X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মস্কোতে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনায় বিভক্ত পুতিন মিত্ররা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৩ এপ্রিল ২০২৩, ২০:২২আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫৭

ইউক্রেনের যুদ্ধের সম্মুখ সারির থেকে অনেক দূরে, একটি ভিন্ন ধরণের লড়াই দানা বাঁধছে। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর রুশ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের লালিত 'হলি লেক' নামের একটি হ্রদের ধারে ৬০ হাজার মুসল্লি ধারণে সক্ষম একটি মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতা শুরু হয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে কোসিনো-উখতোমস্কির বাসিন্দারা মসজিদ ভবন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই ভবনে একটি মুসলিম কেন্দ্র এবং শিক্ষাগত সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি অত্যন্ত অনুগত মুসলিম প্রধান রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ মসজিদবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ইউক্রেনের পরিখায় গিয়ে ‘দেশপ্রেম দেখাতে’ আহ্বান জানিয়েছেন। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনাকে শুধুই ‘গুজব’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চেচেনদের একটি ভিডিও বার্তায় মস্কোতে অর্থোডক্স বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ শুরু করতে পারে বলে সতর্ক করার দেশটির এমএমএ যোদ্ধারাও মসজিদের বিরোধিতা করার বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন।

কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন ৫ এপ্রিল ঘোষণা দেন, মসজিদটি অন্য কোথাও ছোট জায়গায় স্থানান্তর করা হবে। এই সিদ্ধান্তটি অর্থোড্রক্স প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের সমর্থন পেয়েছেন। তিনিও একজন পুতিন মিত্র। যিনি ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের ন্যায্যতা দিয়েছেন।

মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতায় অর্থোড্রক্স খ্রিষ্টানরা জড়ো হয়েছিলেন

কিয়েভ-ভিত্তিক ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিটিক্সের প্রধান ডেনিস ব্রাইলভ বলেছেন, মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে বিবাদ চলমান ধর্মীয় উত্তেজনার অংশ। ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সেনা ও ভাড়াটেদের যোদ্ধাদের মধ্যেও এটি বিরাজ করছে। এই উত্তেজনা মূলত রুশ সেনাবাহিনীতে মুসলিম সেনাদের নেওয়ার কারণে সৃষ্ট হয়েছে।

ইউক্রেনে আগ্রাসনের ন্যায্যতা দিতে রাশিয়া ওপর ন্যাটোর আধিপত্য এবং নাৎসিমুক্তকরণ সম্পর্কে পুতিনের যুক্তির পাশাপাশি ক্রেমলিনের প্রচারণায় অর্থোডক্স খ্রিষ্টান রুশ এবং ইউক্রেনীয়দের ‘ঐক্য’-কে হাজির করা হচ্ছে।

রাশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় এক-দশমাংশ মুসলিম এবং এই ধর্মে বিশ্বাসীরা ইউক্রেনে লড়াই করতে গিয়ে বিপুল সংখ্যায় মারা যাচ্ছে। রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ড রোসগভারদিয়ার অংশ কাদিরভের চেচেন বাহিনী। কিন্তু এটি পরিচালনা করেন তিনি নিজেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তার ভিডিও বার্তাগুলো তাকে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি হিসেবে হাজির করেছে।

ইন্সটিটিউট ফর ইউরোপিয়ান ইন্টিগ্রিটির সিনিয়র অনুসন্ধানী গবেষক ওলগা লাউটম্যান বলেন, কাদিরভের যোদ্ধা ও রুশ সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা দেখেছি যে গত এক বছরে উত্তেজনা বেড়েছে।

ব্রাইলভ বলেছেন, রুশ মুসলমানদের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান সংখ্যক রাশিয়ার সেনা সদস্য মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত দেশ থেকে অভিবাসী। গত সেপ্টেম্বরে পুতিনের একটি ডিক্রি অনুসারে, বিদেশি নাগরিকরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করলে তাদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ হবে।

তিনি বলেন, এই সংশোধনীর লক্ষ্য হলো অভিবাসীদের জীবনের বিনিময়ে রুশ সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া। অনেক অভিবাসীকে চালাকি করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অথবা নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে।

২০২২ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার বেলগোরোদ অঞ্চলে একটি সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তাজিক বংশোদ্ভূত দুই ব্যক্তি এক লে. কর্নেলের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন বলে খবর পাওয়া গেছে। অসমর্থিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা গুলি চালিয়ে ২২ জনকে হত্যা করে ইসলামবিদ্বেষমূলক অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর উইলি ফাউট্রে বলেন, রাশিয়ায় স্লাভিক এবং অর্থোডক্স নাগরিকদের বাইরে বাকিরা দ্বিতীয় সারির নাগরিক এবং ইউক্রেনে পুতিনের যুদ্ধের জন্য শুধু কামানের খোরাক। প্রশ্ন হলো অ-অর্থোডক্স এবং নন-স্লাভিক জনগোষ্ঠীর জাতিগত রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ সামরিক অভিযান-এর শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের জনগণকে এভাবে ব্যবহার মেনে নেবেন।

ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের নেতৃত্বে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপে যোগদানকারী মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন ব্রাইলভ। তিনি বলেন, মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য অস্বাভাবিক নয়। যদিও মুসলিম চাকুরিজীবীদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে রুশ সেনাবাহিনী মুসলিম সেনাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের প্রয়োজনীয় অনুমতি দেয় না।

মস্কোর মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন মসজিদটি অন্যত্র ছোট স্থানে নির্মাণ করা হবে

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক রবার্ট ক্রুস বলেন, মুসলিমসহ অ-রাশিয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে এটি স্পষ্ট নয় রাশিয়ান জাতিগোষ্ঠীর না হওয়ার কারণে তাদেরকে কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও অনেক বিশ্লেষক এমন দাবি করছেন।

রবার্ট ক্রুস আরও বলেছেন, ইউরোপ ও অপর দেশের মতো বর্ণবাদ এবং ইসলামবিদ্বেষ রুশ সেনাবাহিনীতে সম্ভাব্য অস্থিরতা সৃষ্টিকারী উপাদান। যদিও ক্রেমলিনের অবস্থান হলো, ইসলাম একটি ‘ঐতিহ্যবাহী’ রুশ ধর্ম, এবং মুসলিমরা যুদ্ধ প্রচেষ্টার জন্য অপরিহার্য। অর্থোডক্স খ্রিস্টান প্রতীক এবং চিত্রাবলী প্রভাবশালী, কিন্তু তারা অন্তত ১৬ শতক থেকে সামরিক বাহিনীর একটি উপাদান হিসেবে ইসলামের প্রতি মনোযোগ বাদ দেয় নি। এর পক্ষে অনেক স্বীকারোক্তি রয়েছে।

রাশিয়ার মুসলিম নেতারা পুতিনের আক্রমণকে সমর্থন করেছেন। অর্থোড্রক্স খ্রিষ্টীয় যুক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর তা হলো, পশ্চিমা শত্রুদের ‘শয়তানোচিত’ আচরণ। কিন্তু উভয় ধর্মের সেনাদের জন্য ‘একটি পবিত্র যুদ্ধের’ ধারণা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এছাড়া মস্কোর পক্ষে লড়াইরত মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ব্রাইলভ বলছেন, রুশ সেনাবাহিনীতে চুক্তির আওতায় যোগদান অগ্রহণযোগ্য, এমন ধারণা রাশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ধারণা পোষণকারীরা যুদ্ধের জন্য ধর্মীয় বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদি শত্রুতার ক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে এবং পরিণতিতে মুসলিমদের নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে মুসলিম সেনাদের মধ্যে অসন্তোষ জন্মাবে বলে ধারণা করতে পারি।  যুদ্ধের পরে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মুসলিম যোদ্ধারা রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এবং সামরিক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উভয় ক্ষেত্রেই আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবেন।

যুদ্ধে উভয় পক্ষের মুসলমানরা লড়াই করছে। যারা ইউক্রেনের পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে তাদের মধ্যে ক্রিমিয়া এবং আজারবাইজানের মুসলিমরা রয়েছে। রুশ-বিরোধী চেচেনরা ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিল। কিয়েভ যারা চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এটি ১৯৯০ এর দশকে বিদ্যমান ছিল। চেচেন রাষ্ট্রের নামে অস্থায়ীভাবে রাশিয়ার দখলে।

কাদিরভ, প্রিগোজিন এবং সামরিক ব্লগাররা সবাই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেছেন। ইউক্রেনে রুশ সেনাদের ব্যর্থতায় মস্কোর পদক্ষেপ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আসছে। মস্কোর মসজিদ নিয়ে বিরোধ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রুশ সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

অনুসন্ধানী গবেষক ওলগা লাউটম্যান বলছেন, ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রে রাখতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু গত এক বছরে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাবাহিনী ক্ষয়ক্ষতি এবং অপমান সহ্য করে চলেছে। এখন আরও বেশি করে বিভাজন প্রকাশ্যে আসছে।  

সূত্র: নিউজউইক

/এএ/
সম্পর্কিত
দক্ষিণ লেবাননে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে ইসরায়েল
হিজবুল্লাহর ৪০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী