদের এই স্মৃতিচারণ তরুণ প্রজন্মের কাছে গল্পই মনে হবে। কারণ হরিহর নামে যে নদ ছিল, তার অস্তিত্ব এখন বিলীন।
কপোতাক্ষ নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে খুলনার আপারভদ্রা, সর্বশেষ তেলিগাতিতে মিশে ছিল হরিহর। ৪৫ কিলোমিটার এই নদের বেশিরভাগ এখন দখল হয়ে গেছে। কেউ পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ, কেউ বালু তুলে বিক্রি করছেন। আবার অধিকাংশ স্থান ভরাট করে ফেলেছেন স্থানীয়রা। যেসব স্থান দখল হয়নি, বর্ষা মৌসুমে সেসব স্থানে অল্প পানি থাকে। তাতে থাকে না ঢেউ। শীতকালে পানি শুকিয়ে হাঁটুসমান হয়ে যায়। হেঁটে পার হওয়া যায়।
নদের পাড়ের বাসিন্দা মণিরামপুর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামের আলিমুন নেছা (৬৮) বলেন, ‘নদীর মদ্যি মেশিন লাগায়ে লোকজন বালি তুলতেছে। ভয় করে কখন আমার বাড়িডা ধ্সে পড়ে। স্বামী-সন্তান নেই, ভয়তে কাউরে কতিও পারিনে কিছু।’
একই গ্রামের বাসিন্দা প্রায় একই বয়সের সৈয়দা খাতুনের বাবার বাড়িও একই এলাকায়। ছোটবেলা থেকে নদে গোসল করেছেন। তিনি বলেন, ‘আগে নদ ছিল। এখন বোঝা যায় না। লোকজন দখল কইরে খাচ্ছে, আমাগের নদে নামতিও দেয় না।’
৩০ বছর আগে এই নদে স্নান করেছি, সাঁতরাইছি বলে স্মৃতিচারণ করেন নদের পাড়ের বাসিন্দা গোয়ালদহ গ্রামের পীযুষ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘এখন নদের ভেতরে বিভিন্ন লোক বাঁধ দিয়ে নিজেদের সম্পদ বানিয়ে ফেলেছে। তারা এখানে মাছ চাষ করে, কেউ বালু তুলে বিক্রি করে দেয়। এইটা যে একসময়ের প্রবল প্রবাহের নদ ছিল, তা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই।’
দেশ স্বাধীনের পর এই গাঙে কতো ছ্যান (গোসল) করিছি জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ নজির (৬৫) বলেন, ‘সাঁতার কাটিছি, মাছ ধরিছি। কিন্তু এখন দেইখে বোঝার উপায় নেই, এইডে গাঙ।’
হরিহর নদকে মেরে ফেলা হয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় ব্যবসায়ী তবিবর রহমান বলেন, ‘শুনেছি, নদের একটি অংশজুড়ে পার্ক বা ফার্ম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নদনদী সরকারি সম্পত্তি। কখনও শুনিনি এটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয় কারও। হরিহরকে এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নদটি দ্রুত উদ্ধার করুক। সাধারণ মানুষ যেন এখানে গোসল করতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, জমিতে সেচ দিতে পারে, মাছ ধরতে পারে।’
নদের তীরবর্তী গোয়ালদহ, এড়েন্দা ও দোস্তপুর এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হরিহর নদের অস্তিত্ব এখন বিলীন। হরিহর নামে যে নদ ছিল, সেটি ভুলতে বসেছে এই প্রজন্ম। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদের অন্তত ১৫৬ স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ এবং বালু তোলা হচ্ছে। এতে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে নদটি।’
গোয়ালদহ বাজারে নদের ওপর নির্মিত কালভার্টের পাশে নদের পরিচয় দিয়ে একটি সাইনবোর্ড দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেটিও গায়েব হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, নদের উজানের ১৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। বাকি ৩০ কিলোমিটার খননের একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে খননকাজ শুরু হবে।
এদিকে, নদ পুনরুদ্ধার ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন নদ তীরবর্তী এলাকার মানুষজন। নদ দখলমুক্ত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও ভূমিমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি মানববন্ধন করেছেন তারা।
নদের জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডের অভিযোগ করে স্থানীয় বাসিন্দা আল রোহান বলেন, ‘এই নদ ছোটবেলা থেকে দেখছি। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, নদকে কৃষিজমি দেখিয়ে অনেকে নিজের নামে রেকর্ড করে দখল করেছেন। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, আবার স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এসব দখলদার প্রভাবশালী। তাদের কেউ কেউ নদের জমিতে প্রকল্প দেখিয়ে বড় অংকের লোন নেওয়ার চেষ্টাও করছেন। অবিলম্বে নদ পুনরুদ্ধারের দাবি জানাই আমরা।’
হরিহর নদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হরিহর নদ ঝিকরগাছার কপোতাক্ষ থেকে উৎপত্তি হয়ে আপারভদ্রায় মিলিত হয়েছে। সর্বশেষ এটি তেলিগাতিতে পতিত হয়েছিল। এখন অনেক স্থান ভরাট হয়ে গেছে।’
উজানে নদের ১৫ কিলোমিটার ২০২১ সালের জুন মাসে খনন করা হয়েছে উল্লেখ করে তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বাকি ৩০ কিলোমিটার খননের একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদটি খনন করা হবে।’
নদ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে নদ ভরাট কিংবা দখলের অনুমোদন দিইনি। যদি কেউ দখল করে থাকেন, সেটি অবৈধ। খননের সময় সবকিছু উচ্ছেদ করা হবে।’