X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র

'সংশোধন নয়, অপরাধপ্রবণ হচ্ছে বন্দিরা'

তৌহিদ জামান, যশোর
১৮ আগস্ট ২০২০, ১৯:৫২আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২০, ১৯:৫৯


'সংশোধন নয়, অপরাধপ্রবণ হচ্ছে বন্দিরা'

নৃশংস নির্যাতনে তিন কিশোর নিহত এবং আহত হয়ে ১৫ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। অপরাধী সংশোধনের কেন্দ্রেই অপরাধ, অব্যবস্থাপনা নিয়েও কথা উঠছে। তবে কেন্দ্রের শিশু-কিশোর, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছেে, এখানে নানামুখী অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটিতে বন্দিদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। পরিবার থেকে দেওয়া খাবার সংশ্লিষ্ট বন্দির কাছে পৌঁছানো হয় না। চলে মাদকদ্রব্য সেবনও। অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। এমনকি বন্দি নির্যাতনের জন্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের রয়েছে আরেকদল অনুগত বন্দি।

১৩ আগস্টের নৃশংসতা এইসব বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষেও করা হচ্ছে তদন্ত।

তিন কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হওয়ার পরপরই অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা কেন্দ্রে এসে তাদের সন্তানদের খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা নিয়েও। যদিও এখন পর্যন্ত তারা সাক্ষাৎ পাননি তাদের সন্তানদের।

খুলনার দৌলতপুর থেকে আসা কবীর শেখ বলেন, 'আমার ছেলে সোহাগ আড়াই বছর ধরে এখানে থাকে। এখানে খাবার-দাবারের সমস্যা। ছেলে ফোন করে এসব অনেকবার জানিয়েছে। চিকিৎসাও মেলে না।'

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রেজাউল করীম ও গোপালগঞ্জ থেকে আসা বন্দি শরিফুলের মা শিউলি বেগমও একই ধরনের কথা বলেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, 'এই কেন্দ্রে শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানো অতি সাধারণ ঘটনা। ভয়ে শিশুরা অভিভাবকদেরও কিছু বলতে চায় না। আর টাকা দিলে মেলে মাদকদ্রব্যও।'

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চালানোর জন্য কর্তৃপক্ষ বন্দি কিশোরদের একটি অংশকে মদত দেয়। গত ১৩ আগস্ট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মারা যাওয়া তিন বন্দির ওপর নির্যাতন চালায় কর্তৃপক্ষের অুনগত ৮ কিশোর। যাদের পুলিশ ইতোমধ্যে গ্রেফতারও করেছে। যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ঘটনার দুদিন পর নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে যেসব তথ্য উপস্থাপন করেন, তাতেও এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।

তিন কিশোর হত্যা মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোস্তফা হুমায়ুন কবীর বলেন, 'এটি দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বহির্প্রকাশ। কেন্দ্রে কর্মরতরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাদের কোনও অধিকারই নেই শিশুদের ওপর নির্যাতন করার।'

মানবাধিকারকর্মী রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, 'এটা অবশ্যই শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা সংশোধন তো হবেই না, উল্টো আরও হিংস্র-বেপরোয়া হবে।' তিনি এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

যশোর সরকারি এমএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, 'শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র শিশু–কিশোরদের সংশোধন ও মানসিকতার উন্নয়নের জন্যেই করা। কিন্তু যশোর কেন্দ্রে শিশুদের সংশোধনের চেয়ে অপরাধপ্রবণ হওয়ার তীব্রতা দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, এখানে শিশুদের বয়স নির্ধারণ একটা ফ্যাক্টর। ৭-১০ বছরের শিশু ও ১৫-১৮ বছরের শিশুদের একইভাবে ট্রিট করা হয়। এটি একটা সমস্যা। কেননা ৯ বছরের শিশু আর ১৮ বছরের শিশুর মানসিক অবস্থা কখনোই একরকম হবে না। এখানে যিনি কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি এই কাজকে কেবল পেশা হিসেবে নিয়েছেন। একটি শিশুর মনোজগতের পরিবর্তন করে তাকে নৈতিকতার শিক্ষায় উপনীত করার কাজকে আসলে নেশা হিসেবে নিতে হবে। রেগুলার কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের মোটিভেট করতে হবে। তাহলে উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা শিশুরা অপরাধপ্রবণ নয় বরং মানবিক গুণসম্পন্ন হবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, 'এখানে যেসব কর্মকর্তারা কাজ করছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা সেটি একটা প্রশ্ন। এখানকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনও চিন্তা ভাবনা রয়েছে কিনা, বিশেষ করে তাদের মানসিক উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমার মনে হয়েছে, এখানে তাদের যা করার, সেটি তারা করছেন না। তাই শিশু-কিশোররা সংশোধন না হয়ে আরও বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে।'

সমাজসেবা অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, 'এই কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের আসন রয়েছে ১৫০টি। কিন্তু এখন রয়েছে ২৮০জন। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। লোকবল সংকট থাকলেও এখানে খাবার প্রদানে দুর্নীতি, মাদক, চিকিৎসায় অবহেলা, অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে, তা অমূলক। যেহেতু এই ঘটনায় তদন্ত চলছে, বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই জানা যাবে।'

প্রসঙ্গত, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এটিই প্রথম ঘটনা নয়। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ২০১১ সালের ২৯ আগস্ট আকাশ (১২) নামে এক শিশুকে প্রথমে শ্বাসরোধ ও পরে টিনের টুকরো দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ৫ মে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দর্শনার্থী একজন অভিভাবককে মারধরের অভিযোগের জের ধরে এই সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন কেন্দ্রে নূর ইসলাম (১৫) নামে এক শিশু আত্মহত্যা করে।

 

 

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!