যুক্তরাষ্ট্রের শতাব্দীর সর্বোচ্চ শুল্কের প্রভাবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়লে প্রবৃদ্ধি আরও ধীরগতির হবে। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) প্রকাশিত সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক পূর্বাভাস (ডব্লিউইও) হালনাগাদে আইএমএফ জানিয়েছে, গত ১০ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর সর্বজনীন শুল্ক আরোপ করেছেন। এ ছাড়া অনেক দেশের ওপর উচ্চ হারের শুল্ক (বর্তমানে স্থগিত) ঘোষণা করেছেন। এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির গতি কমবে।
২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে ০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৬ সালের জন্য পূর্বাভাস ০ দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জানুয়ারিতে ধারণা করা হয়েছিল, ওই দুই বছরেই প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হবে।
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়ের-অলিভিয়ের গুরিনচাস সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছি। গত ৮০ বছর ধরে চলা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হচ্ছে।
বাণিজ্য উত্তেজনা ও মূল্যস্ফীতির চাপ
শুল্কের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে ধীরগতিতে কমবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। ২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
গুরিনচাস বলেন, বাণিজ্য উত্তেজনা দ্রুত বাড়ছে এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণে অনিশ্চয়তা অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোজোন, চীন এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি কমছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বাড়ে, তাহলে অনিশ্চয়তা বাড়বে, আর্থিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে এবং আর্থিক শর্ত কঠিন হবে। এর সম্মিলিত প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আরও কমবে।
যুক্তরাষ্ট্র: প্রবৃদ্ধি কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে
আইএমএফ যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ০ দশমিক ৯ শতাংশ কমিয়ে ২০২৫ সালের জন্য ১ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ২০২৬ সালের জন্য পূর্বাভাস ০ দশমিক ৪ শতাংশ কমিয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
গুরিনচাস বলেন, আইএমএফ যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে না, তবে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশ হয়েছে। শুল্ক ও সেবা খাতের শক্তিশালী চাহিদার কারণে ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশ হতে পারে, যা জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ফেডারেল রিজার্ভকে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্কের ধাক্কা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকো—দুই দেশই ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। আইএমএফ কানাডার প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ২০২৫ সালে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ১ দশকি ৬ শতাংশ করেছে। জানুয়ারিতে দুই বছরেই ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
মেক্সিকোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০২৫ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি (-)০ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে, যা জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ কম। ২০২৬ সালে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়ে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।
ইউরোপ ও এশিয়ায় প্রবৃদ্ধি কমবে
ইউরোজোনে প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ১ দশমিক ২ শতাংশ হবে, যা জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে ০ দশমিক ২ শতাংশ কম।
জার্মানির প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ০ দশমিক ০ শতাংশ (০.৩ শতাংশ কম) এবং ২০২৬ সালে ০ দশমিক ৯ শতাংশ (০ দশমিক ২ শতাংশ কম) হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ১ দশমিক ১ শতাংশ (০.৫ শতাংশ কম) এবং ২০২৬ সালে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হবে।
জাপানের প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ০ দশমিক ৬ শতাংশ (০.৫ শতাংশ কম) হতে পারে।
চীনের প্রবৃদ্ধি ২০২৫ ও ২০২৬ সালে ৪ শতাংশ হবে, যা জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে যথাক্রমে ০ দশমিক ৬ শতাংশ ও ০ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
বিশ্ব বাণিজ্যে ধস
আইএমএফ ২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ করেছে, যা ২০২৪ সালের অর্ধেক। গুরিনচাস বলেন, বাণিজ্য চলবে, তবে এর খরচ বেশি হবে এবং কম কার্যকর হবে। বাণিজ্য ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইএমএফের এই প্রতিবেদন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। বাণিজ্য যুদ্ধ ও শুল্কের প্রভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতির হতে পারে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সূত্র: রয়টার্স