X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের প্রতিক্রিয়া

রক্তিম দাশ, কলকাতা
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:৪৪আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:৫৮

কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে ভারতজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ইহলোক থেকে অনন্তের পথে যাত্রা করেন এই সুরসম্রাজ্ঞী। তার প্রয়াণে বিষাদ নেমেছে কলকাতার সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করেছেন এই অঙ্গনের মানুষেরা।

এ সরস্বতীর বিসর্জন হয় না

হৈমন্তী শুক্লা

এটা কী সমাপতন! সরস্বতী বিসর্জনের দিন চলে গেলেন লতা দিদি। ঠাকুর বিসর্জনের পর আসছে বছর আবার আসে। কিন্তু লতা দিদি! তখনই মন বললো, এ সরস্বতীর বিসর্জন হয় না। তার অজস্র গানের মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন, অমর শিল্পীর মৃত্যু হয় না।

মনে পড়ছে প্রথম দেখার কথা। তখন লতা মঙ্গেশকর নাইট হতো। সেবার নেতাজি ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান। সুপ্রকাশ গড়গড়ি ফোন করে ডাকলেন। লতাজি গ্র্যাণ্ড হোটেলে উঠেছেন। উনি কিছু বাংলা গানের কথা ভুলে গিয়েছেন, সহযোগিতা করতে হবে। সাক্ষাৎ সরস্বতী দর্শন হলো যেন। কিছু গানের কথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তাকে মান্নাদার একটা গান শোনালাম। জানতে চাইলেন, শুক্লা পদবি কি বাঙালি? আমি জানিয়েছিলাম, আমার জন্ম, কর্ম সবই বাংলায়। আমি বাঙালি। তবে আমার বাবার দেশ উত্তরপ্রদেশ, লখনউ। শুনেই তার রায়, ওই জন্যই নাকি আমার গলা এতো মিষ্টি, সুরেলা।

এরপর একাধিকবার দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। মনে পড়ছে দুর্গাপুরে তার আবদারে সত্যম শিবম সুন্দরম-এর বিখ্যাত গানটি তার সঙ্গে কোরাস গেয়েছি। সেবার দুর্গাপুরে লতা মঙ্গেশকর নাইট হচ্ছে। আমরা বাংলার শিল্পীরাও রয়েছি। হঠাৎ সত্যম শিবম সুন্দরমের গান গাওয়ার সময় লতা দিদি আয়োজককে দিয়ে আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আমার এই গানে তুমি কোরাস গাইবে?’ অন্য কোনও শিল্পী অনুরোধ জানালে রাজি হতাম কিনা সন্দেহ। জীবন্ত সরস্বতীর সঙ্গে এক মঞ্চ ভাগ করার সুযোগ সেদিন কিন্তু ছাড়িনি!

তুফান ছবিতে লতাজির গানটা মনে পড়ছে

শকুন্তলা বড়ুয়া

প্রত্যেক যুগে মানুষের রূপ ধরে ভগবান আসেন। আমরা তাদের অবতার বলি। এ যুগে দেবী সরস্বতীর অবতার হিসেবে মর্ত্যে এসেছিলেন লতাজি। চলেও গেলেন সরস্বতী বিসর্জনের দিন। তবে এ যাওয়াতো যাওয়া নয়। তার গান চিরজীবী, সেই গানের সুরে উনি আমাদের স্মৃতিতে রয়ে যাবেন। শিল্পীর তো মৃত্যু নেই, তবুও চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।

আমার আজ সকাল থেকে তুফান ছবিতে লতাজির গাওয়া গানটার কথা বারবার মনে পড়ছে। ১৯৮৯ সালের ছবি। পরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীত পরিচালনায় স্বপন চক্রবর্তী। অভিনয়ে আমি, ইন্দ্রাণী দত্ত, তাপস পাল, অভিষেক, চিরঞ্জিৎ ছিলাম। দৃশ্যটা হলো আমার উদ্দেশ্যে ইন্দ্রাণী দত্ত গানটি গাইছে। ইন্দ্রাণীর লিপে ছিল গানটি। গানের কথাগুলো হলো, ‘যতোবার দেখি মাগো তোমায় আমি/ সাধ মেটে না মাগো তোমায় দেখে/ সবাই বলে ভগবান সুন্দর/ হবে নাতো সুন্দর তোমার থেকে।’

খুব জনপ্রিয় হয়েছিল গানটি। এই লাইনটাই আজ বারবার লতাজির জন্য মনে পড়ছে। তার মধ্যে একটা মাতৃভাব ছিল। ভগবান সুন্দর না তুমি সুন্দর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। তারপর ভুল ভাঙছে, মনে হচ্ছে বড় যত্ন করে লতাজিকে গড়েছিলেন, আজ নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলেন।

লতা মঙ্গেশকর আর আসবেন না

পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য

লতা মঙ্গেশকর আর আসবেন না। যদি কেউ ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারতো তার ইশারা পাওয়া যেতো। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে কেউ পারবে না। আমার যেটা অবাক লাগে সেটা হলো তার কণ্ঠস্বর। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গলার 'টোনাল কোয়ালিটি' বদলে যায়। কিন্তু লতাজির বয়স বাড়লেও কণ্ঠস্বরে কোনও বদল আসেনি। সেই কিশোরী বেলার গলা। এটা আমাকে আশ্চর্য করে। কোন জাদুবলে এটা তিনি সম্ভব করেছিলেন?

সবচেয়ে বড় কথা, ভেবে আশ্চর্য হতে হয় একটা মানুষ কতো হিট গান গাইতে পারেন! আজ সকাল থেকে বিভিন্ন এফ এম চ্যানেলে তার অসংখ্য হিট গান শুনছিলাম। আর ডি বর্মনজির গানও শুনছিলাম, লতাজির সব গানই হিট। যদিও আর ডি বর্মন আশাজিকে দিয়েই বেশি গান গাইয়েছিলেন।

এই মুহূর্তে আমার আরও বেশি করে যেটা মনে হচ্ছে লতাজি নিজের স্থানটা একভাবে, এক উচ্চতায় ধরে রেখেছিলেন। একভাবে যুগকে ধরে রাখা কম আশ্চর্যের নয়। সমস্ত শিল্পীদের উত্থান হয়, পতন হয়। কিন্তু লতাজি একভাবে নিজের গানকে ধরে রেখেছিলেন।

তার সঙ্গে কাজ করার একটা স্মৃতি আছে। একটা হিন্দি ছবির ট্র্যাকে কাজ করেছিলাম। উনি ডাবিংয়ে এসেছিলেন। তবে আলাপের সুযোগ ছিল না। আজ সব স্মৃতি। এখন যেমন তার হিট গানগুলোর ' কভারের' কাজ করছি। এই কাজের মধ্যে তাকে মনে করবো।

লতাজির সঙ্গে একমঞ্চে, সেরা মুহূর্ত

লোপামুদ্রা মিত্র

একটা অদ্ভুত সকাল। সরস্বতী পুজোর বিসর্জনের দিন জীবনের মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন 'জীবন্ত সরস্বতী' লতাজি। আমাদের ছেলেবেলা থেকে বড় হওয়া তার গান গুনগুনিয়ে। তখন ভাবিনি নিজে সঙ্গীত শিল্পী হবো। তবে মাঝে মাঝে ভাবতাম যদি কখনও লতাজির সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়! সেই স্বপ্ন সত্যি হবে ভাবিনি। যদিও কিশোর কুমারকে সামনাসামনি দেখতে না পাওয়ার আফসোসটা থেকেই গিয়েছে।

সালটা এক্ষুনি মনে পড়ছে না। বেশ কিছু বছর আগে সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে লতাজির সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চ শেয়ার করার সৌভাগ্য হয়েছিল। যদিও কথা বলার সুযোগ হয়নি।‌ লতাজির অন্য বোনেরাও সেদিন মঞ্চে ছিলেন।

এখন লতাজির গানই স্মৃতি। আমার খুব প্রিয় দুটি গান শচীন দেব বর্মনের সুর দেওয়া অভিমান ছবির বিখ্যাত গান ‘নদীয়া কিনারে... আয়ি কঙ্গনা' গুনগুনিয়ে উঠবেন জগজিৎ সিংহের সঙ্গে লতাজির গজল অ্যালবাম ‘সাজদা’র জনপ্রিয় গজল— ‘দর্দ সে মেরা দামন ভর দে ইয়ার।’

লতাজি ফোনে ভজন শিখিয়েছিলেন

উস্তাদ রশিদ খান

সকালে উঠে চরম দুঃসংবাদ পেলাম। লতাজি নেই, শনিবার সরস্বতী পুজো গেল, আর আজ উনি নেই। লতাজি আমার মায়ের‌ মতো। ফোনে আমাকে ভজন শিখিয়েছিলেন। আমার তখন ২৭-২৮ বছর বয়স। ‘বৈষ্ণব জন তো’ ভজনটি রেকর্ড করা হবে। সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য। কে শেখাবেন গানটি? আমি ফোনে লতাজিকে অনুরোধ করলাম গানটা তোলানোর জন্য। সঙ্গে সঙ্গে উনি রাজি, ফোনে সেই গানটি আমাকে তুলিয়ে দেন। সেই স্মৃতি আমি কখনও ভুলতে পারবো না।

আসলে লতাজির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল একেবারে পারিবারিক। উনি আমাকে বলেছিলেন, তার বাবা আমার দাদুর তান তুলেছিলেন। আমার গুরু, দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ সাহেবের সঙ্গে তার বাবার ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি লতাদিদির গান খুব পছন্দ করতেন। লতা দিদিও বলেছেন, দাদুর তান অনেক সময় উনি অনুসরণ করতেন। হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও তিনি সেসব কাজে লাগাতেন। আমার মামা উস্তাদ গুলাম মোস্তাফা খাঁ সাহেবের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গান নিয়ে তাদের মধ্যে বহু কথাবার্তা হতো।

প্রথম আলাপ ১৯৮৫-তে না ৯০-এ ঠিক মনে পড়ছে না। মুম্বাইতে একটা অনুষ্ঠানে। শেষ দেখা ২০১৪ সালে গোয়াতে। ওখানে তার বাবার নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। আমার গান শুনতে তিনি হাজির হন গোয়া। পুরো অনুষ্ঠান তিনি সামনে থেকে বসে শুনেছিলেন। তিনি আমার কাছে এসে বলেন ‘আল্লাহতালা নে ক্যায়া গলা দিয়া হ্যায়!’ আমি একটু হেসে বললাম, ‘দিদি তুমি এই কথা বলছো! সবাই জানে তোমাকে ঈশ্বর কত সুরেলা কণ্ঠ দিয়েছেন। আমি এসবের যোগ্য নই।’ আজ সব স্মৃতি।

সঙ্গীত জগতে বিরাট শূন্যতা

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

লতা মঙ্গেশকর ছিলেন, এখন নেই, বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করলো। উনি সম্প্রতি বছর দশেক হয়তো গান গাননি। তবুতো মাথার ওপরে ছিলেন। থাকা না থাকার মধ্যে যে তফাৎটা হয় আর কি। কত গান গেয়েছেন, দুশোর মতো বাংলা গান গেয়েছেন, এমনিতে তো ৩০ হাজারের মতো গান গেয়েছেন। তার চলে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি করেছে।

আমার তার সঙ্গে কখনও দেখা হওয়া বা পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। আমিতো সেই অর্থে গানের বা সাংস্কৃতিক জগতের লোক নেই। তাই স্বাভাবিক কারণেই অপরিচয়ের আড়াল‌ রয়ে গিয়েছে। তবে আমি অন্যদের মতোই তার গানের গুণমুগ্ধ। গানে, সুরেই বেঁচে থাকবেন লতা মঙ্গেশকর।

/এমপি/
সম্পর্কিত
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন