X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

কাশ্মিরকে ফিলিস্তিন বানাতে চাইছে মোদি সরকার?

বাধন অধিকারী
০৬ আগস্ট ২০১৯, ০৪:৩৫আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৯, ২০:৪২

ভারতের সংবিধানে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের যে নিশ্চয়তা ছিল, মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর এর অন্তর্গত ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মিরিদের বিশেষ সুবিধাও বাতিল হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।  ‘৩৫-এ’ অনুযায়ী কাশ্মিরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা ছিল। মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে সেই বাধা দূর হয়েছে। এখন চাইলেই যে কোনও ভারতীয় নাগরিক সেখান ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদ কিনতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মিরিদের বিশেষ সুবিধা অকার্যকর করার মধ্য দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চরিত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে বিজেপি। বিশ্লেষকদের মতে, মোদি সরকার আদতে কাশ্মিরে হিন্দু বসতি ও শিল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। এই সিদ্ধান্তকে তাই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রশ্নে ইসরায়েলি নীতির সঙ্গে তুলনা করছেন কেউ  কেউ। তারা বলতে চাইছেন, কাশ্মিরকে ফিলিস্তিন বানানোর পাঁয়তারা করছে হিন্দুত্ববাদী সরকার। 

শ্রীনগরের রাস্তায় ভারতীয় সেনা

৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে থাকা ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিশেষ অধিকারের বদৌলতে এতোদিন ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মিরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের জমি বা সম্পত্তি কেনার সুযোগ ছিল না। সেখানকার সব ধরনের সরকারি চাকরি বা ট্রেড লাইসেন্সও বরাদ্দ ছিল শুধুমাত্র রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য। আর কাদের স্থায়ী বাসিন্দা বলা হবে, সেই কঠোর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষমতাও ছিল রাজ্য বিধানসভার হাতেই। তবে সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একইদিনে কাশ্মিরকে সরাসরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে রাজ্যসভায় একটি বিলও পাস করা হয়।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাধারণত এমন সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন হয়। তবে জম্মু-কাশ্মিরে এখন কেন্দ্রীয় শাসন চলছে। গত জুনে মেহবুবা মুফতির পিডিসি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে বিজেপি। আর তখনই রাজ্যটি সরাসরি কেন্দ্রের শাসনাধীন হয়। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব সিএনএনকে বলেছেন, এই কেন্দ্রীয় শাসন জারির মধ্য দিয়েই জম্মু-কাশ্মিরের সুরক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে থাকা ৩৭০ ধারা বাতিলের পথ করে নিয়েছে বিজেপি সরকার।
জ্যাকব মনে করেন, যেভাবে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মধ্য দিয়ে ৩৭০ ধারার বিলোপ করা হয়েছে, তার আইনত ভিত্তি দুর্বল। তিনি বলেন, ‘আদালতে এই আদেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তবে আমার মনে হয় না বিজেপি সেটা নিয়ে চিন্তিত। যেনতেনভাবে তারা এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখবে এবং এই বাস্তবতা দীর্ঘ হবে। এই দীর্ঘ সময়কে কাজে লাগিয়ে বিজেপি রাজ্যটাকে ব্যাপকভাবে বদলে ফেলার চেষ্টা করবে। এখন আইনত সেখানে কোনও বিরোধী নেই। কেবলমাত্র গভর্নর আছেন যিনি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতার এখতিয়ার রাখেন। তবে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়োজিত।’
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পাশাপাশি জম্মু-কাশ্মিরের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার বিল পাস করেছে বিজেপি সরকার। ভারতীয় বিধি অনুযায়ী, স্থানীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারই গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষীয় ভূমিকা পালন করার এখতিয়ারভুক্ত। তবে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারই শাসনব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক। সোমবার কাশ্মিরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে একটি বিল ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে পাস হয় এবং শিগগিরই এটি নিম্নকক্ষে তোলা হবে। জ্যাকব বলেছেন, ‘একটি রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। তবে জম্মু-কাশ্মিরের রাজনীতির আমূল ও মৌলিক পরিবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর। একবার একটি রাজ্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হলে সেখানকার রাজ্যসভার আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকে না।’
বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিজেপির এক নির্বাচনি পোস্টার ছিল ‘আপকা সাহি ভোট কাশ্মিরমে আপকো প্লট দিলা সাকতা হ্যায়’। হিন্দি ভাষার ওই নির্বাচনি স্লোগানের অর্থটা হলো, আপনি যদি ঠিকমতো ভোট দিয়ে (বিজেপিকে) জেতান, তাহলে আপনার কাশ্মিরে জমি কেনার স্বপ্নও সফল হবে। সেই ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন ভারতের অন্য অংশের নাগরিকরাও কাশ্মিরে গিয়ে জমি-বাড়ি কিনতে পারবেন। চাইলে টাটা বা বিড়লা শিল্পগোষ্ঠী জমি কিনে সেখানে কারখানাও গড়তে পারবে। লন্ডন-ভিত্তিক জাস্টিস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অধ্যাপক শল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের আগেই অন্তত দুটি পদক্ষেপ থেকেই পরিষ্কার আঁচ করা যাচ্ছিল বিজেপি সরকার কাশ্মিরের আবহমানকালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে চাইছে। প্রথমত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মিরের জন্য যে ‘ডোভাল ডকট্রিন’ প্রণয়ন করেছিলেন, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাই ছিল ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজনকে কাশ্মিরে স্থানান্তর। সেই ডকট্রিনে কাশ্মিরে হিন্দু পণ্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে শিল্পশ্রমিকদের এনে বসতি স্থাপন কিংবা ভারতীয় সেনার সাবেক সদস্যদের এনে জমি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।”

বিজেপি সরকারের এই পদক্ষেপ অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অংশ দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল লাদাখ আলাদা হয়ে যাবে এবং কেন্দ্রীয় শাসিত পৃথক অঞ্চলে পরিণত হবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কাশ্মিরিদের একটা বড় অংশ মনে করছে, মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরের বিদ্যমান জনমিতির সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলবে। সরকারের এক সূত্রকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কাশ্মিরের বিদ্যমান ভূমির মালিকানার নীতি সেখানকার উন্নয়নের পথে যে প্রতিবন্ধকতা আকারে হাজির ছিল, কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার বাতিলের মধ্য দিয়ে সেই পথ প্রশস্ত হবে। তবে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশেষ অধিকার বাতিল হলে তুষারে আচ্ছাদিত ভূস্বর্গে হিন্দু সেটেলারদের বসতি গড়ার পথ প্রশস্ত হবে, হ্রাস পাবে মুসলিম জনসংখ্যা। একে সমালোচকরা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি বসতি স্থাপনের অন্যায্যতার সঙ্গে তুলনা করছেন। মুসাদির আমিন নামের কাশ্মিরভিত্তিক একজন বিশ্লেষক ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য কাশ্মিরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক অবস্থাকে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা যা কেবল সংঘাতকেই আরও ত্বরান্বিত করবে।’
রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু কারিবকো বলছেন, যেমন করে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমিতে অর্ধলক্ষ সেনা-সমাবেশ ঘটিয়েছে, কারফিউ জারির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর ধারাবাহিক গ্রেফতার-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে সেখানকার স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, গাজাকে পশ্চিমতীর থেকে পৃথক করে আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল বানানো হয়েছে, কাশ্মিরের ক্ষেত্রেও ভারত তাই করতে চলেছে। পশ্চিমতীরে যেমন করে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, [৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে] তেমনি করে কাশ্মিরেও হিন্দুত্ববাদীরা অবৈধ বসতি স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কারিবকো বলছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ওই বিতর্কিত ভূমির জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।

/বিএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
ভারতীয় পর্যটন প্রচারের আকর্ষণ এখন ব্রিটিশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান
দালাই লামার উত্তরসূরি, চীন-ভারত সংঘাত আর একটি সোনার কৌটো
ভারতে চালু হতে চলেছে মোবাইল ভোটিং 
সর্বশেষ খবর
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি