আধুনিক ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতার নাম আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ইরানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে রয়েছেন। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি শুধু ইরানের ভেতরের পরিবর্তনের সাক্ষী নন, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির অবস্থানও রূপান্তর করেছেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।
শৈশব, শিক্ষা ও বিপ্লব-পূর্ব জীবন
আলি খামেনির জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল ইরানের মাশহাদ শহরের এক ধর্মীয় পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মাশহাদ ও ইরাকের পবিত্র নগরী নাজাফের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি ইরানের কওম শহরে স্থায়ী হন এবং আয়াতুল্লাহ হুসাইন বুরুজেরদি ও আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির শিষ্যত্বে অধ্যয়ন করেন।
ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনবিরোধী গোপন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এর ফলে বহুবার গ্রেফতার হন ও শাহের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাকের হাতে নির্যাতিত হন।
বিপ্লব-পরবর্তী উত্থান
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহের পতনের পর ইরানে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গঠিত হয়। এই সময় খামেনি দ্রুত নতুন শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে উচ্চপর্যায়ের ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামি বিপ্লবী পরিষদের সদস্য, উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯৮১ সালে একটি হত্যাচেষ্টায় গুরুতর আহত হন। একটি মসজিদে বক্তৃতাকালে টেপ রেকর্ডারে লুকানো বোমা বিস্ফোরণে তার ডান হাত স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।
একই বছরের আগস্টে ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলি রাজায়ী ও প্রধানমন্ত্রী জাভাদ বাহোনার নিহত হলে খামেনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন এবং নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করেন।
সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণ
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত আয়াতুল্লাহ মনতাজেরিকে শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। ফলে এক নতুন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন খামেনি, তিনি ওই সময় ছিলেন কেবল ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ পদমর্যাদার একজন মধ্যপন্থি আলেম। নিজেই ওই সময় বলেছিলেন, ‘আমি একজন ক্ষুদ্র মৌলভী, এই পদে নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না।’
তবে সংবিধানে পরিবর্তন এনে শীর্ষ ধর্মীয় মর্যাদার চেয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে খামেনির উত্থানকে বৈধতা দেওয়া হয়।
শাসনকাল: দ্বৈত নেতৃত্ব ও ক্ষমতার সমীকরণ
প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট হাশেমি রফসানজানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন খামেনি। তবে পরবর্তী সময়ে দুই জনের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে সংস্কারপন্থি মোহাম্মদ খাতামির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনৈতিক সংস্কার ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রস্তাব খামেনির কট্টর রক্ষণশীল অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
২০০৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর গড়ে ওঠা গ্রিন মুভমেন্ট ছিল তার শাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনে মাহমুদ আহমাদিনেজাদের বিজয়ের বিরোধিতা করে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তখন খামেনির বিরুদ্ধে সরাসরি স্লোগানও শোনা যায়।
২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর হিজাব ইস্যুতে ইরানে আবারও বিশাল আন্দোলন হয়। এই বিক্ষোভে বহু মানুষ নিহত হন এবং খামেনির পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দেওয়া হয়। তবে এই বিক্ষোভকেও তিনি ‘বাইরের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দেন।
পারমাণবিক চুক্তি ও পশ্চিমের সঙ্গে টানাপোড়েন
২০১৩ সালে হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট হলে খামেনি কিছুটা নমনীয় অবস্থান নেন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির আলোচনায় অনুমতি দেন। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত যৌথ কর্মপরিকল্পনা বা ছয় পরাশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি। যদিও ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলে খামেনি এটিকে ‘আমেরিকার প্রতারণার প্রমাণ’ হিসেবে তুলে ধরেন।
মধ্যপ্রাচ্যে কৌশল ও প্রতিরোধ অক্ষ
খামেনির অন্যতম কৌশলগত অর্জন প্রতিরোধ অক্ষ গড়ে তোলা। এর আওতায় তিনি সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক ও আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কাসেম সোলাইমানির নেতৃত্বে কুদস বাহিনী এই কৌশলের মূল চালিকা শক্তি ছিল।
এই অক্ষকে সামনে রেখে খামেনি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ বাড়ান এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করেন।
ইসরায়েল ইস্যুতে অবস্থান
খামেনির দৃষ্টিতে ইসরায়েল একটি ‘অবৈধ রাষ্ট্র’। তিনি রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে সরাসরি সমর্থন দেন।
দীর্ঘদিন ধরে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত থাকার পর ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল ইরান একযোগে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। এটি ছিল কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক নতুন সমীকরণ—যেটিকে খামেনির আগ্রাসী প্রতিরোধ কৌশলের প্রকাশ্য রূপ হিসেবে মনে করা হয়।
উত্তরসূরি কে হবেন?
৮৫ বছর বয়সী খামেনি শারীরিক অবস্থা ও বয়স বিবেচনায় তার উত্তরসূরি নিয়ে আলোচনা তীব্রতর হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তার ছেলে মোজতবা খামেনি উত্তরসূরি হতে পারেন। আবার কেউ কেউ সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই