X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩০ বছর ধরে রাস্তার কুকুর-বিড়ালকে খাবার দেন তিনি

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
০৯ মার্চ ২০২২, ২২:০২আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২২, ২২:৩২

যে কেউ শখের বশে কুকুর-বিড়াল বাড়িতে কিংবা খামারে লালন-পালন করেন। আবার অনেকে আছেন মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো কুকুর-বিড়ালকে সুযোগ পেলে কিছু খাবার দেন। আবার অভিভাবকহীন কুকুর-বিড়াল দেখলে অনেকে তাড়িয়ে দেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুধা রানী। সুবিধাবঞ্চিত এবং নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মানুষ হয়েও দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে পথের প্রাণীদের সেবা করে যাচ্ছেন তিনি।

প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার কারণ

৫৮ বছর বয়সী সুধা রানীর শৈশব কেটেছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দো এলাকায়। জন্মের এক বছরের মাথায় মা মারা যান। এরপর সৎমায়ের কাছে অনেক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা। যখন ছেলেমেয়েরা বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যান, এলাকায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শৈশবে খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা। তখন সুধা রানীকে সৎমায়ের নির্দেশে গরু-ছাগল নিয়ে বিলের ঘাস খাওয়ানোর জন্য রাখাল সেজে প্রতিদিন মাঠে যেতে হতো। এর মধ্যে একদিন ফাঁকা বিলের মধ্যে গরু-ছাগল নিয়ে পড়ে যান বিপদে। আকাশে কালো মেঘ। সঙ্গে বজ্রবৃষ্টি। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় দাঁড়িয়ে থাকা গরুর পেটের নিচে বসে পড়লেন। মেঘ কেটে গেলো। বজ্রবৃষ্টি থামলো। এরপর থেকেই প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তার।

ভাগ্য পরিবর্তনে গ্রাম থেকে শহরে এসে সংসার শুরু

শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়ার পরপরই রাজশাহী নগরীর মুন্সিডাঙ্গা এলাকায় স্বামী সুনীলকে নিয়ে সংসার শুরু করেন সুধা রানী। গৃহিণী হিসেবে বাড়িতেই থাকতেন। স্বামী অলোকার মোড়ে সিনেমা হলের সামনে বাদাম বিক্রি করতেন। খেয়ে না খেয়ে স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সংসার চলছিল। কিন্তু স্বামী একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে মারা যাওয়ার আগেই ত্যাগ করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে একা বসবাস শুরু করেন। 

এর মধ্যে জীবিকার তাগিদে বাড়ির চার দেয়াল থেকে বের হতে হলো। পেয়ে গেলেন নগরীর ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের নিম্ন পদের একটি চাকরি। প্রত্যেক দিন বাড়ি থেকে গ্রন্থাগারের যাতায়াতের পথে নজরে আসে অভুক্ত কুকুর-বিড়াল। তাদের দিকে যখন কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, তখন সুধা রানী নিজের টাকা খরচ করে বিস্কুট কিনে খাওয়াতে লাগলেন। তারা খাবার পেয়ে সুধা রানীকে আপন ভাবতে শুরু করলো। এভাবে পথের কুকুর-বিড়ালগুলোর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। 

সুধা রানীর যাতায়াতের সময় পথের কুকুর-বিড়ালগুলো পেছন ধরে। কিন্তু গ্রন্থাগারে তার বড় কর্তা বিষয়টি খুব ভালোভাবে নেননি। তাই তিনি দোকান থেকে বিস্কুট কিনে তাদের খাওয়ানোর পর বিদায় করে দেন। যাতে বড় কর্তা তার ওপর নারাজ না হন।

প্রাণীদের খাবার কীভাবে সংগ্রহ হয়

সুধা রানীর ছেলে রাজশাহী নগরীতে রিকশা চালান। নিজে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার থেকে মাসে তিন হাজার টাকা আয় করেন। মানসিকভাবে অসুস্থ এক মেয়েসহ দুই মেয়ে নিয়ে নগরীর মুন্সিডাঙ্গায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তবে ঘর ভাড়ায় দুই হাজার টাকা চলে যায়। বাকিটা দিয়ে টেনেটুনে সংসার এবং প্রাণীদের খাবার জোগান। তবে তাকে এখন পর্যন্ত কেউ আর্থিক সহযোগিতা করেনি। 

কুকুর-বিড়ালের খাবারের জন্য কোনও ব্যক্তির কাছে ১০ টাকা চাইলে ধমক দিয়ে বিদায় করে দেন। আবার তার বাসায় পালন করা কুকুর-বিড়াল প্রতিবেশী কারও খাবার খেলে দিতে হয় জরিমানা। শুনতে হয় অনেক কথা। তাই ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও সাহস পান না। মাঝেমধ্যে নিজে কিছু কিনে খাবেন বলে অনেক সময় মানুষের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা চেয়ে নেন। এরপর বিস্কুট-পাউরুটি কিনে পথের প্রাণীদের খাওয়ান। 

আবার কষ্ট করে বাড়ির আশপাশের ছাত্রাবাসের বেঁচে যাওয়া কিংবা ছাত্রদের ফেলে দেওয়া খাবার পরিষ্কার করে প্রাণীদের মুখে তুলে দেন। যেখানে তিনি চাকরি করেন সেখানে ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে আয়োজকদের খাবার বেঁচে গেলে তাকে দেওয়া হয়। সেগুলো প্রাণীগুলোকে খাওয়ানোর পর বাসায় ফেরেন সুধা রানী।

তার বাসায় পাঁচটি বিড়াল থাকে। সেগুলোকেও ভাত-মাছ খাওয়াতে হয়। রাতের অন্ধকার কেটে গেলে ঘুমন্ত সুধা রানীকে বিড়ালগুলো জাগিয়ে তোলে। নিজের আগে বিড়ালগুলোকে খাবার দিতে হয়। অবশ্য বিড়ালের সকালের খাবার হিসেবে থাকে কয়েকটি হাড়। যেগুলো সুধা রানীর মেয়ে বুলবুলি হোটেল থেকে সংগ্রহ করেন।

২০ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে তার এই মানবিক সেবার কারণে ‘প্রাণবিক বন্ধু’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে

কোনও স্বীকৃতির পাওয়ার আশায় প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা নয়  

কোনোদিন পুরস্কারের কথা মাথায় নিয়ে কাজ করেননি সুধা রানী। তবে তার প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার জন্য কাজটা চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতার অভাব রয়েছে। যেখানে অনেকে শখের বসে কুকুর-বিড়ালদের সঠিক পরিচর্যা করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। সেখানে সুধা রানীর সামান্য আয়ে সংসার টানতে হিমশিম খেতে হয়। তার পক্ষে প্রাণীদের ভালো খাবার পরিবেশন করা কষ্টসাধ্য। কারণ বিড়াল মাছ ও কুকুর মাংস খেতে পছন্দ করে। ইচ্ছা থাকার পরও তিনি দিতে পারেন না। এজন্য তার সহযোগিতা প্রয়োজন।

কুকুর-বিড়ালদের চিকিৎসা ও নামকরণ অনেক সময় পথের কুকুরদের বিভিন্ন ব্যক্তি তাড়া করে পা ভেঙে দেন। আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আঘাত পেয়ে কখনও কখনও মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়। তখন বাড়ি থেকে তেল-হলুদসহ ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিংবা বাজার থেকে মলম কিনে লাগিয়ে সুস্থ করে তোলেন সুধা রানী। কুকুর-বিড়ালের আকার-আকৃতি অনুযায়ী নিজে নামকরণও করেছেন। যেমন, গায়ের রং কালো তাই একটি কুকুরকে কালু, আবার কোনটার নাম হচ্ছে- মিনি, ফালি, লালু, ল্যাংড়া, মুন ফুলটসি, সোনা, মোনা বিভিন্ন নামে ডাকলে সুধা রানীর ভাষা বুঝে প্রাণীগুলো।

প্রাণীদের নিয়ে ভবিষ্যৎ ইচ্ছা সুধা রানীর

নিজের কোনও জায়গা-জমি নেই। অন্যের বাসায় ভাড়া থাকেন। সরকার অনেক গরিব মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করে দিচ্ছে। তাকেও যদি একটি ঘর দেওয়া হয়, তাহলে বাসা ভাড়া বেঁচে যাবে। সেই সঙ্গে কুকুর-বিড়ালগুলো ওই বাড়িতে রাখবেন। তবে শহর থেকে গ্রামে যেতে চান না। কারণ শহরে বেশি পথপ্রাণী থাকে। আবার চাকরির জন্যও তাকে শহরে থাকতে হবে। এ অবস্থায় যদি কোনও হৃদয়বান প্রাণীপ্রেমী কিংবা প্রতিষ্ঠান তার সহায়তায় এগিয়ে এলে তা গ্রহণ করবেন।

স্বীকৃতি

সুধা রানীকে গত বছরের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে তার এই মানবিক সেবার কারণে ‘প্রাণবিক বন্ধু’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

সুধা রানীর এই প্রাণবিক কার্যক্রমকে কীভাবে দেখছে পরিবার

তার ছোট মেয়ে বুলবুলি রানী সরকার জানান, কুকুর-বিড়ালের প্রতি মায়ের মমতার কারণে মানুষের অনেক কটু কথা শুনতে হয়। তবে প্রাণীদের প্রতি তাদের পুরো পরিবারের অন্যরকম এক মায়া তৈরি হয়ে গেছে। মায়ের পাশাপাশি নিজেও বাসাবাড়িতে কাজ করে সেখানকার ফেলে দেওয়া খাবার প্রাণীদের জন্য নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে বিড়াল-কুকুরগুলো প্রতিবেশীদের বাসায় গিয়ে মলত্যাগ করে। এজন্য কটু কথা শুনতে হয়। তবে মা ও বড় বোন সবসময় প্রাণীদের মলগুলো পরিষ্কার করে দেন। প্রতিবেশীর এসব কথার কারণে একবার রাগ করে বিড়ালগুলো শহরের বাইরে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু এটি যন্ত্রণাদায়ক ছিল। মা সুধারানী এই কারণে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। তবে কিছুদিন পর থেকে আবারও নতুন নতুন প্রাণীদের সঙ্গে সখ্যতা হয়ে যায় মায়ের।’

রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের অফিস সহকারী রুহুল আলম খান ওরফে শহিন বলেন, সুধা রানী গরিব মানুষ হলেও প্রাণীদের প্রতি তার যে ভালোবাসা, তার জন্য সহকর্মী হিসেবে স্বাগত জানাই। তাকে যতটুকু পারি সহযোগিতা করি। তবে এক্ষেত্রে যদি কোনও হৃদয়বান ব্যক্তি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন, তবে সুধা রানী অনুপ্রাণিত হবেন।

রাজশাহীতে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যমকর্মী মাহাবুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সমাজে সুধা রানীর মতো প্রাণীপ্রেমী মানুষের খুবই অভাব। বিশেষ করে এমন নিম্নআয়ের মানুষ হয়েও নিজের খাবার প্রাণীদের মুখে তুলে দেওয়ার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা প্রশংসা ও সহানুভূতি পাওয়ার দাবি রাখে। পথপ্রাণীর প্রতি তার যে মমত্ব ও ভালোবাসা সেটাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে। যেসব মানুষ তাকে কটু কথা শোনায় তাদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়। সেগুলো যদি একটু যত্ন করে এসব প্রাণীর মুখে তুলে দেওয়া যায়, তবে একদিকে পরিবেশ দূষণ কমবে অন্যদিকে প্রাণীরা না খেয়ে মরবে না।

প্রাণীপ্রেমী রাকিবুল হক ইমিল ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সুধা রানীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু মানুষকে এই সমাজ সম্মাননা জানাতে পারলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ হয়। কিছু মানুষ কোনোদিন পুরস্কারের কথা মাথায় নিয়ে কাজ করেন না। তাদের জন্য বড় প্রাপ্তি হলো তার কাজটা চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা। এমনই একজন প্রাণবিক সুধা রানী। মানুষটি যতদিন বাঁচবেন, ততদিন যেন তার এই পথপ্রাণীদের নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। অন্তত তার জন্য একটা টেকসই সমাধান চাই। রাজশাহীর অবস্থাসম্পন্ন যে কেউ অন্তত প্রতি মাসে তার পথপ্রাণীদের জন্য খাবারের জোগানটুকু দিলে, এটাই তার জন্য বড় উপকার হয়। নিজের জন্য তিনি কিছু চাননি। দায়িত্ব নিয়ে কেউ কিছু করতে পারলে আমাদের জানান। অথবা সরাসরি সুধা রানীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তবে অনুরোধ করবো, তার হয়ে অন্য কারও বিকাশ কিংবা কাউকে অর্থ সহায়তা দেবেন না। আমরা সবসময় তাকে সরাসরি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রাণবিক বন্ধুদের জন্যই আমাদের পৃথিবী টিকে আছে। সালাম তাদের প্রতি।’

/এএম/
সম্পর্কিত
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
আগুনে পুড়ে মারা গেলো কৃষকের ৪ মহিষ
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
সর্বশেষ খবর
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত