গাইবান্ধায় পুলিশের গুলি ও সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত সাঁওতালদের কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে, হাতে হাতকড়া পড়িয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশি পাহারায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তারা। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তাদের। গত ৬ নভেম্বর রবিবার গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকল এলাকার মাদারপুর ও জয়পুরে সাঁওতালদের পল্লীতে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
শুক্রবার দুপুর ৩ টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১৫ নম্বর সার্জিকাল ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত চরণ সরেন বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তার কোমরে রশি দিয়ে হাসপাতালের বেডের সঙ্গে বেঁধে রাখা, হাতেও রয়েছে হাতকড়া। পাশেই দুই পুলিশ সদস্য তাকে পাহারা দিচ্ছেন।
চরন সরেন জানান, ‘৬ নভেম্বর রবিবার পুলিশের সহায়তায় সন্ত্রাসীরা বাবা-দাদার ভিটে থেকে তাদের জোর করে উচ্ছেদ করেছে। তাদের বেদম মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি ঘরের মধ্যে থাকা মালামাল পর্যন্ত বের করতে দেওয়া হয়নি। চোখের সামনে মালামাল লুট করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাধা দেবার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে। এতে তার দু’পায়ে একাধিক গুলি লেগেছে।’
তিনি আরও জানান, গুরুতর অবস্থায় ওই দিনই তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার তিনি যখন ঘুমিয়েছিলেন, তখন পুলিশ এসে তার কোমড়ে রশি দিয়ে বাঁধে এবং হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখে। পাহারায় থাকা পুলিশের দুই সদস্য জানিয়েছে আমরা নাকি সন্ত্রাসী, আমাদের নামে মামলা হয়েছে। ’
চরণ সরেনের স্ত্রী পানি মুরমু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বামীর চিকিৎসা করানোর মতো কোনও অবলম্বন নেই। ধার-দেনা করে আর মানুষের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা চলছে। আমরা মার খেলাম, আমাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। মালামাল লুট করা হলো। গুলি করে আহত করা হলো। আর এখন আমার গুলিবিদ্ধ স্বামীর কোমরে রশি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। এটা কোন ধরনের বিচার ।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশে আইন নেই। আইন হচ্ছে পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের জন্য।’ এসময় তিনি তাদের ওপর তাণ্ডব চালানোর ঘটনায় দায়ীদের গ্রেফতার করার দাবিও জানান।
অন্যদিকে, হাসপাতালের ৩১ নম্বর অর্থপেডিকস ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন বিমল কিসকো ঘুমিয়ে রয়েছেন। তীব্র যন্ত্রণার কারণে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান তার স্ত্রী চিচিলী কিসকো।
কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সালাম জানান, ‘আহত বিমলের দুই পায়ের অবস্থা ভালো নয়। তবুও তার কোমড়ে রশি দিয়ে জানালার গ্রিলের সঙ্গে রশিটি বেঁধে রাখা হচ্ছে। তার হাতেও হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে পাহারা দিচ্ছে পুলিশের এএসআই আসাদ।’
বিমলের স্ত্রী চিচিলী জানান, তার স্বামীর চিকিৎসা করানোর মতো কোনও টাকা তাদের কাছে নেই। মানুষের সাহায্য নিয়ে কোনও রকমে চিকিৎসা চলছে। এতে চিকিৎসা ব্যহত হচ্ছে। একজন গুরুতর অসুস্থ, যার দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ তার কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে, হাতে হাতকড়া পড়ানো কী ধরনের মানবিকতা বলেও প্রশ্ন করেন তিনি।
কর্তব্যরত পুলিশের এএসআই আসাদ জানান, তারা রংপুর পুলিশ লাইন থেকে দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন। আসামি হওয়ায় হাতে হাতকড়া পড়ানোর নিয়ম রয়েছে। যদি পালিয়ে যায়, সে কারণে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী কারণে মামলা হয়েছে তা জানা নেই এএসআই আসাদের।
এছাড়া, পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত দ্বিজেন টুডোকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে চক্ষু বিভাগের চিকিৎসক ডা. শম্পা জানিয়েছেন। তিনি জানান, ‘দ্বিজেন টুডোর চোখের ওপরের অংশে গুলি লেগেছে। তার অবস্থা ভালো নয় , এজন্যই তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘পুলিশ ও মাস্তানদের হামলায় সাঁওতালদের দুজন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চারজনকে ওখানকার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। তাদেরতো এমনিতেই শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তার মধ্যে কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে ও হাতে হাতকড়া পড়ানোর বিষয়টি নিন্দনীয়। এসব পরিহার করা উচিত।’
/এমও/ এপিএইচ/