খুলনা-মোংলা রেলপথ চালুর টাইমলাইন রয়েছে আসন্ন সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এখন সেপ্টেম্বরের আগেই এই রেলপথ চালুর তোড়জোড় চলছে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ। এরইমধ্যে প্রকল্পের ৯৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত সময়ের আগেই এ রেলপথ চালুর পরিকল্পনা বাংলাদেশ রেলওয়ের।
সম্প্রতি কাজ পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ রেলপথ চালু হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি খুলনা-মোংলা রেলপথের কাজ এখন একেবারেই শেষের পথে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই ফুলতলা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেল চালুর লক্ষ্যে এখন শেষ মুহূর্তের তোড়জোড় চলছে। সরেজমিন খুলনার আড়ংঘাটা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রেলপথের পাথর সরিয়ে পরিষ্কার করার কাজ করছেন শ্রমিকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। জমি অধিগ্রহণ, রেললাইন ও রেল সেতু নির্মাণসহ সমগ্র প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল তখন ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এরপর পাঁচবার সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এরই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
নানা জটিলতা কাটিয়ে এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় এই রেলপথ। এই প্রকল্পের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রূপসা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রেলসেতুর কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার পথ হলেও স্টেশনগুলোর ডাবল লাইন হিসাব করে এই প্রকল্পে রেলপথ বসবে ৯১ কিলোমিটার। এরইমধ্যে প্রকল্পের ৮১ কিলোমিটার রেলপথ বসানো সম্পন্ন হয়েছে। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত মোট ৯টি প্ল্যাটফর্ম রাখা হয়েছে, যেগুলোর নির্মাণ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া শেষ হয়েছে ১০৭টি ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাস নির্মাণকাজও। গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের ফুলতলা এলাকায় পরীক্ষামূলক ইঞ্জিনও চালানো হয়েছে। সব মিলয়ে এ পর্যন্ত খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৭ শতাংশ। শেষ সময়ে এখন বাকি অংশের রেলপথ এবং সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলছে।
এদিকে সম্প্রতি দিনব্যাপী খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান। আগামী সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হওয়ার আশা তার। মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের নির্ধারিত সময় ছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা। তবে আমরা চেষ্টা করছি তার আগেই শেষ করতে। এরইমধ্যে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি, সেখানে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছি। তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দ্রুত কাজ শেষ করার। আশা করছি সেপ্টেম্বরের আগেই এই রুটি রেল চলাচল করবে।
এদিকে খুলনার মানুষের দীর্ঘদিনের এই দাবি বাস্তবায়নে দারুণ খুশি এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের আশা, রেলপথটি চালু হলে সেখানকার অর্থনীতিতে নতুন দ্বার খুলবে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক জেডএ মাহমুদ ডন বলেন, ‘যেকোনও অঞ্চলের উন্নয়নের মূল শর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। আমাদের এই রেলপথ চালু হলে সেই উন্নয়নের পথে আমরা এগিয়ে যাবো। এ রেলপথ চালু হলে ভারত-নেপাল-ভুটান মোংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রফতানি করবে। তাতে সরকার রাজস্ব পাবে। মোংলা বন্দরের গতিশীলতা বাড়বে। এতে এই অঞ্চলে আরও বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে খুলনা অঞ্চল দেশের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’
মোংলা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুলতান হোসাইন খান বলেন, ‘আমরা যারা মোংলা বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা করি, তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি এই রেলপথের জন্য। এই রেলপথ অল্প দিনেই চালু হবে জানতে পেরে ভালো লাগছে। রেলপথটি ব্যবহার করে পণ্য আমদানি ও রফতানিতে খরচ অনেক কম হবে ব্যবসায়ীদের। তাতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহন ও খরচের প্রতিযোগিতায় আমরা এগিয়ে থাকবো। সব মিলিয়ে আমরা দারুণ আশাবাদী।
খুলনা-মোংলা রেললাইনের প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পের কাজ এ বছরের জুনের মধ্যেই শেষ হবে। এরপর আগস্ট থেকে এ রেললাইনে ট্রেন চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’ প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘খুলনা-মোংলা প্রকল্পে সামান্য কিছু কিলোমিটার রেললাইন ও পূর্ত বিভাগের ট্রাক নির্মাণ প্যাকেজের (ডব্লিউডি-১) কাজ বাকি রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপসা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতুর নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে।’
জানা গেছে, ২০১০ সালে তিন বছর মেয়াদে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কয়েকবার নকশা পরিবর্তন হওয়ায় এর মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী আহমদ হোসেন মাসুম জানান, প্রকল্পের প্রধান কাজ ছিল ৭৭৬ দশমিক ৬৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ, খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ২১ দশমিক ১১ কিলোমিটার লুপ লাইন, আটটি রেলওয়ে স্টেশন তৈরি, ৩১টি ছোট-বড় সেতু নির্মাণ, ১১২টি কালভার্ট, রূপসা নদীর ওপর ৭১৬ দশমিক ৮০ মিটার সেতু নির্মাণ, রূপসা সেতুর দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) নির্মাণ, ২০০ মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণ করা।
ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় খুলনা-মোংলা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো। ট্র্যাক লিংকিং করছে আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।