X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পেনশনের টাকা নিয়ে গেছে একমাত্র ছেলে, বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে ঈদ কাটলো নিঃস্ব মায়ের

তৌহিদ জামান, যশোর
১৩ এপ্রিল ২০২৪, ২১:১১আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:৩৪

‘ছেলেটা কলেজে পড়াকালে ফটোগ্রাফি করতো। ফটো বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছিল। ঈদের আগের দিন সেই টাকায় গরুর মাংস কিনে এনে আমাকে বলেছিল, এটা আমার টাকায় কেনা। আমি রাগ করে বলেছিলাম, তাহলে তো আমি খাবো না। কারণ এতদিন নিজের টাকায় সবকিছু কিনে তোকে খাওয়ালাম, পরালাম, বড় করলাম; কই, আমি তো কখনও এমন কথা বলিনি। আমার কথা শুনে অপরাধবোধ কাজ করলো তার। ভুল বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার সরি বলেছিল। নিজের আদরের সন্তান, তাই ক্ষমা করে দিলাম।’

কথাগুলো বলতে বলতে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন রিজিয়া খাতুন। তবে সন্তানের স্মৃতি মনে করে শেষ পর্যন্ত চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলেন, ‘আমি তো মা। সেদিন ক্ষমা না করে পারলাম না। অথচ তার নির্মমতায় আজ বৃদ্ধাশ্রমে আমি। এখন আমাকে লালনপালন করলে সন্তানের লস। এই যে ঈদের দিন একা একা খাই, নিঃসঙ্গ বসে থাকি—এমন ঈদ আমার সন্তানের জীবনে কখনও না আসুক। আমি চাই না আমার সন্তান আমাকে ভেবে কষ্ট পেয়ে কান্না করুক। সব দুঃখ ভুলে এখানে পড়ে আছি, ভালো এবং সুস্থ আছি। ছেলেটা বাবা হয়েছে। তার সন্তানের বয়স পাঁচ বছর। তারা ভালো থাকুক।’

রিজিয়া খাতুন (৬০) যশোরের কেশবপুর এলাকার বাসিন্দা। দুই বছর ধরে থাকছেন যশোর শহরের মুজিব সড়কের সেবাধর্মী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রোটারি কেনায়েত আলী আনোয়ারা খাতুন ওল্ডহোমে (বৃদ্ধাশ্রম)। তিনি পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) পদে যশোরের বিভিন্ন উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি করেছেন। ২০১৭ সালে চাকরি জীবনের ইতি ঘটে। তারপর থেকে ছেলেকে নিয়ে নিজ বাড়িতে থাকতেন। চাকরি জীবনের শেষ সম্বল পেনশনের টাকা পেয়ে ছেলেকে নিয়ে হজ করেছেন। বাকি টাকা-পয়সা যা ছিল, সেগুলো নিয়ে গেছে ছেলে। এরপর ভরণপোষণ চাওয়ায় তাকে পিটিয়ে আহত করেছিল ছেলে ও পুত্রবধূ। এতে মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়। এ অবস্থায় চিকিৎসা দূরে থাক উল্টো মায়ের সঙ্গে সবসময় খারাপ আচরণ করতে থাকে তারা। তাই ঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। 

সন্তানের ঈদ স্মৃতি মনে করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না রিজিয়া খাতুন

বিগত ঈদের স্মৃতি মনে করে রিজিয়া বলেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর সন্তানকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছি। ঈদের সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সন্তানকে গোসল করাতাম। নতুন জামা পরিয়ে চুল আঁচড়ে দিতাম। সেমাই ও পিঠা মুখে তুলে খাওয়াতাম। পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে নামাজে পাঠাতাম। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরলে আবার ঈদের সালামি দিলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতো। আজ আমার সেই সন্তান খোঁজ নেয় না।’

এবার ঈদের দিন বৃদ্ধাশ্রমে পায়েস-সেমাই, মুরগির মাংস রান্না হয়েছে। রিজিয়া তা খেয়েছেন। খাওয়ার সময় বারবার সন্তানের কথা মনে পড়েছে। একই শহরে বসবাস, তবু সন্তানের কাছ থেকে কত দূরে। এই আমার বিষাদের ঈদ উল্লেখ করে বলেন, ‘সন্তান জন্মের পরপরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। ছেলেটাকে মায়ের কাছে রেখে চাকরির জন্য এই উপজেলা, ওই উপজেলায় দৌড়াতে হয়েছিল। খুব একটা ছুটি মিলতো না। হাসপাতালে রোগীর সেবা করে কাটাতে হয়েছে বেশিরভাগ সময়। অনেক সময় ঈদের পরদিন ছুটি পেলে সন্তানের কাছে যেতাম। জড়িয়ে ধরতো। ঈদের নতুন জামা-কাপড়; কোনও কিছুরই ঘাটতি রাখিনি তার।’

এদিকে, প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর দ্বিতীয় বিয়ে এবং সেই স্ত্রীর সন্তান বাড়িঘর লিখে নেওয়ায় মনের দুঃখে ঘর ছাড়েন শাহজাহান হাওলাদার (৬৪)। তিনি যশোর শহরের শঙ্করপুর এলাকার বাসিন্দা। তার প্রথম ঘরের ছেলে এবং নাতিরা এখনও খোঁজখবর নেয়। কিন্তু মনের কষ্টে ও লজ্জায় তাদের সঙ্গে থাকেন না। চার বছর ধরে থাকছেন একই ওল্ডহোমে। রিজিয়া খাতুন এবং শাহজাহান হাওলাদারের মতো এই বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন ১০ নারী-পুরুষ। এর মধ্যে ছয় জন নারী এবং চার জন পুরুষ।

রোটারি কেনায়েত আলী আনোয়ারা খাতুন ওল্ডহোম

ছয় নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই সন্তান-পুত্রবধূর অত্যাচারে এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তানের কথা মনে পড়লেও নির্যাতনের ভয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। এখানে একসঙ্গে গল্প করে, খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডার মধ্য দিয়ে দুঃখ-কষ্ট ভুলে আছেন। মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয়। তখন একা বসে ভাবেন। অন্যরা সান্ত্বনা দেন। ঈদের দিন সন্তান-পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু সে সুযোগ নেই। এবার ঈদের ভালো খাবার ও শাড়ি উপহার পেয়েছেন। এখানে সবাইকে সবার আপন মনে হয়। থাকার পরিবেশ খুব সুন্দর। সবাই ভালো এবং সুস্থ আছেন।

চার পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে নামাজ আদায় করেছেন। ফিরে এসে পায়েস-সেমাই খেয়েছেন। পাশাপাশি রুটি-তরকারিও খেয়েছেন কেউ কেউ। দুপুরে পোলাও, খাসির মাংস, দই-মিষ্টি খেয়েছেন। বিকালে বের হন পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। ফিরে রাতেও একই রকম খাবার খেয়েছেন। প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও নতুন পোশাক পেয়েছেন। এর মধ্যে ছিল লুঙ্গি, শার্ট ও পাঞ্জাবি। সেগুলো পরে ঈদ করেছেন তারা।

ঈদের দিন দুপুরে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ফাতেমা আনোয়ার

ওল্ডহোমের বাসিন্দাদের জন্য রান্নাবান্না করেন বিথীকা রায়। তার বাড়ি ওল্ডহোমের কিছুটা দূরে ষষ্টীতলা পাড়ায়। স্বামী শারীরিকভাবে অসুস্থ, বাড়িতেই থাকেন। এখানে চার বছর ধরে রান্নার কাজ করছেন। বিথীকা বলেন, ‘এখানে যারা আছেন, তারা বয়সে আমার চেয়ে বড়। কিন্তু প্রত্যেকে আমাকে মা বলে ডাকেন। আমিও তাদের সন্তানের মতো লালনপালন করি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে এখানে আসি। নাশতা বানাই, দুপুরের খাবার রান্না করে তাদের খাইয়ে ২টা আড়াইটার দিকে বাড়ি যাই। আবার সন্ধ্যার আগে এসে রাতের রান্না করে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাত ৮টার দিকে বাড়ি ফিরি। গত চার বছরে কোনও ছুটি কাটানো হয়নি আমার।’

এখানের বাসিন্দা এবং ওল্ডহোমের তদারকির দায়িত্বে থাকা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘শহরের বাসিন্দা যশোর সরকারি এমএম কলেজের সাবেক জিএস এএএম জাকারিয়া মিলন ওল্ডহোমের সবকিছু দেখভাল করেন। তার বাবা-মায়ের নামে এটি চালান। তিনি ব্যাংকার ছিলেন। প্রায় দেড় বিঘা জমি রয়েছে এখানে। সম্প্রতি এক বিঘার মতো পুকুরটি যশোরের জেলা প্রশাসক ওল্ডহোমের তত্ত্বাবধানে দিয়েছেন। এখানে মাছচাষ করা হচ্ছে। মাসে এখানে ৬০-৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এখানে তিন জন কর্মচারী রয়েছেন। মাস দুয়েক হলো শক্তি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা এখানকার বাসিন্দাদের জন্য ডিম ও গুঁড়ো দুধের ব্যবস্থা করেছে। তাদের কাছ থেকে ওষুধও পাচ্ছি। সবমিলিয়ে ভালোভাবেই চলছে ওল্ডহোমটি। এখানের বাসিন্দারা ভালো আছেন।’

বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের উপহার দিয়েছেন ফাতেমা আনোয়ার

ঈদের দিন দুপুরে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ফাতেমা আনোয়ার। এবার যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছেন তিনি ও তার মেয়ে আনিকা রহমান। বাড়ি থেকে পোলাও, মুরগি, খাসির মাংস, সেমাই, দই-মিষ্টি নিয়ে যান তারা। এর আগে সেখানকার ছয় নারী ও তাদের রাঁধুনিকে শাড়ি এবং পাঁচ পুরুষ ও কেয়ারটেকারসহ ছয় জনকে পাঞ্জাবি উপহার দেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রায় দুই ঘণ্টা তাদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেন।

এ বিষয়ে ফাতেমা আনোয়ার বলেন, ‘প্রিয়জনদের কাছ থেকে আলাদা থাকা বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মায়ের সঙ্গে এবার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন করলাম।’

/এএম/
সম্পর্কিত
ফিতরা-জাকাতের নামেও প্রতারণা
আড়াই শতাধিক মানুষের তৃষ্ণা মেটালেন জবি শিক্ষার্থীরা
ঈদের ছুটি শেষে ভারত থেকে ফিরছেন যাত্রীরা, ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে