তারা নিজেদের দাবি করে ‘বিশ্বের প্রথম সার্বভৌম হিন্দু রাষ্ট্র’-এর দূত। তাদের আছে নিজস্ব পাসপোর্ট, ‘বিশ্বজনীন সংবিধান’ এবং পবিত্র সোনায় তৈরি মুদ্রা, যা পরিচালনা করে একটি ‘রিজার্ভ ব্যাংক’। এই অবাস্তব রাষ্ট্রের নাম ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব কালাশা’। জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে তারা বক্তব্য দিয়েছে, বিশ্বনেতা, মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং নিউ ইয়র্কের মেয়রের সঙ্গে ছবি তুলেছে। তাদের নেতা, এক পলাতক ‘ঋষি’, দাবি করেন—পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি। তার সেবা নিলে কোটিপতিরা পরজন্মেও গরিব হবে না!
কিন্তু কালাশার এই কাল্পনিক সাম্রাজ্য এবার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।
গত সপ্তাহে বলিভিয়ার কর্তৃপক্ষ কালাশার সঙ্গে যুক্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। অভিযোগ, স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে ১ হাজার বছরের লিজ চুক্তি করে আমাজনের বিশাল এলাকা দখলের চেষ্টা করেছিল তারা। বলিভিয়া সরকার চুক্তিগুলো বাতিল করে দিয়েছে এবং কালাশার সদস্যদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে—কালাশায় নয়, তাদের আসল নাগরিকত্বের দেশে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও চীনের নাগরিক রয়েছেন।
বলিভিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘বলিভিয়া কালাশা নামের কোনও কাল্পনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে না’। কালাশার ‘প্রেস অফিস অব দ্য হলি সি অব হিন্দুইজম’ এই অভিযোগের কোনও জবাব দেয়নি।
কে এই স্বামী নিত্যানন্দ?
কালাশার এই অদ্ভুত গল্প শুরু হয় ২০১৯ সালে, যখন স্বামী নিত্যানন্দ নামের এক গুরু—যিনি নিজেকে ‘হিজ ডিভাইন হলিনেস, দ্য সুপ্রিম পন্টিফ অব হিন্দুইজম’ বলে দাবি করেন–ধর্ষণ, নির্যাতন ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর।
দক্ষিণ ভারতের অরুণাচালাম রাজশেখরন হিসেবে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন এবং ব্যাঙ্গালুরুর কাছে তার প্রথম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্রুতই তিনি ভারত ও বিশ্বজুড়ে তার সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
নিত্যানন্দের দাবি ছিল—তিনি প্রাচীন ধর্মীয় ও রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার দাবিও করতেন, যেমন—‘তৃতীয় চোখ’ দিয়ে অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া বা সূর্যোদয় ৪০ মিনিট পিছিয়ে দেওয়া! এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের জীবনের অজানা রহস্যের মূর্ত প্রতীক। আমার সামনে বসামাত্রই জ্ঞানলাভ শুরু হয়।’
একটি সভায় তিনি ‘পুনর্জন্ম ট্রাস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর ধারণা দেন। তার বক্তব্য—বিল গেটস বা ওয়ারেন বাফেটের মতো ধনীরা কয়েক বিলিয়ন ডলার ট্রাস্টে জমা রাখলে, তিনি নিশ্চিত করবেন যে পরজন্মে তারা সেই টাকা ফেরত পাবে! তার এক শিষ্য মঞ্চে বলেছিলেন, কারণ, হতে পারে বিল গেটস পরজন্মে গরিব হয়ে জন্মাবেন, ওয়ারেন বাফেট কোনও আফ্রিকান গ্রামে দরিদ্র হিসেবে জন্ম নিতে পারেন!
ভারত থেকে পলায়ন ও কালাশা প্রতিষ্ঠা
ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাড়তে থাকায় নিত্যানন্দ ভারত ছাড়েন। তিনি দাবি করেছিলেন, এটি একটি ‘হিন্দুবিরোধী ষড়যন্ত্র’ এবং তার ‘জমি দখলের চেষ্টা’।
তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে দক্ষিণ আমেরিকা বা ক্যারিবিয়ানে থাকার খবর পাওয়া গেছে। কয়েক বছর পর তিনি আত্মপ্রকাশ করেন এবং দাবি করেন—তিনি ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব কালাশা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা প্রাচীন হিন্দু রাজ্যের পুনর্জন্ম!
কালাশার ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, তাদের সার্বভৌম ভূমি ‘আন্দেজ অঞ্চলে’ অবস্থিত। নিত্যানন্দ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, এই অবস্থান তাকে ‘অভিযোগের ঊর্ধ্বে’ রাখবে। এক ভিডিওতে তিনি বলেন, “অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্বামীজি, আপনি ভারতে এত বড় সাম্রাজ্য ফেলে কেন এক কোণায় বসে আছেন?’ উত্তর হলো—এখানকার ‘ইমিউনিটি’ আমাকে যেকোনও মামলা থেকে রক্ষা করবে।”
বিশ্বজুড়ে বিব্রতকর ঘটনা
এরপর থেকে কালাশার নাম উঠেছে বারবার, যখন তাদের ‘দূতরা’ বিশ্বনেতাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ২০২৩ সালে প্যারাগুয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কালাশার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার পর পদত্যাগ করেন। ওই বছরই নিউয়ার্কের মেয়র রাস বারাকা কালাশার সঙ্গে ‘সিস্টার সিটি’ চুক্তি বাতিল করেন। বলিভিয়ায় কালাশার অনুসারীরা (যারা টুরিস্ট ভিসায় এসেছিল) প্রেসিডেন্ট লুইস আরসের সঙ্গে ছবি তোলে।
কিন্তু বিতর্ক ছড়ায় যখন বলিভিয়ার সংবাদপত্র এল ডেবের অনুসন্ধানে জানা যায়—কালাশার সদস্যরা আমাজনের আদিবাসীদের সঙ্গে ১ হাজার বছরের জমি লিজের চুক্তি করেছিল।
বাউরে আদিবাসী গোষ্ঠীর নেতা পেদ্রো গুয়াসিকো বলেন, গত বছর বন্যার পর তারা সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। পরে তারা নয়া দিল্লির তিনগুণ বড় জমির লিজ চুক্তি প্রস্তাব করে। প্রথমে ২৫ বছরের চুক্তি হলেও পরে তারা ১ হাজার বছরের ইংরেজি খসড়া নিয়ে আসে, যাতে বায়ু সীমা ও প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের অধিকারও ছিল!
গুয়াসিকো বলেন, ‘আমরা তাদের কথা শুনে ভুল করেছিলাম। তারা আমাদের টাকার লোভ দেখিয়েছিল, কিন্তু সব মিথ্যা।’
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস