৩৫ বছর ধরে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজামাল সরকার। টানা ২১ বছর ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি। কিন্তু তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে ইস্তফা দেন। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। দলীয় সমর্থন না পেয়ে একই পথে হাঁটেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল গফুর। তিনিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ঘোষিত ফলাফলে আব্দুল গফুর সর্বোচ্চ ভোট পেলেও ওই ফল বাতিল করে একটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।
দলীয় দুই কর্মী ভোটে এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনে যাত্রাপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক হেরেছে। শুধু হেরেছে বললে ভুল হবে, মাত্র ৫২৩ ভোট পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুড়িগ্রামের চার উপজেলায় ৩৪ ইউপির মধ্যে ১২টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। দলীয় প্রার্থীদের এমন হারে নিজ দলের কর্মী সমর্থকদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা, সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন, প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর আড়ালে বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সামগ্রিকভাবে স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কৌশল প্রণয়নে ব্যর্থতার কারণে দলীয় প্রার্থীরা হেরেছে। নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে দলটি।
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সাত ইউনিয়নের পাঁচটিতেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। তৃতীয় ধাপে ফুলবাড়ী উপজেলার ছয় ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয় লাভ করলেও সদর ও নাগেশ্বরী উপজেলার বেশিরভাগ ইউনিয়নে হেরেছে। নাগেশ্বরীর ১৩ ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতে এবং সদরের আটটি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতে (একটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীক নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের এমন হারে দলটির তৃণমূলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলেও জেলা ও উপজেলার নেতৃত্ব পর্যায়ে টনক নড়াতে পারেনি। বরং চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোতে প্রার্থী বাছাইয়ে আগের ধাপের ‘ভুলের’ পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা।
যাত্রাপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রাপ্ত ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের গ্রাম কমিটি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন কমিটি পর্যন্ত মোট সদস্য সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। এ ছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের সদস্য সংখ্যা বিবেচনা করলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু ঘোষিত ফলাফলে ওই ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৫২৩।
আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্যরাই নৌকায় ভোট দেননি এমন প্রশ্নের জবাবে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করে ‘ভাই রাজনীতি’ করার কারণে এই পরিস্থিতি। যাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন পায়নি তারা নৌকায় ভোট দেয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ থেকে টিমওয়ার্ক করা হয়নি।’
নাগেশ্বরী উপজেলায় দলের হারের কারণ এখনও নির্ণয় করা যায়নি বলে জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কুড়িগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য আসলাম হোসেন সওদাগর।
তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনের সময় ঢাকায় ছিলাম। দলীয় প্রার্থীরা কেন পরাজিত হলেন সেটা এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। এলাকায় ফিরে সবার সঙ্গে বসে কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করবো।’
তবে ওই উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হওয়া প্রার্থী আব্দুল আলিম বলেন, ‘প্রত্যেক ইউনিয়নে দলের মধ্যে গ্রুপিং কাজ করছে। দলীয় কমিটির সদস্যরাই নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এ ছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে আরও বেশি হেরেছে নৌকা।’
পরাজিত এই প্রার্থীর বক্তব্যের সমর্থন মেলে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের ভাষ্যে। নৌকার হারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ে আমরা গভীর মনোযোগী হতে না পারার, পাশাপাশি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারিনি।’
‘স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য যে কৌশল নিতে হয় সেটাও আমরা নিতে পারিনি। জেলা কমিটি গঠনের পর এখনও একটা বৈঠক হয়নি।’ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যোগ করেন এই নেতা।
এদিকে চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনয়নে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি পাওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান এনামুল হক। যার বিরুদ্ধে গ্রাম পুলিশ নিয়োগ ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন তলবও করেছিল।
একই উপজেলার উমরমজিদ ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইউনিয়ন কমিটি থেকে বহিষ্কৃত জহুরুল হক। কমিটিতে সদস্য পদ না থাকা এবং বর্ধিত সভায় নাম প্রস্তাব করা না হলেও তিনি কীভাবে মনোনয়ন পেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নেতাকর্মীরা।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন থেকে প্রস্তাবিত তিন জন করে প্রার্থীর নাম আমরা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। কেন্দ্র যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, সেটাই চূড়ান্ত। আমরা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তের আনুগত্য করতে বাধ্য।’
দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে অনেক ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এদের কারণে ইউনিয়নগুলোতে দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেনি।’
‘যারা দলীয় সিদ্ধান্তকে অমান্য করে বিদ্রোহী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।’ যোগ করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।