X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহত্যা ছেড়ে রাজপথে ভারতের কৃষকরা

আলী রমজান
০৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:১৯আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৪০

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র খরা, বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা, করপোরেট বাজার ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে টিকতে না পারার কারণে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন ভারতের কৃষকরা। প্রতি বছরই দেশটিতে হাজার হাজার কৃষক শুধু ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে দেশটিতে ৩ লাখের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তবে এমন পরিসংখ্যানেও টনক নড়েনি সরকারের। কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনও উদ্যোগ। মরতে মরতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এবার রাজপথেই দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন তারা। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে বড় ধরনের অনেকগুলো কৃষক সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এবার তাই দিল্লির পার্লামেন্ট অভিমুখে লংমার্চ করেছেন আন্দোলনরত কৃষকরা।

আত্মহত্যা ছেড়ে রাজপথে ভারতের কৃষকরা বিশ্লেষকরা বলছেন, সুরক্ষার প্রশ্নে কার্যকর নীতি-পরিকল্পনার অভাব থাকার কারণেই ভারতে ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন কৃষকরা। তাদের মতে, দশকের পর দশক ধরে ঋণের বোঝা থাকা, খরা ও আয় কমে যাওয়া ভারতের গ্রামাঞ্চলে কঠোর প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যতকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। কৃষকদের দুর্দশার দিকে সরকারের মনোযোগ ফেরাতে গত ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর রাজধানী দিল্লির রাস্তায় বিক্ষোভ করেন এক লাখেরও বেশি কৃষক। তাদের মূল দাবি ছিল, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, খরার সময় সরকারি সহায়তা দেওয়া ও ঋণ মওকুফ করা। গত দুই বছরে এ নিয়ে চতুর্থবারের বড় ধরনের বিক্ষোভ করলো কৃষক-জনতা।

মোদির ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’য় সংবাদমাধ্যমের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় কৃষকদের আত্মহত্যা সংক্রান্ত প্রতিবেদন। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-এনসিআরবি’র তথ্যমতে, ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ লাখের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তবে অ্যাকটিভিস্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও বেশি। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া তথ্যে প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার কৃষকের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান জানান। গত মার্চ মাসে ভারতের কৃষিমন্ত্রী পার্লামেন্টে উত্থাপিত তথ্যে জানান, ২০১৬ সালের হিসাবে প্রতি আট ঘণ্টায় ওই রাজ্যে একজন করে কৃষকের আত্মহত্যার রেকর্ড আছে। আত্মহত্যা ছেড়ে রাজপথে ভারতের কৃষকরা

২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশে আত্মহত্যা করেছেন ৬ হাজার ৭১ জন কৃষক। ২০১৩ সাল থেকে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ২১ শতাংশ করে। পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শুধু পাঞ্জাব রাজ্যেই ১৬ হাজার ৬০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ বছরে প্রায় এক হাজার কৃষক প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু এনসিআরবি’র তথ্যমতে, সেখানে বছরে তিন শ’র কম কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।

আল জাজিরার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী,  ঋণ শোধ করতে না পারায় পাওনাদারদের হাতে অপমান-লাঞ্ছনার পাশাপাশি অভাব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ভারতের কৃষকরা। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি নামের একটি সাময়িকী গত মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সরকারের উদ্যোগে সম্পন্ন হওয়া পাঞ্জাবভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ঋণের বোঝাই সেখানকার ৭৫ শতাংশ কৃষকের আত্মহত্যার নেপথ্য কারণ। আত্মহত্যা ছেড়ে রাজপথে ভারতের কৃষকরা

ভারতের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের উন্নয়নে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। গত কয়েক দশক ধরে সেচ সংকট ও উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় ক্ষতির মুখে রয়েছে ভারতের কৃষিখাত। তবে এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আত্মহত্যা বাদ দিয়ে রাজপথকেই বেছে নিয়েছেন কৃষকরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সংগঠনগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হচ্ছে। তবে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক শাখার সদস্য।

গত মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লক্ষাধিক কৃষক একই দাবিতে ১৬০ কিলোমিটার হেঁটে মুম্বাইয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ২০১৭ সালে খরা কবলিত তামিলনাড়ু রাজ্যের কৃষকরা হাতে মানুষের মাথার খুলি ও মুখে জীবন্ত ইঁদুর নিয়ে বিক্ষোভ করে সবার মনোযোগ কাড়ে। মৃত সাপ কিংবা কালো কাপড়ে ধ্যান কিছুই বাদ পড়েনি লাখো কৃষকের অংশগ্রহণে আয়োজিত অভিনব ওই কৃষক বিক্ষোভে। আত্মহত্যা ছেড়ে রাজপথে ভারতের কৃষকরা

ঋণ মওকুফ, ষাটোর্ধ কৃষকদের গণপেনশন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য হ্রাস, ফসলের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ আর স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নসহ ১৫ দফা দাবি নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর হরিদ্বারের টিকায়েত ঘাট থেকে পদযাত্রা শুরু করে উত্তরপ্রদেশসহ একাধিক রাজ্যের কৃষক সংগঠন। ২ অক্টোবর ওইসব কৃষক সংগঠনের ডাকে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন ৭০ হাজার কৃষক। দিল্লির রাজঘাটে চৌধুরী চরণ সিং স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথে গাজিয়াবাদে দিল্লি গেটের কাছে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের ওপর লাঠিচার্জের পাশাপাশি জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। পরে আলোচনা হলেও কৃষকদের দাবি মানেনি সরকার। তাই আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন কৃষকরা।

২৯ নভেম্বর রাত থেকেই কৃষকরা দিল্লিতে পৌঁছানো শুরু করেন। অন্ধ্র প্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশ থেকে হাজার হাজার কৃষক দিল্লিতে আসেন। এসব কৃষকরা ট্রাক্টর, ট্রেন, গাড়ি এমনকি পায়ে হেঁটেও সমাবেশে যোগ দিতে আসেন। বৃহস্পতিবার তারা দিল্লির রামলীলা ময়দানে জড়ো হন। সেখানে তাঁবু গেড়ে তারা রাত্রিযাপন করেন। শুক্রবার সকাল থেকেই তারা মিছিল নিয়ে পার্লামেন্টের দিকে যাওয়া শুরু করেন। পার্লামেন্টের নিরাপত্তার জন্য সেখানে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।

মহারাষ্ট্র থেকে আসা নারী কৃষক সংগীতা ভৈর কয়েক মাস আগে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। এবার দিল্লির আন্দোলনেও তিনি উপস্থিত হন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’কে তিনি বলেন, ‘মুম্বাইয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। সরকার তিন মাসের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা তা কখনও করেনি।’

কৃষকদের এই আন্দোলনে ভারতের বেশকিছু তরুণ চিকিৎসক ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীও অংশ নেন। বিভিন্ন সময় তারা আন্দোলনকারী কৃষকদের চিকিৎসা সেবা দেন। এছাড়া আইনজীবী, শিল্পী, শিক্ষকসহ আরও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পানি ও খাবার নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। পাশাপাশি তারা সামাজিক মাধ্যমেও আন্দোলনের খবর প্রচার করেন।

কৃষক বিক্ষোভে অংশ নেওয়া পেশাজীবীদের একজন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোনামি বসু। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে কৃষকদের দাবিগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। তার ভাষায়, ‘আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য আমি এই বিক্ষোভে অংশ নিতে চাই।’

ভারতের নির্বাচনে ভোটের ক্ষেত্রে কৃষকরা বড় ভূমিকা রাখে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলন আগামী বছর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। লাখান পাল সিং নামের একজন কৃষক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু সরকারের কৃষকবিরোধী নীতি আমাদের খুবই পীড়া দিয়েছে।’

/এমপি/
সম্পর্কিত
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
আম আদমি পার্টির সাথে জোট, দিল্লি কংগ্রেস প্রধানের পদত্যাগ
ভারতের মণিপুরে আবারও জাতিগত সহিংসতা
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ