X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধু যখন শত্রু: সৌদি যুবরাজের সঙ্গে আমিরাতের প্রেসিডেন্টের বিরোধ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৮ জুলাই ২০২৩, ২১:০৯আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৩, ১৬:০৩

সৌদি আরবের প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ডিসেম্বরে রিয়াদে স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি অফ-দ্য রেকর্ড ব্রিফিংয়ে জড়ো করেছিলেন। সেখানে তিনি এক অবাক করা বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন দেশটির কয়েক দশকের মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘সৌদি আরবের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে’।

বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মতে, সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘তারা দেখবে আমি কী করতে পারি’।

৩৭ বছর বয়সী যুবরাজ ও তার একসময়ের পরামর্শদাতা আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য হচ্ছে। যা মধ্যপ্রাচ্য এবং বৈশ্বিক তেলের বাজারে ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিযোগিতার প্রতিফলন। দুটি দেশের রাজপরিবারের এই দুই সদস্য আরব বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে প্রায় এক দশক সময় নিয়েছেন। এখন তারা মধ্যপ্রাচ্যে কে প্রভাবশালী, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। বর্তমানে অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, উপসাগরীয় দেশ দুটির বিরোধ ইরানকে মোকাবিলায় একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন, ইয়েমেনের ৮ বছর ধরে চলমান সংঘাত এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণকে কঠিন করে তুলতে পারে।

মুহাম্মদ বিন সালমান ও শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। ছবি: সৌদি রাজ প্রাসাদ

বাইডেন প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, অঞ্চলটির নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি রয়েছেন। কিছু মাত্রায় তারা এখনও একত্রে কাজ করছেন। কিন্তু এখন তাদের কেউ-ই একই নৌকায় থাকতে স্বস্তিবোধ করছেন না। মোটকথা, তাদের একে অপরের মুখোমুখি থাকা আমাদের জন্য সহযোগিতামূলক নয়।

একসময় ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই দুই ব্যক্তি। সৌদি যুবরাজ এমবিএস এবং ৬২ বছর বয়সী আমিরাতের প্রেসিডেন্ট এমবিজেড নামে পরিচিত। তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বলেছেন, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলেননি এবং পর্দার আড়াল থেকে বিরোধ প্রকাশ্য হচ্ছে।

ইয়েমেনে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। এই বিষয়টি দেশটির সংঘাত অবসানের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেলের মূল্য বাড়াতে সৌদি আরবের চাপে হতাশ আমিরাত। এটি আবার তেল উৎপাদনকারীদের সংগঠন অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ বা ওপেক-এ নতুন ফাটল ধরাচ্ছে।

দুই দেশ ক্রমেই অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। তেলের ওপর সৌদি আরবের নির্ভরশীলতা কমাতে এমবিএসের পরিকল্পনা অনুসারে, আমিরাতের দুবাই থেকে বিভিন্ন কোম্পানির সদর দফতর রিয়াদে স্থানান্তরের চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব। দীর্ঘদিন ধরে দুবাই পশ্চিমাদের কাছে অনেক বেশি আধুনিক মনোভাবাপন্ন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। সৌদি যুবরাজ টেক সেন্টার স্থাপন, আরও বেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করা এবং লজিস্টিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিচিত। মার্চ মাসে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নতুন একটি এয়ারলাইন কোম্পানি চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। যা দুবাইয়ের উচ্চতর র‍্যাংকিংয়ে থাকা এমিরেটসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে।

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ। ছবি: রয়টার্স

অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে, ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব নিউক্যাসল কিনেছে সৌদি আরব। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল তারকাদের পেছনে বিনিয়োগ করছে দেশটি। যেমনটি করে আসছিল ম্যানচেস্টার সিটি–যে ক্লাবের মালিক আবুধাবির রাজপরিবারের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইতোমধ্যে দলটি ইংলিশ লিগ ও ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে।

উপসাগরীয় কর্মকর্তাদের মতে, আমিরাতের প্রেসিডেন্ট এমবিজেড সৌদি আরবের রাজপরিবারের এক সদস্যের ওপর বিরক্ত। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা মনে করে তিনি গুরুতর কিছু ভুল করেছেন।

ইরানের সঙ্গে চুক্তি

সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা এক আমিরাতি কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মন্তব্যের অনুরোধের জবাবে দাবি করেছেন, সম্পর্কে টানাপড়েনের দাবি ‘স্পষ্টত মিথ্যা এবং কোনও ভিত্তি নেই’। সৌদি আরবের কর্মকর্তারা এমন ধারণাকে ‘একেবারে সঠিক নয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সৌদি কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক অংশীদার সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আমাদের নীতিগুলো দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিস্তৃত ইস্যুতে একত্রে মিলিত হয়েছে। রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দেশ দুটি উপসাগরীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একত্রে কাজ করে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তা বলেছেন, আঞ্চলিক সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত। 

রিয়াদে আরব সম্মেলনে যোগ দেননি আমিরাতি প্রেসিডেন্ট। ছবি: রয়টার্স

ডিসেম্বরে ইয়েমেন নীতি ও ওপেকের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিভাজন তীব্র হওয়ার পর এমবিএস স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে ওই বৈঠকটি ডেকেছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিরা বলেছেন, সৌদি নেতা বলেছিলেন, আমিরাতের কাছে তিনি কয়েকটি দাবির একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। যুবরাজ সতর্ক করে বলেছিলেন, উপসাগরীয় ছোট দেশগুলো যদি রাজি না হয় তাহলে সৌদি আরব শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত আছে। যেমনটি ২০১৭ সালে কাতারের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় দেশটির সঙ্গে কূটনীতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ। প্রায় তিন বছর এই অর্থনৈতিক বয়কট জারি ছিল। এতে সহযোগিতা করে আবুধাবি।

বৈঠকে থাকার ব্যক্তির মতে, সাংবাদিকদের যুবরাজ বলেছিলেন, ‘কাতারের সঙ্গে আমি যা করেছি এটি হবে তারচেয়ে ভয়াবহ’।

ডিসেম্বরের ওই বৈঠকের পর এমবিএস একাধিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং এগুলোর মাধ্যমে তার রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান হয়েছে। ২০১৮ সালে সৌদি হিট টিম সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার পর এই বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছিল।

ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তিনি চীনের দ্বারস্থ হন। এরপর তিনি আরব লিগে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনার কলকাঠি নাড়েন। কয়েক বছর আগে এই উদ্যোগ নিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১১ সালে পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করা বেসামরিকদের ওপর প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নির্মম দমন-পীড়নের পর আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এমবিএস, যা ২০২০ সালে করে ফেলেছে সংযুক্ত আরব আমিরা। সুদানে সহিংসতা দমনে কূটনৈতিক উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমবিএস, দেশটিতে বিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে আমিরাত।

দুই দেশের কর্মকর্তাদের মতে, উত্তেজনা প্রশমিত করতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের অভিযোগ ও দাবি আদান-প্রদান করেছে।

উপসাগরীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, সৌদি অভিযোগের জবাবে এমবিজেড গত বছর একান্ত আলোচনায় সৌদি শাসককে সতর্ক করে বলেছেন, তার পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তেলনীতি নিয়ে সৌদি যুবরাজ রাশিয়ার অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন এমবিজেড। যেমন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আলোচনা না করে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তি।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ছবি: রয়টার্স

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রিয়াদ সফরের সময় এমবিএস একটি আরব সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এমবিজেড তাতে হাজির হননি। এছাড়া মে মাসে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনতে আরব লিগের ভোটেও উপস্থিত ছিলেন না তিনি। আবার জানুয়ারিতে আরব নেতাদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে যে আঞ্চলিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন এমবিজেড, তাতে হাজির হননি সৌদি যুবরাজ।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির সিনিয়র উপদেষ্টা দিনা এসফানদিয়ারি বলেন, তাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। কারণ, আমিরাতি প্রেসিডেন্টের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন সৌদি যুবরাজ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ উভয় দেশ নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছে।

জোট গঠন

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিজেদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দাবি করে। কিন্তু একসময় তাদের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বাধীনতা লাভের আগেও তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ আল নাহিয়ান আরব উপদ্বীপে সৌদি আধিপত্যের বিরোধিতা করেছিলেন। কয়েক বছর প্রতিবেশী দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ভূখণ্ডগত বিরোধে সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিলেন সৌদি বাদশাহ। ২০০৯ সালে রিয়াদে উপসাগরীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তোলার সৌদি পরিকল্পনা ঠেকিয়ে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখনও তেলসমৃদ্ধ দেশ দুটির মধ্যে ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধ রয়েছে।

এমবিজেড ও এমবিএস-এর উত্থানের সময়ে দেশ দুটি ঘনিষ্ঠ হয়। ২০১৪ সালে সৎভাই প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ স্ট্রোক করার পর ৫৪ বছর বয়সে আমিরাতের ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিজেড। আর ২০১৫ সালে বাবা বাদশাহ সালমান সিংহাসনে বসার পর ক্ষমতা সুসংহত করতে শুরু করেন এমবিএস। ওই সময় মাত্র ২৯ বছর বয়সী তরুণ সৌদি রাজকুমারকে পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন এমবিজেড।

জি-২০ সম্মেলনে পার্শ্ববৈঠকে আমিরাতি প্রেসিডেন্ট ও সৌদি যুবরাজ। ছবি: রয়টার্স

সৌদি মরুভূমিতে মধ্যরাতের একটি ক্যাম্পে সময় কাটানোর আগে দুই ব্যক্তি একে অপরকে খুব বেশি চিনতেন না। ওই সফরে তাদের সঙ্গে ছিল প্রশিক্ষিত বাজপাখি ও অনুগামীদের ছোট একটি দল। এই ঘটনাটি ছিল তাদের বন্ধুত্বের টার্নিং পয়েন্ট। ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এমনটি জানিয়েছেন। 

এমবিএস যখন সৌদি আরবের উপ-যুবরাজ ছিলেন তখন থেকেই ট্রাম্প প্রশাসনে তার পক্ষে লবিংয়ে এমবিজেড ও সিনিয়র আমিরাতি কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০১৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের আয়োজনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিলেন এমবিজেড। যা এমবিএসকে শক্তিশালী করেছিল। পরের মাসে সৌদি রাজকুমার একটি প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেকে যুবরাজের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। এরপর তিনি সমালোচক ও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিশ্চিহ্ন করা শুরু করেন।

রক্ষণশীল রাজ্যকে উন্মুক্ত ও বদলানোর পরিকল্পনা করতে এমবিজেডের পরামর্শ গ্রহণ করেন এমবিএস। আমিরাতিরা এক দশক যেসব ব্যাংক ও পরামর্শদাতাদের কাজে লাগিয়েছিল তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।

সৌদি যুবরাজ ও আমিরাতি প্রেসিডেন্ট একটি পররাষ্ট্রনীতি জোট গড়ে তুলেন। যার মাধ্যমে ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ, মিসরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা, বিভক্ত লিবিয়া যোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ এবং ইরান ও উগ্রবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ তুলে কাতারকে বয়কট করা হয়।

উপসাগরীয় কর্মকর্তারা বলছেন, দুই নেতাই এসব হস্তক্ষেপ থেকে নিজেদের বের করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমবিএস এখন মনে করেন আমিরাতি প্রেসিডেন্ট তাকে এসব বিপর্যয়কর সংঘাতে জড়িত করেছেন, যেগুলো সৌদি আরব নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বার্থ রক্ষা করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের অনাবাসিক স্কলার ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডগলাস লন্ডন বলেন, ‘এমবিএস আমিরাতি প্রেসিডেন্টকে পছন্দ করেন না এবং তিনি তাকে দেখে নিতে চান।’ তিনি বলেছেন, ইরান ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে।

ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসল ফুটবল ক্লাব কিনেছে সৌদি আরব। ছবি: রয়টার্স

তবে তিনি আরও বলেছেন, সৌদি আরবকে নেতৃত্ব দিতে সৌদি যুবরাজ অনেক বেশি বাস্তবসম্মত প্রবণতা গ্রহণ করেছেন। ফলে তিনি হয়তো সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তাড়াহুড়ো করবেন না। 

ওপেক বিরোধ

এই বিরোধটি প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। ওই সময় রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ১৩ সদস্য রাষ্ট্রের জোট ওপেক তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। প্রকাশ্যে তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত সমর্থন করে আমিরাত। কিন্তু একান্ত আলাপে দেশটির পক্ষ থেকে মার্কিন কর্মকর্তা ও সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়েছে, সৌদি আরব তাদের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছে।

এই জটিলতা ওপেক নীতি নিয়ে সৌদি ও আমিরাতের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের প্রতিফলন। এই জোটে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বজায় রেখেছে বিশ্বের শীর্ষ অপরিশোধিত তেল রফতানিকারক দেশ সৌদি আরব। আমিরাতিরা নিজেদের তেলের উৎপাদন সক্ষমতা প্রতিদিন ৪০ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করেছে। এই সক্ষমতা ৫০ লাখে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু ওপেক নীতির কারণে তারা দিনে ৩০ লাখের বেশি তেল উৎপাদন করতে পারছে না। এতে কোটি কোটি ডলার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশটি।

আমিরাতের তেলের উৎপাদন বাড়ানোর সামর্থ্য বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের তেলের বাজারে দামের উত্থান-পতনে দেশটির সম্ভাব্য ভূমিকা জোরদার হতে পারে। অতি সম্প্রতি তেলের বাজারে এমন ক্ষমতা শুধু সৌদি আরবের দখলে ছিল।

উপসাগরীয় ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, আমিরাতি কর্মকর্তাদের হতাশা এমন তীব্রতায় পৌঁছেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বলেছেন, তারা ওপেক থেকে বেরিয়ে যেতে প্রস্তুত। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এটিকে আমিরাতের ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে নিয়েছেন, প্রকৃত হুমকি হিসেবে নয়। জুনে ওপেকের সর্বশেষ বৈঠকে আমিরাতিদের কিছুটা উৎপাদন বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সৌদি তেলমন্ত্রীর সঙ্গে আমিরাতি মন্ত্রীকে করমর্দন করতে দেখা গেছে।

ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের মালিক আবুধাবির রাজপরিবারের এক সদস্য। ছবি: রয়টার্স

ইয়েমেনে সংঘাত

দুই নেতার বিরোধ ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগকে ভেস্তে দিতে পারে। এই সংঘাতে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইয়েমেনের একটি গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে সৌদি ও আমিরাত। ২০১৪ রাজধানী সানাসহ দেশটির বড় অংশ দখল করে হুথিরা।

ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই গোষ্ঠী চায় দেশটির দক্ষিণে একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। এর ফলে দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আবার সৌদি ও আমিরাত সমর্থিত যোদ্ধারা হুথিদের পরাজিত করতে একসঙ্গে কাজ করছে। কয়েক বছর ধরে তাদের মধ্যে সংঘাত চলছে।

ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনের প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে ইয়েমেন ও উপকূলের পানিতে তারা হস্তক্ষেপের অধিকার পেয়েছে। সৌদি আরবের কর্মকর্তারা এটিকে তাদের ইয়েমেন কৌশলের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

সৌদি আরব থেকে আরব সাগর হয়ে ইয়েমেনের হাদ্রামাউত পর্যন্ত একটি পাইপলাইন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে রিয়াদে। আঞ্চলিক রাজধানী মুকাল্লার একটি সমুদ্র বন্দর হলো হাদ্রামাউত। অঞ্চলটিতে সক্রিয় আমিরাত সমর্থিত গোষ্ঠী এই পরিকল্পনার জন্য হুমকি।

ইয়েমেনে ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের। ছবি: রয়টার্স

লন্ডনভিত্তিক স্বাধীন থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, ইয়েমেনি শক্তিগুলো নতুন সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা চলমান শান্তি আলোচনাকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে। তাদের ধারাবাহিক টুইটার পোস্টে বলা হয়েছে, দুই উপসাগরীয় রাজপরিবার আরও শক্তি প্রদর্শন করছে এবং অঞ্চলটিতে একে অপরের বিরুদ্ধে অনেক বেশি আগ্রাসী আচরণ করছে। ইয়েমেন প্রথম এবং সক্রিয় রণক্ষেত্র।

ইয়েমেনি কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরব যদি এখন ইয়েমেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে তাহলে হুথি নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং দক্ষিণাঞ্চল ঘনিষ্ঠ হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের। তখন যুদ্ধে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকবে না রিয়াদের। ইয়েমেনি কর্মকর্তাদের এই বক্তব্যে সৌদি আরবের উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে।

বাইডেনের লক্ষ্য

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৈরিতায় বিরক্ত বাইডেন প্রশাসন। তারা চায়, রিয়াদ ও আবুধাবির মতো উপসাগরীয় রাজধানীগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, যা ইরানের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনে সহযোগিতা করবে। মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা ইয়েমেনের যুদ্ধ অবসানও বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। তেলের বাজার ও অঞ্চলটিতে স্থিতিশীলতা চায় যুক্তরাষ্ট্র।

বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওয়াশিংটনের পুরোপুরি একমত নন এমবিএস কিংবা এমবিজেড। যেমন- ইউক্রেন ও চীন। মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে এমবিজেড সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হওয়ায় ক্রমেই উদ্বিগ্ন হচ্ছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। এই দুটি দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক আগেই গড়ে তুলেছেন এমবিএস।

সৌদি আরব সফরে যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ছবি: রয়টার্স

সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার ঘটনায় সৌদি আরবকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন বাইডেন। এমবিএস দাবি করেছেন তিনি এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেননি। যদিও ২০২২ সালের জুলাই মাসে বাইডেন সৌদি আরব সফর করেছেন। যা সৌদি যুবরাজের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে সহযোগিতা করেছে। যেসব কোম্পানি সৌদি আরবে বিনিয়োগে দ্বিধায় ছিল তারা এখন নতুন করে ভাবছে। রিয়াদে কোম্পানিগুলোর কার্যালয় স্থাপনে এই বছরের শেষ পর্যন্ত সময়সীমা থাকায় এই প্রবণতা গতি পেতে পারে।   

যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় ৭ মে সৌদি যুবরাজ ও আমিরাতি প্রেসিডেন্টের ছোট ভাই শেখ তাহনুন বিন জায়েদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এক সময় শেখ তাহনুনকে সৌদি যুবরাজের পছন্দের বলে মনে করা হতো। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই কথা বলেছেন। তারা বলছেন, কিন্তু তাহনুন ছয়বার সৌদি আরব গেলেও তিনি যুবরাজের সাক্ষাৎ পাননি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বৈঠকে তাহনুনকে সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইয়েমেনের যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করা উচিত হবে না আমিরাতের। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব এবং আমিরাতকে তারা ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু পরে তিনি নিজের উপদেষ্টাদের বলেছেন, আমিরাতকে নিয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করা উচিত হবে না।

ওই ব্যক্তিরা বলছেন, তিনি উপদেষ্টাদের বলেছেন, ‘আমি এখন আর তাদের বিশ্বাস করি না’।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে।

/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হিন্দুত্ববাদে ভরসা মোদির?
লোকসভা নির্বাচনবিজেপি ও তৃণমূলের মাথাব্যথা এখন কম ভোটার উপস্থিতি
লোকসভা নির্বাচন: তৃতীয় ধাপের ভোটে হেভিওয়েট প্রার্থী যারা
সর্বশেষ খবর
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
শীর্ষ ঋণখেলাপি লস্করের সম্পত্তি ওসির জিম্মায় দিলেন আদালত
শীর্ষ ঋণখেলাপি লস্করের সম্পত্তি ওসির জিম্মায় দিলেন আদালত
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হিন্দুত্ববাদে ভরসা মোদির?
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হিন্দুত্ববাদে ভরসা মোদির?
প্রথম ধাপের প্রার্থীদের ৫৬ শতাংশই ব্যবসায়ী: টিআইবি
উপজেলা নির্বাচনপ্রথম ধাপের প্রার্থীদের ৫৬ শতাংশই ব্যবসায়ী: টিআইবি
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র