মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা জাহাজে হামলা বন্ধ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হামলা অব্যাহত থাকবে। শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণঘাতী হামলার জবাবে হুথিরা পাল্টা হামলা চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। এই হামলায় কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়েছে, যা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, এই অভিযান বেশ কিছুদিন ধরে চলতে পারে।
হুথি আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরো এই হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে এবং বলেছে, হুথি বাহিনী ‘হামলার জবাবে হামলা চালাতে প্রস্তুত’। এদিকে মস্কো ওয়াশিংটনকে হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ফক্স নিউজকে বলেন, ‘যে মুহূর্তে হুথিরা বলবে আমরা তোমাদের জাহাজে গোলাবর্ষণ বন্ধ করব, আমরা তোমাদের ড্রোনে গোলাবর্ষণ বন্ধ করব, সেই মুহূর্তে এই অভিযান শেষ হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত এটি নির্মমভাবে চলতে থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি জাহাজে গোলাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য... এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথে নৌচলাচলের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা যুক্তরাষ্ট্রের মূল জাতীয় স্বার্থ এবং ইরান দীর্ঘদিন ধরে হুথিদের সমর্থন দিয়ে আসছে। তাদের পিছু হটতে হবে।’
গত এক দশকে ইয়েমেনের বেশিরভাগ অংশ দখল করা হুথিরা গত সপ্তাহে বলেছে, গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা না তুলে নিলে তারা লোহিত সাগর দিয়ে যাওয়া ইসরায়েলি জাহাজে হামলা চালানো পুনরায় শুরু করবে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা গাজার ফিলিস্তিনিদের সংহতিতে জাহাজে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে।
ট্রাম্প হুথিদের প্রধান সমর্থক ইরানকেও এই গোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেয়, ‘আমেরিকা আপনাকে পুরোপুরি দায়ী করবে এবং আমরা এ বিষয়ে নরম হব না!’
এর জবাবে ইরানের বিপ্লবী গার্ডসের প্রধান হোসেইন সালামি বলেছেন, হুথিরা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে বলেন, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের সতর্ক করছি যে, যদি তারা তাদের হুমকি বাস্তবায়ন করে, তাহলে ইরান নির্ণায়ক ও ধ্বংসাত্মক জবাব দেবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সিবিএস নিউজের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ইরানের সমর্থন ছাড়া হুথিদের এই ধরনের কাজ করার ক্ষমতা থাকার কোনও উপায় নেই। তাই এটি ইরানের জন্য একটি বার্তা: তাদের সমর্থন করা বন্ধ করুন, কারণ তারা নৌজাহাজ ও বৈশ্বিক জাহাজ চলাচলে হামলা চালালে আপনিও এর জন্য দায়ী হবেন।’
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ রুবিওকে ফোন করে ‘বলপ্রয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করার এবং সব পক্ষের রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেওয়ার গুরুত্বের’ কথা বলেছেন বলে মস্কো জানিয়েছে।
ট্রাম্প ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাশিয়ার স্বাক্ষর আদায়ের চেষ্টা করছেন, যা গত সপ্তাহে কিয়েভ মেনে নিয়েছে। তবে মস্কো বলেছে, এটির পুনর্বিবেচনা করা দরকার। ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য রাশিয়ার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং নিষেধাজ্ঞার চাপ বাড়াচ্ছেন।
হুথি-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আনিস আল-আসবাহি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত ৩১ জনের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া ১০০ এর বেশি মানুষ আহত হয়েছে। সানার বাসিন্দারা বলেছেন, হামলাগুলো হুথি নেতৃত্বের বেশ কয়েকজন সদস্যের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত একটি এলাকায় হয়েছিল।
এক বাসিন্দা, যিনি নিজের নাম আবদুল্লাহ ইয়াহিয়া বলে জানিয়েছেন, বলেন, বিস্ফোরণগুলো এতই ভয়াবহ ছিল যে এটি আমাদের নারী ও শিশুদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
সানায় একটি ক্রেন ও বুলডোজার ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরানো হচ্ছিল এবং মানুষ খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ছিল। একটি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা করা হচ্ছিল, যাদের মধ্যে শিশুও ছিল।
রয়টার্সের ফুটেজে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন নিহতের দেহ প্লাস্টিকের চাদরে মুড়ে হাসপাতালের আঙিনায় রাখা হয়েছে।
দুই প্রত্যক্ষদর্শী রবিবার বলেছেন, তাইজ শহরে হুথিদের সামরিক স্থাপনাগুলোও হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল। আল-মাসিরা টিভি রবিবার ভোরে জানায়, দাহিয়ান শহরের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দাহিয়ান শহরেই হুথিদের রহস্যময় নেতা আবদুল মালিক আল-হুথি প্রায়ই দর্শনার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
হুথিদের জাহাজে হামলা বৈশ্বিক বাণিজ্য বিঘ্নিত করেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে একটি ব্যয়বহুল অভিযান শুরু করতে বাধ্য করেছে। জানুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে হুথিরা তাদের অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল। কিন্তু ১২ মার্চ হুথিরা বলেছে, গাজায় ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ পুনরায় অনুমোদন না করা পর্যন্ত ইসরায়েলি জাহাজে হামলা চালানোর তাদের হুমকি বলবৎ থাকবে।
জো বাইডেনের পূর্ববর্তী প্রশাসনও হুথিদের আক্রমণ ক্ষমতা দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ট্রাম্প আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের অনুমোদন দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড শনিবারের হামলাকে ইয়েমেনজুড়ে একটি বড় আকারের অভিযানের সূচনা বলে বর্ণনা করেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, লোহিত সাগরে অবস্থিত বিমানবাহী জাহাজ হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমান দ্বারা এই হামলা চালানো হয়েছিল।
ইরান এই হামলাকে জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘ইরানের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের কোনও অধিকার বা কাজ নেই’।