X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ‘শান্তি পরিকল্পনা’য় শান্তির সম্ভাবনা কতটুকু?

আরশাদ আলী
২৪ জুন ২০১৮, ১৭:২৬আপডেট : ২৪ জুন ২০১৮, ১৭:৩৩

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আনা এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দিয়ে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকায় দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধের প্রস্তাব পাস হয়। ততদিনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এরইমধ্যে  নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জেরুজালেমে ইসরায়েলি দূতাবাস স্থাপন করার ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সুদীর্ঘ দাবির একেবারে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিরসনে এক শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপনের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ট্রাম্প আখ্যায়িত শতাব্দীর সেরা এই পরিকল্পনা অল্পদিনের মধ্যেই উন্মোচিত হবে বলে জানা গেছে। এমন অবস্থায় মার্কিন কর্মকর্তারা আরব দেশগুলো সফরের মধ্য দিয়ে তাদের পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিয়েছে। এর মধ্যে জানা গেছে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চাপ দিচ্ছে আরবের বিভিন্ন দেশ। এ নিয়ে আব্বাস বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্পের ইসরায়েল ঘেঁষা নীতি, ইসরায়েলের সঙ্গে তার জামাতা ও উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, আরব রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ভূমিকাসহ সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে ট্রাম্পের আসন্ন শান্তি পরিকল্পনায় ভরসা করার মতো কিছু দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ‘শান্তি পরিকল্পনা’য় শান্তির সম্ভাবনা কতটুকু?

ঐতিহাসিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরায়েল-ঘেঁষা। এ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের বিভিন্ন প্রস্তাবে যতোবার ফিলিস্তিনি সুরক্ষার প্রশ্ন হাজির হয়েছে, ওবামা প্রশাসনের সময়কার একটি ঘটনার কথা বাদ দিলে সবক্ষেত্রেই ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের শাসনামলে ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর (শুক্রবার) দীর্ঘদিনের রীতি ভেঙ্গে জাতিসংঘের ইসরায়েলি বসতিবিরোধী প্রস্তাবে ভেটো না দিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদে অবৈধ বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব পাসের পর ফিলিস্তিন প্রশ্নে ট্রাম্প-ওবামা দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। ট্রাম্প ওই সময়ই ইঙ্গিত দেন, তার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘২০ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।’ কথা অনুযায়ীই ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর না যেতেই ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে ইসরায়েলি রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ঘোষণা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেন তিনি।

উল্লেখ্য, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ঐতিহাসিকভাবেই ইসরায়েল-ঘেঁষা হলেও ওবামা প্রশাসন পর্যন্ত তারা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিল। বিগত মার্কিন প্রশাসনগুলো চাইতো, দুই দেশের মধ্যকার সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হোক। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধের পাশাপাশি ১৯৬৭ সালের প্রস্তাবিত সীমানা অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষেই অবস্থান ছিল তাদের। তবে ট্রাম্প সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে সেই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন। নির্বাচনি প্রচারণার সময় থেকেই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নীতির সমালোচনা করে আসা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপরই নতুন শান্তি প্রস্তাব তৈরির কথা জানান।

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের গত কয়েকদিনে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে সফরের প্রধান কারণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন আদায় করা। ট্রাম্পের জামাতা ও শীর্ষ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারকে গত বছর থেমে যাওয়া শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত জ্যাসন গ্রিনব্লাটকে নিয়ে জর্ডানে অবতরণ করেন। জর্ডান ছাড়াও তারা মিসর, সৌদি আরব, কাতার ও ইসরায়েল সফর করেছেন। যার হাতে এই শান্তি প্রস্তাব বাস্তব রূপ পেয়েছে, আল জাজিরার খবরে ট্রাম্পের সেই জামাতা কুশনারের ইসরায়েলপ্রীতির নেপথ্য কারণ হাজির করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে কুশনার ও গ্রিনব্লাটের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকায় অবৈধ বসতিতে বড় ধরনের তহবিল। এসব ঘটনায় শান্তি পরিকল্পনার বিস্তারিত জানার আগেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন।

এদিকে  সংবাদ সংস্থা কুদস নেট নিউজের বরাতে মিডলইস্ট মনিটর মাহমুদ আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোকে উদ্বৃত করে জানিয়েছে, ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ মেনে নিতে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে কয়েকটি আরব দেশ। চাপ প্রয়োগকারী দেশের মধ্যে সৌদি আরব ও জর্ডান অন্যতম। দেশগুলো চুক্তির ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার সময় সবুজ সংকেত দিয়েছে। সূত্র দাবি করেছে, গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করার বিনিময়ে ট্রাম্পের চুক্তি মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। একই সূত্র কুদস নেট নিউজকে বলেছে, আরব দেশগুলোর এমন অবস্থানে আব্বাস ‘বিস্মিত’ হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে বর্জন করার দাবি করে আসছেন। আরব দেশগুলোর এমন চাপ দেওয়াকে আব্বাস ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলেও মনে করছেন। এর আগে গাজার ওপর আব্বাস প্রশাসনের নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থারও বিরোধিতা করেছিল এসব আরব দেশ।

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ‘শান্তি পরিকল্পনা’য় শান্তির সম্ভাবনা কতটুকু?

এর আগে সৌদি আরবের প্রভাবশালী যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান একাধিকবার মাহমুদ আব্বাসকে ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নিতে বলেছিলেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ট্রাম্প প্রস্তাবিত ‘শান্তি নীতি’র পক্ষে ভূমিকা নেওয়ার তাগিদ দেন সৌদি যুবরাজ। তা করতে ব্যর্থ হলে আব্বাসকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতেও বলেন তিনি। ২০১৮ সালের মে মাসে আবারও আব্বাসকে হুমকি দেন যুবরাজ সালমান। টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আর তা না করলে অভিযোগ না করে চুপ থাকারও পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া শান্তি প্রস্তাবের শর্তগুলো অবশ্যই ফিলিস্তিনি নেতাদের মানতে হবে।

তবে এখনও ট্রাম্প প্রশাসন এই পরিকল্পনার বিষয়ে একেবারে নিশ্চুপ এবং বিস্তারিত কিছুই জানাচ্ছে না। ফলে ট্রাম্প কথিত শতাব্দীর সেরা এই প্রস্তাব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক মুইন রাব্বানি আল জাজিরাকে বলেছেন, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একবছরের বেশি সময় ধরে যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে সেটার কিছুই আজ পর্যন্ত ফাঁস হলো না। অন্যভাবে বলতে গেলে, আসলে কোনও পরিকল্পনাই নেই।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শান্তি আলোচনা ভেঙে পড়ে ২০১৪। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে হাঁটছিল আগের মার্কিন প্রশাসন। এই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৬৭ সালের ৪ জুন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সীমান্ত আলাদা করা হয়েছিল। এতে পূর্ব জেরুজালেমকে ধরা হয়েছিল ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক রীতি ভঙ্গ করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। এরপর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্ততাকারীর উপযুক্ত নয়, মার্কিন মধ্যস্ততায় ইসরায়েলের সঙ্গে কোনও শান্তি আলোচনায় যোগ দেবে না তারা। ফলশ্রুতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেয় ফিলিস্তিন। পাল্টা পদক্ষেপও নেয় যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংস্থায় পরিকল্পিত সহযোগিতার অর্ধেক তহবিল বাতিল করে। বিশ্লেষক রাব্বানি সার্বিক প্রেক্ষাপটে আল-জাজিরাকে বলেন, যদি কেউ জেরুজালেমে ইসরায়েলের শাসন, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংস্থাকে বিচ্ছিন্ন করার দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরায়েলের পক্ষেই। যুক্তরাষ্ট্র হয়ত এখন তাদের অর্জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে চায়।

 

 

/বিএ/
সম্পর্কিত
এপি'র সাংবাদিককে গ্রেফতার করলো রাশিয়া
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
নিউ ইয়র্কে বন্দুকধারীর গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ