বর্ষাকালে খরস্রোতা তিস্তাকে শুষ্ক মৌসুমে চেনাই যায় না। পানির সংকটে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। শুধু নদী নয়, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। লালমনিরহাট অংশ এখন মৃতপ্রায়। ফলে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য প্রায় বিলীন। জেলে আর মাঝিদের নেই কর্মব্যস্ততা। থেমে গেছে। থমকে গেছে লাখো পরিবারের উপার্জন। জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
গতি হারিয়েছে তিস্তা
তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। কয়েকটি বাঁধ, রাবার ড্যাম, পানি প্রত্যাহার, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনসহ বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের গতি হারিয়েছে নদীটি। এসব কারণে কী শুষ্ক কী বর্ষা; বেশিরভাগই সময় তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি থাকে না। এতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।
সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারীর কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। তিস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। অথচ বছরের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশ অংশে পানি থাকে না।
মানবেতর জীবনযাপন
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আমাদের এই অঞ্চলে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপরই বাংলাদেশকে পানি দেয় ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা হয়। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পানি মেলে না। এভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি এখনও। ফলে শীতকালে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। ফলে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর ১২৫ কিলোমিটার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জেলেরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে হেঁটেই তিস্তা পার হওয়া যায়, তাই মাঝিদের আর নৌকা বাইতে হয় না। এ কারণে বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। পানির অভাবে কৃষকরা কৃষি উৎপাদন করতে পারছেন না।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি
১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চের জন্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি ধরে রেখে ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানি দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি হয়নি। তখন থেকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে।
১৪টি স্থানে বাঁধ দিয়েছে সিকিম সরকার
গত বছরের ১০ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিস্তায় কি পানি আছে যে বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে? তাহলে তো উত্তরবঙ্গের মানুষ খাওয়ার পানিই পাবে না। বর্ষার তিস্তার সঙ্গে যেন গ্রীষ্মের তিস্তাকে এক করে দেখা না হয়। সিকিম থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীর ১৪টি স্থানে সিকিম সরকার বাঁধ দিয়ে ১৪টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে। এতে করে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সব জলই টেনে নিচ্ছে সিকিম সরকার। এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বারবার জানালেও তারা কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ফলে সেই সমস্যায় এখনো ভুগছে পশ্চিমবঙ্গের তিস্তাপারের মানুষ।
তিস্তার বর্তমান পরিস্থিতি
নীলফামারীর জলঢাকা এবং হাতীবান্ধার মাঝখানে দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়। ব্যারাজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নদীর ডান তীরে চারটি জেলায় তিস্তা সেচ প্রকল্প পরিচালিত হয়। তবে প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ ব্যারাজের সামনেই বালুর স্তর জমে গেছে; যা ব্যারাজের কার্যক্ষমতা হ্রাস করেছে। অপরদিকে গত বছর সিকিমে বাঁধ ভাঙার কারণে ব্যারাজের বিভিন্ন অংশে পলি জমে গেছে। গত বর্ষায় ব্যারাজের ৭৩ কিলোমিটার দূরে তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এই পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বাড়েনি, বরং নদীভাঙন বেড়েছে।
তিস্তা-দুর্দশার কারণ
দুর্দশার প্রধান কারণ হলো নদীকে তার স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে না দেওয়া। এর অভ্যন্তরে এবং আশপাশের এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। যা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
১৯৭৯ সালে তিস্তা নদীতে প্রথম বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৯০ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শেষ হয়। ব্যারাজে ৪৪টি গেট আছে; যা শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখে এবং তিস্তার ডান পাশের চারটি জেলায় কৃষিকাজের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়। ২০০০ সালের আগে তিস্তার অভ্যন্তরে গুচ্ছগ্রাম বা আবাসন প্রকল্প করা হয়, যা তুলনামূলকভাবে অল্পসংখ্যক মানুষকে সুফল দিয়েছিল। ২০০৪ সালে আদিতমারী উপজেলায় দুটি স্পার বাঁধ নির্মাণের ফলে তিস্তার ডান ও বামতীর এবং চরাঞ্চলে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ২০১২ সালে লক্ষীটারি ইউনিয়নে তিস্তা সড়ক সেতু বা শেখ হাসিনা সেতুর উদ্বোধন করা হয়। কালীগঞ্জ উপজেলায় শৈলমারির চরে ১২০ একর জমিতে ইন্ট্রাকো সোলার প্যানেল প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। সুন্দরগঞ্জে তিস্তা সোলার প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ লাখ প্যানেল বসানো হয়েছে। এসব প্রকল্পের আশপাশে বিভিন্ন স্থাপনা, বাড়িঘর, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাঁধ, বাজার এবং পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জে ব্যক্তি মালিকানায় আলীবাবা থিম পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কারণেও নদীর গতি হারিয়ে পানিপ্রবাহ কমেছে।
ক্ষয়ক্ষতি
প্রতি বছর তিস্তার ভাঙন নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। নদীর অভ্যন্তরে প্রকল্প স্থাপনের কারণে তিস্তা তিনটি চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চর এবং চরবাসীর মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। তিস্তা ব্যারাজের কারণে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে এবং দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে।
নদীর বাম তীর রক্ষা কমিটির গবেষণা বলছে, তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভাঙনে দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাম তীর রক্ষা কমিটির দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন অজুহাতে দামি জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলছে। যার আর্থিক মূল্য দিয়ে বাঁধ তৈরি করা যেতো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচড়া শেখ হাসিনা সেতু দাঁড়িয়ে আছে ধুধু বালুচরের ওপর। ব্রিজ থাকলেও হেঁটেই নদী পার হচ্ছেন স্থানীয়রা। তবে মাঝেমধ্যে নদীর কিছু অংশে পানি আছে। যেটিকে ডোবার মতো দেখায়। সেখানে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে পানি নিয়ে কৃষিজমিতে দিচ্ছেন চরের কৃষকরা। কিন্তু যে পরিমাণ ফসলি জমি, তাতে এই পানিতে কিছুই হয় না।
গত বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সদরের খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, মোগলহাট, কুলাঘাটের, বড়বাড়ী, কালিগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার, কাকিনা, ভোটমারী, পাটগ্রামের শ্রীরামপুর, পাটগ্রাম, বুড়িমারী, দহগ্রাম, জগৎবেড়, বাউরা, আদিতমারীর মহিষখোঁচা, দুর্গাপুর, হাতীবান্ধার ডাউয়াবাড়ী, সিন্দুর্ণা, গড্ডিমারী, বড়খাতা, সিংগিমারী ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন। তিস্তা লাগোয়া এসব ইউনিয়নে বন্যার ক্ষত এখনও শুকায়নি।
যা বলছেন স্থানীয়রা
৬৫ বছরের রুস্তম আলী তিস্তা নদীর শুকনো স্থানে নৌকায় বসে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবা এই এলাকার তালুকদার ছিলেন। আমরা এখানে নদীর পাড়েই বড় হয়েছি। এখন তিস্তায় কোনও ঢেউ নেই। পানি নেই। তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। দেশ স্বাধীনের আগে এখান থেকে নৌকায় চড়ে ত্রিমোহনী নদী দিয়ে তুসভান্ডার জমিদার বাড়ির ঘাটে গিয়েছিলাম। এখন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। বছরের বেশিরভাগই সময় নদী শুকনো থাকে। আমাদের জীবন-জীবিকা বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে।’
বারোঘরিয়া গ্রামের ৭০ বছরের বজলুর রহমান বলেন, ‘তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। বর্ষায় কিছুটা পানি এলে নদীভাঙন শুরু হয়। আমরা অনেকে বসতভিটা হারিয়েছি। আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।’
তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরের বালুতে ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে তা মরে যাচ্ছে। অধিক পরিশ্রম করে প্রতিদিন সেচ দিয়ে কৃষক চাষাবাদ করছেন। তবে আশানুরূপ ফলন পাচ্ছেন না।
তিস্তা পাড়ের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, ‘বর্ষায় প্রচুর পানি ছেড়ে দেওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানিসহ ঘরবাড়ি হারা হয় এই অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষায় পানির প্রয়োজন হলেও তিস্তায় পানি দেয় না ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তা পাড়ের। নদী শাসন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না থাকায় তিস্তা নদী এলাকার কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।’
নৌকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্ষাকালে নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক চার-পাঁচশ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন পানিশূন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। কোনো রকম সংসার চালাচ্ছি। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
অন্যের জমি বন্ধক নিয়ে বাড়ি করে বসবাস করছেন মেহেরজান। ৬৫ বছরের এই নারী তার পুরোনো ভিটে নদীর দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘ভালো লোকের জমি বন্ধক নেওয়ার কারণে সরে যেতে হচ্ছে না। সরকার আমাদের জন্য কিছুই করেনি। বারবার আশ্বাস দেয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করে না।’
জাহেদা বেগম (৬৩) বলেন, ‘বন্যা এলে বস্তা দেয়। বস্তা দিয়ে কী ভাঙন আটকানো যায়? রাস্তাটা ভেঙে গেছে। রাস্তার মাথাটা আছে। এখন নদীতে পানি নাই। ধুধু বালুচর। পানি নিয়ে জুলুমের শিকার আমরা।’
তিস্তা নিয়ে গণশুনানি
৯ ফেব্রুয়ারি বিকালে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেলসেতু-সংলগ্ন এলাকায় তিস্তা নিয়ে গণশুনানিতে তিস্তাপারের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও বাসিন্দারা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। রংপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত গণশুনানিতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে তিস্তাপারের অন্তত ১০ জন বাসিন্দা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। লালমনিরহাটের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘হামার হইছে কপাল পোড়া। হামার দুঃখ কাইও দেখে না। হামার রাজপুর আর রাজপুর নাই। তিস্তা নদীর ভাঙনে রাজপুর ফকিরপুর হয়া গেইছে। একনা চরোত যাও, হামার বাড়িভাঙা না দেইখলে হামার দুঃখ বুঝবেন না। এবার হামাক ঠকান না বাহে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তিস্তা পাড়ের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনপ্রবণ। এর মধ্যে ২০ কিলোমিটার এলাকা অতি ভাঙনপ্রবণ। এই ভাঙন রোধে আগামী মার্চ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর তীর সুরক্ষার কাজ শুরু করবে।’
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘তিস্তায় দীর্ঘ চর জেগে উঠেছে। চরের জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা হবে। রংপুর অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপক হলেও শিল্প অবকাঠামো না থাকায় কৃষকরা ফসলের দাম পান না। এজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কৃষিপণ্যের হিমাগার তৈরি করা হবে। মানসম্মত শিক্ষা বাড়াতে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে আধুনিক পাঠাগার করা হবে।’
তিস্তা রক্ষায় আন্দোলন ও দাবি
বামতীর রক্ষা কমিটি, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও কমিটি, নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলসহ বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন তিস্তা নদী রক্ষার জন্য মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করছে। তিস্তা প্রকল্পের পাঁচ শতাংশ খরচ করলে কাউনিয়ার রেলসেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ দেওয়া যেতো বলে দাবি করছে সংগঠনগুলো।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের উদ্যোগে লালমনিরহাট জেলা শহরে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে তিস্তা পাড়ের প্রায় ১০ হাজার মানুষের পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব (দুলু)। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের উদ্যোগে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে একটি সামাজিক আন্দোলন চলমান আছে। ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি দুই দিন তিস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
আসাদুল হাবিব বলেন, ‘তিস্তা অববাহিকার রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার মূল চালিকা শক্তি তিস্তা নদী। এক সময়ের প্রমত্ত তিস্তাকে এ অঞ্চলের জীবন রেখা বলা হতো। কিন্তু তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে তিস্তা নদী আজ শীর্ণ, স্থবির, একটি মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত। বর্ষা ও খরা উভয় মৌসুমে তিস্তা এখন এ অঞ্চলের গণমানুষের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে ভারতের বাঁধ থেকে বিনা নোটিশে পানি ছাড়ায় তিস্তার দুকূল প্লাবিত হয়ে মানুষের ঘরবাড়ি, আবাদি ফসল মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে, জনজীবন বিপন্ন করে তোলে। আবার খরার মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। ফলে তিস্তার দুই পাড়ের মাইলের পর মাইল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়ে। মানুষ দীর্ঘদিন পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছে রাজনৈতিক স্থবিরতা। তাই পানির ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তিস্তা অববাহিকার মানুষের দুর্বিষহ বিপন্ন অবস্থা থেকে মুক্তির দাবিতে ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি ৪৮ ঘণ্টা তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
ভিটেমাটি হারিয়েছে ৬০ হাজার পরিবার
বামতীর রক্ষা কমিটির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। তিস্তার ভাঙনে দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে। লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এর প্রস্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা। এ কারণেই মূলত বন্যা-ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নীলফামারীর সৈয়দপুর পওর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবু সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপাতত কয়েক হাজার কিউসেক পানি আছে। সেগুলো রাখার জন্য গত ১ জানুয়ারি থেকে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে দুই-একটি খোলা রাখা হয়। এই পানি দিয়ে দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের কিছু অংশকে সেচের আওতায় আনা হয়।’
যা বলছেন বিষেজ্ঞরা
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি নিয়ে কালক্ষেপণের আর সুযোগ নেই।দায়িত্বশীলরা ইচ্ছে করলেই এটির সমাধান করতে পারেন। প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকা ক্ষতি হয় আমাদের। তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এবার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সরেজমিনে ঘুরে গেছেন। তিনি দায়িত্বে আছেন। আশা করছি, এবার সমাধান হবে।’
একাত্তরের গেরিলা লিডার ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের’ নেতা এসএম শফিকুল ইসলাম কানু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মূল সমস্যাটা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগ কেউই চায় না, ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে। ন্যায্য হিস্যা চাইলে না জানি ক্ষমতা হারায়। যেকোনোভাবে বাংলাদেশ সরকারকেই ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে।’