X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা ছিল না বই কেনার, গড়লেন ৫টি পাঠাগার

বিশ্বজিৎ দেব, জামালপুর
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:১১

বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানের রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। মূলত জ্ঞানের আধার হলো বই, আর বইয়ের আবাসস্থল হলো গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। একটি জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। যদিও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রন্থাগার নেই বললেই চলে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বই ছাড়া অন্যান্য বই পড়ার সুযোগও নেই শিক্ষার্থী ও তরুণদের। এ অবস্থায় নিজ উদ্যোগে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘জ্ঞানের বাতিঘর’ স্থাপনের কাজ করে যাচ্ছেন কলেজছাত্র আতিফ আসাদ (২১)। এরই মধ্যে পাঁচটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মধ্যে তিনটি স্টেশন গ্রন্থাগার। বাকি দুটির একটি তার বাড়িতে অন্যটি বাড়ির পাশের বাজারে।

আসাদ জামালপুরের সরিষাবাড়ীর ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়ার গ্রামের মো. আফজাল হোসেন ও জয়নব বিবি দম্পতির সন্তান। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। 

আসাদের জীবন যেমন সংগ্রামী তেমনি উদ্যমী। বাবা সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় মায়ের সঙ্গে নকশি কাঁথা তৈরি করেন। পাশাপাশি ধানকাটা শ্রমিক, দিনমজুরি, রাজমিস্ত্রি ও রডমিস্ত্রি ও শ্রমিকের কাজ করেছেন। বিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন এসব কাজ করতেন। এখনও এসব কাজ করে সংসারে জোগান দিচ্ছেন। বর্তমানে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স প্রথমবর্ষে অধ্যয়নরত আসাদ।

আরও পড়ুন: গ্রন্থাগারে বই আছে, নেই পাঠক!

প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রন্থাগার স্থাপনের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আতিফ আসাদ বলেন, ‘যেখানে লেখাপড়ার খরচ জোগাতে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়, সেখানে টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য আছে কতজনের? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বই ছাড়া অন্যান্য বই পড়ার সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের। অনেক শিক্ষার্থী গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বইয়ের কথাও জানে না। পাশাপাশি যুব সমাজ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন। মাদকের নেশায় ডুবে যাচ্ছেন। মূলত এসব কথা চিন্তা করেই বিনামূল্যে বই পড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করি।’

কলেজশিক্ষার্থী আতিফ আসাদের ইস্টিশন পাঠাগার

প্রথম গ্রন্থাগারের যাত্রা

আসাদ বলেন, ‘২০টি বই দিয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রন্থাগারের কাজ শুরু করি। কিন্তু ঘর কিংবা দোকান ভাড়া নিয়ে গ্রন্থাগার চালুর টাকা আমার ছিল না। তাই ভাবলাম যেহেতু শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়ানোই আমার মূল উদ্দেশ্য সেখানে অবকাঠামো বাধা হতে পারে না। এভাবেই আমার বাড়িতে যাত্রা শুরু হলো প্রথম গ্রন্থাগারের।’

নিজের সংগ্রামী অতীতের কথা উল্লেখ করে আতিফ আসাদ বলেন, ‘টাকার অভাবে আমি ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারিনি। বই, গাইড কিনতে পারিনি। ভালো কোনও শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারিনি। এই কষ্টগুলো ছোটকাল থেকেই আমার বিবেককে নাড়া দিতো। তখন থেকেই ভাবতাম, সমাজে সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার আলো দরকার। কারণ আমার মতো বহু মানুষ আজও শিক্ষা ও নানা সুবিধাবঞ্চিত। তাদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরণে বড় ভাই মিলনকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়ির ঘরের বারান্দায় পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ২০টি বই নিয়ে গ্রন্থাগার চালু করি। বই সংরক্ষণের জন্য বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে কিছু পরিত্যক্ত কাঠ দিয়ে একটা বুকশেলফ তৈরি করি।’ 

আরও পড়ুন: সাড়ে ৩ হাজারের বেশি সদস্যের গ্রন্থাগারে চাঁদা দিয়েছেন ৫০ জন

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক কলহের জেরে আমার বড় ভাই মিলন; যিনি গ্রন্থাগারের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আজ তার নামেই এই গ্রন্থাগারের নামকরণ করেছি ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। এখন এই নামের মাঝেই ভাইকে খুঁজে পাই।’

পাঠাগারে বই সাজিয়ে রাখছেন আসাদ

গ্রন্থাগারের জন্য বই সংগ্রহ

আসাদের ভাষ্য, ‘প্রথমে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে গ্রন্থাগারে বইয়ের সংগ্রহ বাড়ানোর কাজ করি। পাশাপাশি পাঠকদের নতুন বই দেওয়ার চেষ্টা করি। এই উদ্যোগের কথা ছড়িয়ে পড়লে গ্যাসটন ব্যাটারিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কে এইচ মালেক গ্রন্থাগারের জন্য ১০০টি বই দেন। পাশাপাশি ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ বই কেনার জন্য কিছু টাকা উপহার দেন। এতে গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়। পাঠকরা ভালো বই পড়ার সুযোগ পান।’ 

গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা

এভাবে ধীরে ধীরে আসাদের গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যায়। পরে এসব বই সংরক্ষণের জন্য বুকশেলফ তৈরির টাকা দেন কে এইচ মালেক। ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী ও প্রবাসীদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া বইগুলো নিয়ে আজ গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা দুই হাজার।’

গ্রন্থাগারের পাঠক সংখ্যা

আসাদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম গ্রন্থাগারে প্রতিদিন ১০০ জন পাঠক বই পড়তে আসেন। আসাদের অনুপস্থিতিতে পাঠকদের বই দিয়ে সহায়তা করেন মা জয়নব বিবি। ফলে বই পড়তে এসে কাউকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় না। 

বাড়ির পাশের দোকানে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন আসাদ

বইয়ের ফেরিওয়ালা আসাদ

পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন আসাদ। কেউ যদি ১০-১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও ফোন করে বই চান, তাহলে বাইসাইকেল চালিয়ে তার বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন। তার কাছে বই চেয়ে পাননি এমন অভিযোগ নেই কারও।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি

‘গ্রন্থাগারের শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জিং ছিল’ উল্লেখ করে আসাদ বলেন, ‘শুরুতে গ্রন্থাগার কি জিনিস তা বুঝতেন না প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন। এজন্য বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতাম। বই রাখার জায়গা না থাকায় অনেকে আমাকে নিয়ে উপহাস করতেন। কেউ কেউ পাগলও বলতেন। এতে আমার কোনও কষ্ট লাগতো না। তাদের সেসব কথায় কান দিইনি। দিন দিন পাঠক বাড়তে দেখে আমার কষ্ট দূর হয়ে গেছে। অবসর সময়টুকু মানুষের জন্য ব্যয় করছি। সমাজকে বই দিয়ে আলোকিত করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছি।’ 

পাঠাগারে বই পড়ছেন পাঠকরা

তিনি বলেন, ‘গ্রন্থাগারের সব বই উপজেলা সদরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসে। সেখান থেকে বই নিয়ে ১০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে গ্রন্থাগারে আনতে হয়। শুরুর দিকে অনেকেই মনে করতেন গ্রন্থাগারে বই বিক্রি হয়। পরে তাদের সেই ভুল ভেঙে যায়। এখন তারাও বই পড়তে আসেন।’ 

আসাদ বলেন, ‘কোনও কারণে যদি বাড়িতে না থাকি তখন আমার মা পাঠকদের পড়ার বই দেন। আমাকে মাঝেমধ্যে সংসারের খরচ জোগানোর জন্য দূরে দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজে যেতে হয়। তখন মা-ই গ্রন্থাগার ও পাঠকদের দেখাশোনা করেন।’

‘ইস্টিশন পাঠাগারের’ যাত্রা

২০২০ সালের ২১ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো রেলওয়ে স্টেশনভিত্তিক বই পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে ‘ইস্টিশন পাঠাগারের’ যাত্রা শুরু হয়। সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনে পাঠাগার দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন আসাদ। রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগমকে ঘিরে রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ইস্টিশন পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেন আসাদ। এরই মধ্যে সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন, তারাকান্দি রেলওয়ে স্টেশন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে তিনটি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন আসাদ। পাশাপাশি বাড়ির পাশে আরেকটি পাঠাগার গড়েছেন। সেখানেও প্রতিদিন পাঠকরা বই পড়তে যাচ্ছেন। এ নিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের সংখ্যা পাঁচটি। 

নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের সামনে আসাদ

আরও পড়ুন: রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি ভবন পরিত্যক্ত, অধিকাংশ অংশ দখল

সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দেখা গেছে, কয়েকজন তরুণ রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে বসে বই পড়ছেন। আসাদের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন তারা।

নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আসাদ বলেন, ‘সারাদেশে ১০০টি রেলওয়ে ইস্টিশন পাঠাগার স্থাপনের স্বপ্ন দেখি। জানি না কতদূর যেতে পারবো।’

/এএম/
সম্পর্কিত
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসগণগ্রন্থাগারে গণফাটল, পাঠকের নিত্যসঙ্গী আতঙ্ক
উচ্চশিক্ষার রেফারেন্স বই চেয়ে চেয়ে আর কতদিন?
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের ৬ বছর, কী প্রভাব পড়েছে সমাজে
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!