বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও বিএনপি নেতার পাল্টাপাল্টি মামলা এবং কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রংপুরের পীরগাছা। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) দোকানপাট বন্ধ রাখার ডাক দিয়েছে পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতি।
রবিবার সকাল থেকে বিভিন্ন ইউনিয়নের বিএনপি নেতাকর্মীরা উপস্থিত হতে থাকেন উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে। বিকালে উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। সমাবেশে পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতি সংহতি প্রকাশ করে রাঙ্গার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফসার আলী, বিএনপির সদস্য মোতিয়ার রহমান, জুয়েল আহমেদ, রফিকুল ইসলামসহ জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ের বিএনপির নেতারা।
সমাবেশে জানানো হয়, রাঙ্গার নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি দেবে পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতি।
সন্ধ্যায় সমিতির পক্ষ থেকে মাইকিং করে পুরো এলাকায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, সোমবার স্মারকলিপি প্রদানের জন্য সকালে দোকান বন্ধ থাকবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান শেষে দুপুরে দোকান খোলা হবে। তবে ব্যবসায়ী সমিতি হরতালের ডাক দিয়েছে এমন খবর সামাজিক যোগাযগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা সত্য নয়। হরতাল ডাকা হয়নি।
এর আগে পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে ২২ জনের নামে মামলা করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তারা রাঙ্গার পদত্যাগসহ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে শনিবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
শনিবার রাতে বিএনপি আহ্বায়কের নামে মামলাটি দায়ের করেন গুলিতে আহত শিক্ষার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক একরামুল হক। এর এক দিন আগে শুক্রবার ২২ শিক্ষার্থীর নামে মামলা করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা। দুটি মামলার বিষয় নিশ্চিত করেছেন পীরগাছা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুশান্ত কুমার সরকার।
একরামুলের করা মামলায় গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাধা এবং গুলিবর্ষণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম রাঙ্গাকে ছাড়াও অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বাদী একরামুল হক মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সারা দেশের ন্যায় রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এ খবর জানতে পেরে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করে। মিছিলটি পীরগাছা সরকারি কলেজের কাছ থেকে পীরগাছা জে.এন মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদের সামনে পৌঁছালে আসামি আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা তার চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিলনের ব্যক্তিগত অফিস রক্ষার্থে বিজয় মিছিলকে উদ্দেশ্য করে চার রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন। বাদী তাৎক্ষণিক মাটিতে শুয়ে পড়ায় ও গুলি তার বাম হাতে লাগায় তিনি গুরুতর রক্তাক্ত হন।
এদিন আরও অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জন লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র হাতে ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে বাধা প্রদান করে। সেই বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরাসহ বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা ছাত্র-জনতার ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে অনেকে আহত হন। এতে ভয়ে ছত্রভঙ্গ হন এবং অনেকে গুলিবর্ষণের সময় প্রাণ বাঁচাতে মাটিতে শুয়ে পড়েন। ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে বিএনপি নেতার গুলিবর্ষণের ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
বাদী একরামুল হক জানান, ওই দিন ঘটনার পর তিনি স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হয়েছে। তবে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় ওই বিএনপি নেতাসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন।
শুক্রবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ২২ শিক্ষার্থীর নামে মামলা দায়ের করেন আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা। এই মামলার প্রতিবাদে শনিবার বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পীরগাছা থানার সামনের সড়কে বিক্ষোভসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
বিএনপি নেতার করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সোমবার বিকাল ৪টার দিকে পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ে বিজয়ের পর ছাত্র-জনতা লোহার রড, হকিস্টিক, লোহার পাইপ, চাইনিজ কুড়াল, হাসুয়া দ্বারা পীরগাছা বাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ের তালা ভাঙে। এরপর ১৫ হাজার টাকার কাচের গ্লাস, টেবিল, ৩৫ হাজার টাকার ৪০টি চেয়ার, ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার ৩২টি সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার পীরগাছা থানায় রব্বানি ওরফে বাবু, শামিম মিয়া, অন্তর মিয়া, শাকিল মিয়া, জুয়েল মিয়া ও শাহিন মিয়াসহ ২২ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়।
এ ব্যাপারে আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা বলেন, ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মামলা করা হয়েছে। উপজেলা বিএনপিকে ছোট করার জন্য আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ ও প্রত্যাহারের দাবিতে হাজার হাজার জনগণ প্রতিবাদ জানিয়েছে।’
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে বাঁচাতে এই মামলা করে তিনি ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। মামলার প্রতিবাদে শনিবার থানার সামনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা।
তাদের দাবি, গত ৫ আগস্ট পীরগাছায় কোনও ভাঙচুর হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিলন রাঙ্গার আত্মীয়। এখনও তিনি ওই বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর তাই গত ৫ আগস্ট উপজেলা আওয়ামী লীগ ও মিলনের ব্যক্তিগত অফিস রক্ষা করতে গিয়ে রাঙ্গা ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে চার রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন। এতে ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী গুলিবিদ্ধ হন।
দুইটি মামলা ও এলাকায় মাইকিং করার বিষয়টি নিশ্চিত করে পীরগাছা থানার ওসি ওসি সুশান্ত কুমার সরকার জানান, দুইটি মামলারই তদন্ত চলছে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জানান, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর বিএনপির কোনও নেতাকর্মী তাদের বিরুদ্ধে গেলে কিংবা কোনও অপকর্মে জড়ালে এর দায় নেবে না বিএনপি। অপরাধ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।