X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আন্তর্জাতিক নারী দিবস

‘পুরুষের সমান মজুরি চাইলে কাজ দেবে না’

হেদায়েৎ হোসেন, খুলনা
০৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:০০আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৪

নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা থাকলেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন খুলনার নারী শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে বেশি বৈষম্যের শিকার দিনমজুর, ইটভাঙা ও নির্মাণশ্রমিকরা। এসব নারীশ্রমিক পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি পান। এভাবে বছরের পর বছর জেলার লক্ষাধিক শ্রমিক মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্টরা। পুরুষের সমান মজুরি চাইলে কর্ম হারানোর শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন নারীশ্রমিক।

নারী শ্রমিকরা বলছেন, পরিবারে সচ্ছলতা আনতে দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন তারা। স্বাস্থ্যঝুঁকি আর লোকজনের নেতিবাচক কথা উপেক্ষা করে পুরুষশ্রমিকের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। যেখানে একজন পুরুষশ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ৫০০-৫৫০ টাকা পান, সেখানে একই সময় কাজ করে নারীশ্রমিক পান ৪২০-৪৫০ টাকা। মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে কোনও ব্যবস্থা না থাকায় নীরবে বছরের পর বছর এভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রান্তিক এসব নারীশ্রমিক।

১৮ বছরেও দূর হয়নি মজুরি বৈষম্য

১৮ বছর ধরে দিনমজুরির কাজ করছেন খালিশপুরের আসমা বেগম (৫৫)। ১০০-১২০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেছিলেন। এখন পান ৪২০ টাকা। তবে তার সঙ্গে কাজ করা পুরুষশ্রমিকরা পান ৫০০-৫৫০ টাকা। গত দেড় যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তিনি।

নারী শ্রমিকরা বলছেন, পরিবারে সচ্ছলতা আনতে দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন। তবে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না।

হতাশা প্রকাশ করে আসমা বেগম বলেন, ‘আগে ১২০ টাকা ব্যবধান ছিল। এখন সেই ব্যবধান ৮০ টাকায় নেমেছে। কিন্তু ব্যবধান রয়েই গেছে। সমঅধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরিতে পিছিয়ে নারীরা। কারণ এসব সিদ্ধান্ত পুরুষ দায়িত্বশীলরাই দিয়ে থাকেন। তারা চাইলে মজুরি বৈষম্য দূর হবে। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু কোনও পরিবর্তন আসেনি।’

কম আয়ে সংসার চালানো কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার ১০ জনের সংসার। আয় করে চার জন। সবাই দিনমজুর। একদিন কাজ হলে তিন-চার দিন কাজ থাকে না। ফলে এত কম আয় দিয়ে ১০ জনের সংসার চালানো কঠিন। কোনও টাকা জমাতে পারি না। ফলে যেকোনও বিপদে কিংবা অসুস্থ হলে ধারদেনা করা ছাড়া উপায় থাকে না।’

পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি

মহানগরীর বয়রা বাজার সংলগ্ন মুজগুন্নি সড়কের সংস্কারকাজ চলছে। গত সোমবার সেখানে ৬৫ নারীশ্রমিক ও ৯ পুরুষশ্রমিক কাজ করছিলেন। এখানে ৩০-৭০ বছরের নারীরাও শ্রম দিচ্ছেন।

সড়কের সংস্কারকাজে নিয়োজিত ৭০ বছরের আলেয়া বেগম বলেন, ‌‘খাবারের জোগান না থাকায় এই বয়সে রোদের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। তবে পুরুষের সমান কাজ করেও সমান মজুরি পাই না। ৪০০ টাকা মজুরি পাই। অথচ পুরুষরা ৫০০-৫৫০ টাকা পান। কিছুই বলার নেই।’

৭০ বছরেও বয়স্কভাতা পাইনি উল্লেখ করে আলেয়া বেগম বলেন, ‘এই বয়সে অনেকে বয়স্কভাতা পান। কিন্তু আজ পর্যন্ত বয়স্কভাতার কার্ড পেলাম না।’

আলেয়া বেগমের সহকর্মী শরিফা বেগম (৬০) বলেন, ‘আড়াই টাকায় দিনমজুরির কাজ শুরু করেছিলাম। এখন ৪৫০ টাকা পাই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার উন্নতি নেই। মজুরির চেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। তাই এই আয়ে টিকে থাকা কষ্টকর।’

একজন পুরুষশ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ৫০০-৫৫০ টাকা পান, সেখানে নারীশ্রমিক পান ৪২০-৪৫০ টাকা

পুরুষের সমান মজুরি চাইলে কাজ দেবে না

পুরুষের সমান মজুরি চাইলে কাজ দেবে না উল্লেখ করে নির্মাণশ্রমিক নিপা আক্তার (৫৩) বলেন, ‘কাজের জন্য ফুলবাড়ি গেট থেকে সকালে বের হয়ে মুজগুন্নি সড়কে আসতে হয়। যাতায়াতে ৫০-৮০ টাকা খরচ হয়। ৪৫০ টাকা মজুরি পাই। বাড়িতে ৩৫০-৩৮০ টাকা নিতে পারি। কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়। তবে পুরুষের সমান মজুরি চাওয়া যায় না, চাইলে কাজ দেবে না। তাই চুপ থেকে যা পাই তা নিয়ে ঘরে যাই।’

যে অজুহাতে কম মজুরি

মুজগুন্নি সড়কের সংস্কারকাজে শ্রমিক সরবরাহ করছেন মো. মিলন হোসেন। মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিকরা সড়কে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেন। এটি সহজ কাজ। তবে সড়কে আটকে থাকা মাটি ও বালু খুঁচিয়ে তোলার জন্য পুরুষশ্রমিক রয়েছেন। নারীরা দৈনিক ৪২০-৪৫০ আর পুরুষরা ৫০০-৫৫০ টাকা পান। মূলত পুরুষের কাজ একটু ভারী হওয়ায় মজুরির ব্যবধান। নারীরা কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে পারেন না। ভারী কাজ করতে না পারায় মজুরি কম পাওয়ার আরেকটি কারণ।’

নারী অধিকার সম্পর্কে জানেন না অনেকে

১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও নারী অধিকার সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই মহানগরীর বাসিন্দা স্বপ্না রানির। তিনি বলেন, ‘১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর বিয়ে হয়। স্বামীর সংসারে আসার পর অভাবের কারণে সাত বছর ধরে দিনমজুরির কাজ করছি। নারী অধিকার ও দিবস সম্পর্কে আমার তেমন জানাশোনা নেই। এইটুকু বুঝি বাঁচতে হলে কাজ করে আয় করতে হবে। তা না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। মজুরি সমান নাকি কমবেশি, সে হিসাব করি না। কাজ পেলেই ছুটে যাই, কারণ কাজ করলে কিছু টাকা পাওয়া যায়। সে টাকায় চলে চার জনের সংসার।’

অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন করার কথা বলছেন নারী অধিকারকর্মীরা

নারীশ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলন এখনও চলছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা মাসাস-এর নির্বাহী পরিচালক ও নারী অধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট শামীমা সুলতানা শীলু। তিনি বলেন, ‘সরকারও চায় বৈষম্য দূর হোক। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এখন আর আন্দোলন করে কাজ হবে না। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন দরকার। সরকারের উচিত মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে আইন করা। অনেক আইন আছে, সেসব আইন এক্ষেত্রে কাজে আসছে না। তাই সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন করা প্রয়োজন।’ 

পুরুষের সঙ্গে কাজ করছেন এক নারীশ্রমিক

অ্যাডভোকেট শামীমা সুলতানা শীলু আরও বলেন, ‘চা ও ধূমপানের সুযোগ পান পুরুষ শ্রমিকরা। কিন্তু নারীরা একটানা কাজ করেন। কাজে ফাঁকি দেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম দেন। অথচ মজুরি পান কম।’

সচেতনতা জরুরি

মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে নারী শ্রমিকদের জোটবদ্ধ হওয়া দরকার বলে জানালেন খুলনা সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাজেদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘কাজ না পাওয়ার ভয়ে কম মজুরি পেলেও তা প্রকাশ করেন না নারী শ্রমিকরা। একপ্রকার বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে কাজ করে যান। এজন্য আগে নারীদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতিক মতাদর্শের কারণেও নারীরা বিভক্ত। ফলে অনেক যৌক্তিক আন্দোলনে সব দলের সমর্থন থাকে না। এটিও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়।’

এ নিয়ে প্রথমে নারীদের মানসিকতার পরিবর্তন এবং সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন প্রফেশনাল উইমেন ক্লাব খুলনার সেক্রেটারি ও সম্মিলিত নারী অধিকার সুরক্ষা ফোরামের সদস্য শিলভি হারুন।

তিনি বলেন, ‘সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সব নারীকে একসঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাদের দুর্বলতার কারণেই সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। মানসিকতার পরিবর্তন এবং সচেতন না হওয়ায় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

/এএম/
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
সর্বশেষ খবর
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত