X
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
২৭ বৈশাখ ১৪৩২

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: চীনের জন্য মূল্যবান গোয়েন্দা সুযোগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১০ মে ২০২৫, ১১:৫৬আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ১২:৪২

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাত যখন যুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছে, তখন এই পরিস্থিতি চীনের জন্য হয়ে উঠেছে এক বিরল ও অমূল্য গোয়েন্দা সুযোগ। বিশেষ করে যখন পাকিস্তানের ব্যবহার করা যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য অস্ত্র থেকে চীন তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, চীনের সামরিক আধুনিকায়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে তারা সীমান্ত ঘাঁটি, ভারত মহাসাগরের নৌবহর এবং মহাকাশ থেকে সরাসরি ভারতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নেইল বলেন, ‘গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি বিরল সুযোগ যা চীনের সীমানার খুব কাছেই ঘটছে এবং এতে চীনের এক সম্ভাব্য প্রধান প্রতিপক্ষ জড়িত।’

দুই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, একটি চীনা তৈরি জে-১০ পাকিস্তানি জেট অন্তত দুটি ভারতীয় সামরিক বিমান ভূপাতিত করেছে। এর একটি ছিল ফরাসি নির্মিত রাফাল ফাইটার। যদিও ভারত কোনও বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে-১০ ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও কোন ক্ষেপণাস্ত্র বা অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, তা উল্লেখ করেননি।

এই ধরনের বাস্তব আকাশযুদ্ধ বিশ্লেষণ করতে পারলে একটি দেশের সামরিক পরিকল্পনার গতি ও প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ সহজ হয়। ঠিক এ কাজটাই করছে চীনা গোয়েন্দা বাহিনী।

আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত ও চীন দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়। হিমালয় পর্বতজুড়ে প্রায় ৩,৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে ১৯৫০-এর দশক থেকে বিরোধ চলছে, যা ১৯৬২ সালে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল।

সর্বশেষ সংঘর্ষ, যা ২০২০ সালে শুরু হয়েছিল, তা ২০২৩ সালের অক্টোবরে একটি টহল চুক্তির মাধ্যমে কিছুটা প্রশমিত হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশই সীমান্ত বরাবর তাদের সামরিক স্থাপনা ও সক্ষমতা বাড়িয়েছে, তবে মহাকাশ থেকেই চীন শক্তিশালী গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।

লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা সংস্থা (আইআইএসএস) জানায়, , চীনের বর্তমানে ২৬৭টি সক্রিয় উপগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি শুধু গোয়েন্দা নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ কাজে এবং আরও ৮১টি সামরিক ইলেকট্রনিক ও সিগনাল তথ্য পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি বিশাল নেটওয়ার্ক, যা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের, বিশেষ করে ভারতের তুলনায় অনেক এগিয়ে এবং শুধু যুক্তরাষ্ট্রই এতে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে।

নেইল আরও বলেন, ‘মহাকাশ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ট্র্যাকিং ক্ষমতার দিক থেকে চীন এখন অনেক বেশি এগিয়ে—তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।’

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সামরিক উপগ্রহ বা গোয়েন্দা কার্যক্রম সংক্রান্ত রয়টার্সের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দেয়নি।

পাকিস্তানের সামরিক মিডিয়া শাখা এবং তথ্যমন্ত্রীও চীনের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি সম্পর্কে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।

পাকিস্তান পূর্বেও বলেছে যে তাদের সঙ্গে চীনের ‘আবহাওয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ রয়েছে।

ভারত এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি, তবে ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বৃহস্পতিবার স্কাই নিউজকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আমাদের জন্য উদ্বেগের কিছু নয়। চীন তাদের সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই সম্পর্ক চায়, যার মধ্যে আমরা রয়েছি।’

চীনা সামরিক গোয়েন্দা দল ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যবহার এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য আগ্রহী থাকবে—শুধু উৎক্ষেপণের পথ ও নির্ভুলতাই নয়, বরং কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত তথ্যও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারের দিকটিও চীন আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করবে, কারণ ধারণা করা হয় এটি এখনও যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি।

ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ট্র্যাকারদের মতে, চীন সাগরপথেও তার গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান সক্রিয় রয়েছে চীন। এখানে তারা মহাকাশ ট্র্যাকিং জাহাজ, মহাসাগরীয় গবেষণা ও মৎস্য নৌযান দীর্ঘ সময়ের জন্য মোতায়েন করছে।

আঞ্চলিক কূটনীতিকরা বলছেন, চীনা নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে ব্যাপক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে তুলনামূলকভাবে সতর্ক। কারণ তাদের বিস্তৃত নৌঘাঁটি নেই। তবে অন্য ধরনের জাহাজ ব্যবহার করে সক্রিয়ভাবে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে।

গত সপ্তাহে কিছু ট্র্যাকার লক্ষ্য করেছেন, বেশ কিছু চীনা মাছ ধরার জাহাজ একযোগে নড়া-চড়া করছে এবং পহেলা মে আরব সাগরে ভারতীয় নৌ-মহড়ার কাছাকাছি ১২০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে প্রবেশ করে। এসময় পাকিস্তান-ভারত হামলা পাল্টা হামলা চালাচ্ছিল।

পেন্টাগনের চীনা সামরিক আধুনিকায়ন সংক্রান্ত রিপোর্ট ও বিশ্লেষকদের মতে, চীনা মাছ ধরার নৌবহর প্রায়শই সমন্বিত মিলিশিয়া কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ভূমিকা পালন করে।

ওপেন সোর্স ট্র্যাকার ড্যামিয়েন সাইমন এক্সে দেওয়া পোস্টে লেখেন, ‘এই জাহাজগুলো সম্ভবত শ্রবণ পোস্ট হিসেবেও কাজ করে, যাতে তারা প্রতিক্রিয়ার গতি ও কৌশল নির্ণয় করে এবং পূর্ব সতর্কবার্তা ও নৌ-গোয়েন্দা তথ্য তাদের স্পনসরদের কাছে পাঠাতে পারে।’

চীনা কর্মকর্তারা সাধারণত মাছ ধরার মিলিশিয়া বা বেসামরিক মুখোশে গোয়েন্দা কার্যক্রমের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।

পাকিস্তানের সঙ্গে গভীর ও বিস্তৃত কৌশলগত সম্পর্কের কারণে, বেইজিং তাদের রাষ্ট্রদূত ও সামরিক দলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুরোপুরি কাজে লাগাবে বলে আশা করা যায়।

সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর চীনা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেমস চার বলেন, ‘পাকিস্তানে চীনা সামরিক উপদেষ্টা ও অন্যান্য কর্মীদের উপস্থিতি সুপরিচিত। কারণ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চীন থেকে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র আমদানি করে আসছে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চীনের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে সক্ষম।’

সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা এখন শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই—তার জাল ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক কৌশল ও গোয়েন্দা রাজনীতির পরিসরেও। চীন খুব নীরবে, কিন্তু কৌশলগতভাবে এই সংঘাত থেকে উপকৃত হচ্ছে—যা ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

সূত্র: রয়টার্স

/এস/
সম্পর্কিত
পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন, উত্তেজনা কমানোর আহ্বান
অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্যালেন্ডার, এশিয়া কাপ 
অভিবাসী কেন্দ্রে প্রবেশ করায় নিউ জার্সির মেয়র গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
এবার হলিউড মিশন...
এবার হলিউড মিশন...
সৈকতে গোসলে নেমে পর্যটকের মৃত্যু
সৈকতে গোসলে নেমে পর্যটকের মৃত্যু
পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন, উত্তেজনা কমানোর আহ্বান
পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন, উত্তেজনা কমানোর আহ্বান
ষড়যন্ত্র করে থামানো যাবে না, আ.লীগ নিষিদ্ধ করতেই হবে: হাসনাত আব্দুল্লাহ
ষড়যন্ত্র করে থামানো যাবে না, আ.লীগ নিষিদ্ধ করতেই হবে: হাসনাত আব্দুল্লাহ
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা