সুনামগঞ্জের খরচার ও হালির হাওরে বানের পানি থইথই করছে। বসতঘর থেকে গোয়ালঘর সর্বত্র পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়ির আঙিনা ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। আবার কোনও কোনও বাড়ির উঁচু ভিটেমাটি ভেঙে যাচ্ছে উত্তাল ঢেউয়ে। বসত ভিটে রক্ষায় বাঁশের খুঁটি পুতে দিচ্ছেন বাড়ির চারপাশে। ঘরের ভেতরে চৌকিতে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন অনেকে। কেউ কেউ পরিবার ও গবাদি পশুসহ আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। দুর্গম হাওর এলাকায় এখনও পৌঁছায়নি পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওর এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবারের সংকট। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় খেটে খাওয়া মানুষেরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। ত্রাণই একমাত্র ভরসা তাদের।
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। রবিবার (১৩ জুলাই) বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্গম হাওর ঘুরে এলাকা এ চিত্র দেখা যায়।
নৌকা বা স্পিডবোট গেলে লোকজন এগিয়ে আসেন ত্রাণ আসছে ভেবে। ঘরে চাল থাকলেও রান্নাঘর ডুবে যাওয়ায় রান্না করে খাওয়ার উপায় নেই। থেমে থেমে বর্ষণের কারণে গ্রামের লোকজন কর্মহীন অবস্থায় ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছেন। জামালগঞ্জ উপজেলা বেহেলী ইউনিয়নের রাধানগর, হরিনাকন্দি, ইনাতনগর, হাওরিয়া আলীপুর, বদরপুর, বেহেলি, ইসলামপুর, রহমতপুর, নিতাইপুর, শিবপুর, রাধানগর নুতনহাটি, হরিনাকন্দি নুতনহাটি, গোপালপুর, চন্ডীপুরসহ অনেক গ্রাম ঘুরে দেখা যায় দুর্গত মানুষেরা ত্রাণের প্রহর গুনছেন।
বেহেলি ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল হাসিমের অভিযোগ, দুর্গম হাওর এলাকা লোকজন ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার পাচ্ছেন না। দুর্গম এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়ে যেতে চান না।
ইমরুল হাসান বলেন, যারা যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে সুবিধাজন অবস্থানে রয়েছেন তারাই কেবর ত্রাণ পাচ্ছেন। দুর্গম হাওর এলাকায় একবারে বেশি পরিমাণ ত্রাণ দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
হাওরিয়া আলীপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামের একপাশে নদী, অন্যপাশে হালির হাওর। হাওরে বাতাস হলে উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে তাদের বসত বাড়ির মাটি ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়।’
খলিল মিয়া বলেন, ‘দুই দফা বন্যায় হাওরের মানুষ কষ্টে রয়েছেন। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ছোট ছোট শিশুরা পরিবারের লোকজনের অগোচরে পানিতে পড়ে ডুবে মারা যাচ্ছেন।’
শাহপরান মিয়া বলেন, ‘পানি নেমে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। কবে যে নামবে তাও জানা নেই। বসতঘরগুলোর চারপাশে অথৈই পানি। দিনমজুর, জেলে ও শ্রমজীবী নারী পুরুষ সবাই বেকার হয়ে আছেন। কাজের জন্য কোথাও যেতে পারছেন না। হাতে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আকবর হোসেন বলেন, বন্যায় মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন শ্রমজীবী লোকজন। আয় নেই, আবার ঘরে খাবার নেই। এজন্য গ্রামভিত্তিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া এবং শুকনো খাবার বেশি পরিমাণে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রনজিত সরকার বলেন, ‘আমি ২০টি গ্রাম ঘুরে এসেছি। এসব এলাকার অনেক মানুষ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। পুরো হাওর এলাকায় এখন দুর্যোগ নেমে এসেছে। মানুষ খাবার কষ্টে আছেন। এজন্য সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা আরও বাড়ানো উচিত।’
বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারমান অসীম তালুকদার বলেন, বেহেলী ইউনিয়ন পুরোটাই বন্যাকবলিত। এই ইউনিয়নের দুর্গম হাওর এলাকা রয়েছে অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এখানে বেশি পরিমাণ ত্রাণ ও শুকনো খাবারের প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী শুকনো খাবার ও ত্রাণ দেওয়া যাচ্ছে না। শনিবার দুর্গম এলাকাগুলোতে কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সোমবার (১৩ জুলাই) আরও ত্রাণ নিয়ে যাওয়া হবে। ত্রাণ ও শুকনো খাবারের প্যাকেটের স্বল্পতার বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, ‘বেহেলী ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। বন্যার শুরু থেকেই ত্রাণ ও শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। তবে এটির পরিমাণ আরও বাড়ানো হলে এ সমস্যা আর থাকবে না। উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে প্রশাসন। প্রতিটি উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেউ যাতে বন্যায় কষ্ট না করে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১১ উপজেলা ও চারটি পৌরসভার ৩৫২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার ২৯৭ পরিবারের ৯ হাজার ১৯৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। সদর বিশ্বম্ভরপুর তাহিরপুর জামালগঞ্জ ছাতক দোয়ারাবাজার শাল্লা দিরাই দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ধর্মপাশা জগন্নাথপুর উপজেলা ও চারটি পৌরসভার ৯৮ হাজার ৯৫৬ পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৮৫৫ টন চাল, ৪৭ লাখ ১ কোটি ৩০ লাখ ৯২ হাজার ২৫০ টাকা ও ২ হাজার ১০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ২ লাখ টাকার গোখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় একটি করে মেডিক্যাল টিম স্বাস্থ্যসেবার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।