ঘরে বাঁশের বেড়া। চালে বাঁশের চাটাই। সেই চাটাইয়ের নিচে পলিথিন মুড়িয়ে বৃষ্টির পানি থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা। ঘরের ভেতরে বিছানায় শুয়েই দিনের বেলা সূর্যের আলো আর চাঁদনি রাতে জ্যোৎস্নার দেখা মেলে। কিন্তু সে আলো সুখের অনুভূতি জাগায় না নুর মোহাম্মদ-জরিনা বেগম দম্পতির মনে। কারণ বসতঘরের এই জীর্ণ অবস্থা তাদের সৌখিনতা নয় বরং দারিদ্র্যের কশাঘাতের বাধ্যবাধকতা। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা প্রচণ্ড খরাতেও পলিথিন মোড়ানো এই ঘরই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড়লই সংলগ্ন নাওডাঙা গ্রামে বসবাস অসহায় নুর মোহাম্মদ-জরিনা বেগম দম্পতির। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর নিজেদের খুঁটি যেন হারিয়ে ফেলেছেন তারা। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পলিথিন মোড়ানো জীর্ণ ঘরে বসবাস করলেও সরকারি-বেসরকারি কোনও সহায়তা তাদের ভাগ্যে জোটেনি।
সত্তরোর্ধ্ব নুর মোহাম্মদ জানান, একমাত্র ছেলেসহ ভারতের দিল্লিতে কাজ করতেন তিনি। সেখানে ছেলের মৃত্যু হয়। এরপর তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। স্ত্রীর পাওয়া চার শতক জায়গাতে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন। টিন কেনার সামর্থ্য না থাকায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঘরের চালে পলিথিন দিয়ে বসবাস করেন তারা। কিন্তু রোদের তাপ আর গাছের ডালপালা পড়ে সেই পলিথিনও স্থানে স্থানে ফুটো হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলে চাল চুয়ে ঘরের ভেতর পানি পড়ে, বিছানা-পোশাক ভিজে যায়। রাতে বৃষ্টি হলে তাদের বসে কিংবা দাঁড়িয়ে রাত কাটাতে হয়। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েও প্রতিকার মেলেনি। জোটেনি সরকারের সামাজিক নিরপত্তাবেষ্টনীর সুযোগ-সুবিধা।
নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি দিনমজুর। এখন এলাকাত কাজও নাই। যা রোজগার করি তা দিয়ে খাবার আর স্ত্রীর ওষুধ কিনতে টাকা শেষ হয়া যায়। টিন কেনার সামর্থ্য আমার নাই।’
‘মেম্বারের কাছে গেলে কয়, আমারে ভোট দাও না, তোমাক কী দেই। ৪০ দিনের কাজ (অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি) শুরু করিল, তাও আমাক নেইল না। চলি কেমন করি আর ঘরে বা ঠিক করি কেমন করি। বউটাও চোখে দেখে না। তার চিকিৎসা করাই কেমন করি। আমরা খুব অসহায় হয়া গেছি বাবা।’ বলেন এই বৃদ্ধ।
‘ঝরি (বৃষ্টি) হইলে ঘরত পানি পড়ে। সারাদিন কাজ করি আসিয়া রাইতে শান্তি করি ঘুমবারও পাই না। রাইতে ঝরি হইলে ঘরের ভেতরত যেটাই পানি না পড়ে সেটাই খাড়া হয়া (দাঁড়িয়ে) থাকি। বিছনা কোছনা, কাপড় চোপড় সউক ভিজি যায়। উপায় তো পাই না বাবা। বানের দিন (বর্ষা) আসইপ্যার লাগছে, ঘরত বাস করায় দায় হয়া গেইছে। ’ এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্ব আর দুর্ভোগের বর্ণনা দিলেন নুর মোহাম্মদ।
স্বামীর অসহায়ত্বে আক্ষেপ নেই জরিনা বেগমের। নানা সমস্যায় ঘেরা জীবনে তার নতুন বিড়ম্বনা তৈরি করেছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা। জরিনা বেগম বলেন, ‘পাইসা (টাকা) না হইলে কী দিয়া ঘর ঠিক করবে, কী দিয়া টিন কিনবে? একটা মানুষ কামাই করে। তাকে দিয়া কী কিনি, কী খাই। ছাওয়া পওয়াও নাই যে হামাক দেখপে।’
‘ঘরত থাকপার পাই না বাবা। গাছের ঠ্যাল (ডাল) পড়ি প্লাস্টিক ফুটা হইছে। ঝরি হইলে সারা ঘরত পানি পড়ে। কাইয়ো এখনা সাহায্যও করে না। কি দিয়া ঘর ঠিক করি।’ বলেন জরিনা বেগম।
প্রতিবেশী রহমত আলী ও আমেনা বেগম বলেন, ‘এই পরিবারের দুজনই বয়স্ক ও অসুস্থ। তারা তেমন একটা কাজ করতে পারে না। অনেক সময় অন্যের বাড়ি থেকে খুঁজে নিয়ে খায়। থাকার ঘরটাও বাসের অযোগ্য। বর্ষার আগেই তাদের ঘরটা মেরামত করা প্রয়োজন। কোনও সামর্থ্যবান ব্যক্তি বা সরকারের পক্ষ থেকে যদি এই দম্পতিকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে কমপক্ষে তারা রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমাতে পারতো।’
ওই দম্পতির অসহায়ত্ব ও জরাজীর্ণ ঘরে বসবাসের বিষয়টি স্বীকার করে বড়ভিটা ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাতেন বসুনিয়া বলেন, ‘যতদূর মনে হয় তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়নি।’
দিনমজুর নুর মোহাম্মদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘তিনি মিথ্যা বলেছেন।’ ৪০ দিনের অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চাইলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
উপজেলায় বিভিন্ন গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর উপহার দেওয়া হলেও নুর মোহাম্মদের অসহায় অবস্থার বিষয়ে অবগত নন ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো।’
বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিন্টু বলেন, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু আমার বড়ভিটা ইউনিয়নবাসী আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। এই পরিবারটি সরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাবে অর্থ কষ্টে বসতঘরে পলিথিনের চালা দিয়ে বসবাস করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, যেন এই পরিবারটিকে সহযোগিতা করে এবং বসতঘরটি মেরামত অথবা একটি নতুন ঘর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।