X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (দ্বিতীয় পর্ব)

বিদেশ ডেস্ক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৮:০০আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৮:৩৩
image

পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি অনেক পুরনো, অনেকটা ভারত বা পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের মতোই। পাকিস্তানের এই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটিতে কীভাবে আর কেন স্বাধীনতার চেতনা জন্ম নিলো, অতীতে এই আন্দোলন কেমন ছিল, এর ভবিষ্যতই বা কী—তা নিয়ে বিবিসি রেডিও হিন্দি ও উর্দুতে সম্প্রতি একটি সুদীর্ঘ প্রতিবেদন সম্প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো করে পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তান স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে কিনা, প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। বিবিসির মূল রেডিও প্রতিবেদনটির ভাষান্তর করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের দিল্লি প্রতিনিধি রঞ্জন বসু। তিন পর্বে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিতে সমাবেশ

বেলুচ নেতা নওরোজ খানের বয়স তখন আশিরও বেশি। পাকিস্তানের ‘ওয়ান ইউনিট’ নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি লড়াই শুরু করলেন, সঙ্গীদের নিয়ে শিবির করলেন এক পাহাড় চূড়ায়। পাকিস্তানি সেনা তাকে বার্তা পাঠায়, পাহাড় থেকে নেমে এলে তাকে সেফ প্যাসেজ দেওয়া হবে। কোরান শরিফ ছুঁয়ে পর্যন্ত শপথ করা হল, আত্মসমর্পণ করলে তাদের কোনও ক্ষতি করা হবে না। সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে নবাব নওরোজ খান দুই ছেলে-সহ মোট ১১জন অনুগামীকে নিয়ে নেমে এলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল। শুধু তাই নয়, কোর্ট মার্শাল করে তাদের সবার ফাঁসির সাজাও ঘোষণা করা হল। আশির বেশি বয়স বলে নওরোজ খান বাঁচলেন ফাঁসির হাত থেকে, তাকে দেওয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

সেই দশ অনুগামীর ফাঁসির পর সার সার মরদেহগুলো যখন শোয়ানো ছিল, জনৈক আর্মি মেজর না কি নওরোজ খানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘এদের মধ্যে আপনার ছেলে কোন দুজন?’ জবাব এসেছিল, ‘এরা সবাই!’ শোনা যায়,  এক ছেলের মরদেহে তার গোঁফ নাকি নিচের দিকে ঝুলে পড়েছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ নবাব নওরোজ খান তখন নিচু হয়ে মাটিতে বসে সেই গোঁফ আবার হাত দিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠিয়ে দেন। আর সেই সঙ্গেই বলেন, ‘মৃত্যুতেও যেন তোমার দুশমন বুঝতে না-পারে তুমি কখনও হার মেনেছো।’ বেলুচ কওম বা বেলুচ জাতি যে আসলে কতটা বলিষ্ঠ ও স্বাধীনচেতা, এ ঘটনায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

নবাব নওরোজ খান

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে সে দেশের বিমানবাহিনী মিরাজ ও এফ-৮৬ ফাইটার জেট দিয়ে বেলুচদের ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুরু করে। ইরানের শাহ-ও কোবরা হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাদের ওপর বোমা ফেলায় সাহায্য করেন। শুধু হেলিকপ্টার পাঠিয়েই নয়, ইরানের শাহ্ তখন বেলুচদের দমনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে আর্থিক সহায়তাও করেছিলেন। ওই অভিযানে নির্বিচারে হত্যালীলা চালানো হয় নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধদের ওপর।

ভারতের ক্যাবিনেট সচিবালয়ের সাবেক বিশেষ সচিব ও বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য তিলক দেবেশ্বরের কথায়, ‘সেই শুরু, বেসামরিক মানুষের বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তান আজও এয়ার পাওয়ার বা বিমান বাহিনীর ব্যবহার করে আসছে নির্মমভাবে। প্রতিবেশী ভারতেরও বিদ্রোহ বা জঙ্গি দমনের বহু নজির আছে, তবে তারাও কখনও দেশের ভেতরে বেসামরিক অথবা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এয়ার পাওয়ার ব্যবহার করেনি।’

২৬ আগস্ট ২০০৫, তখন পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মুশাররফের শাসনামল। বিদ্রোহী বালুচ নেতা নবাব আকবর বুগতি এক পার্বত্য গুহায় লুকিয়ে ছিলেন, পাকিস্তানি সেনা তার সেই গোপন ডেরা ঘিরে ফেলে তাকে হত্যা করে। আকবর বুগতি কেবল বালুচ আন্দোলনের খুব বড় নেতাই ছিলেন না, প্রদেশের গভর্নর বা ফেডারেল সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত ছিলেন এক সময়। তবে তার মৃত্যুতে  আন্দোলনে ভাঁটা পড়বে বলে মনে করা হলেও তা হয়নি। বরং তাতে আন্দোলনের তেজ অনেক বেড়ে গিয়েছিল, তিনি পেয়েছিলেন শহীদ বীরের মর্যাদা।

বেলুচ নেতা আকবর বুগতি

মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে পাহাড়ি গুহা থেকে স্যাটেলাইট ফোন থেকে আকবর বুগতি ফোন করেছিলেন পাকিস্তানের সর্বজন-শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দা আবিদা হুসেনকে। সেই ফোনে তিনি বলেন, ‘জীবনের আশিটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছি–আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আপনাদের পাঞ্জাবি সেনারা এখন আমাকে মারতে উদ্যত। তবে দেখবেন, এতে আজাদ বেলুচিস্তানের আন্দোলন আরও তীব্র হবে। আর এভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারলে আমার কোনও দুঃখ থাকবে না। কারণ, এর চেয়ে ভাল মৃত্যু আর হতে পারে না’। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত বেলুচ আন্দোলনের পক্ষে যারাই লড়ছেন, এমন শত শত মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন। নেতাদের গোপনে হত্যা করা হচ্ছে (‘সিক্রেট কিলিং’) বলে পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে বারে বারে অভিযোগ উঠেছে।

২০০৭-র মার্চ মাসে পাকিস্তানের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সে দেশের সুপ্রিম কোর্টে বেলুচিস্তানের ১৪৮ জনের একটি তালিকা পেশ করেছিল, যারা রাতারাতি ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আচমকা কোথায় হারিয়ে গেলেন, আত্মীয়স্বজনেরও তা নিয়ে কোনও ধারণা ছিল না।

পাকিস্তানি সেনার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বালোচ নারীদের বিক্ষোভ

পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক রহিমুল্লা ইউসুফজাই বলছিলেন, ‘আসলে এখানে দুটো বিষয় আছে। এক, ‘গুমশুদা’ বা মিসিং পারসনস অর্থাৎ যাদের খোঁজ মিলছে না। হয়তো সেনাবাহিনী তাদের তুলে নিয়েছে বা গায়েব করে দিয়েছে। আর দুই, একস্ট্রা জুডিশিয়াল কিলিং বা বিচারবহির্ভূত হত্যা। এখন আপনাকে মনে রাখতে হবে বেলুচিস্তানে পুরোদস্তুর ‘ইনসার্জেন্সি’ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ চলছে। সেনাবাহিনী বা ফ্রন্টিয়ার কোর মিলিশিয়ার (আধাসামরিক বাহিনী) ওপর হামলা লেগেই আছে। এই পটভূমিতে যাদের ওপরই সেনাবাহিনীর সামান্যতম সন্দেহ হয়, তাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই সেখানে রেওয়াজ। হ্যাঁ, এটাকে হয়তো সঠিক রাস্তা বলা যাবে না, নৈতিকভাবেও হয়তো এটা ঠিক না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, যুদ্ধে বা লড়াইতে এগুলো আখছার হয়েই থাকে।’

বছর কয়েক আগে এই বেলুচিস্তান প্রদেশের ভেতর দিয়েই ‘চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (সিপেক) নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল বেইজিং। এই প্রকল্পে ষাট বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিপুল আর্থিক লগ্নি করা হবে বলেও জানানো হয়েছিল। এই ঘোষণায় পাকিস্তানে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। সে দেশের অর্থনীতির জন্য এটাকে ‘গেমচেঞ্জার’ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তবে বেলুচিস্তান কিন্তু এই প্রকল্পে মোটেও খুশি হয়নি।

গোয়াদর বন্দর

তিলক দেবেশ্বর ব্যাখ্যা করছিলেন, কেন ‘সিপেক’ বেলুচিস্তানকে মোটেও খুশি করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘আসলে এই করিডর তৈরি করার পেছনে চীনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ চীন সাগর বা মিয়ানমারের পাশাপাশি তাদের বহিঃবার্ণিজ্যের জন্য একটা বিকল্প রুট তৈরি করা। কারাকোরাম হাইওয়ে, গিলগিট-বালটিস্তান হয়ে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে সেই রুট যাবে আরব সাগরে, আর করিডরের ‘আউটলেট’ হবে গোয়াদর বন্দর।’

‘এই গোয়াদর ছিল একটা ছোট্ট মাছ-ধরা বন্দর। সিপেক প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় জেলেদের সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেল। ওদের নিজেদের জমি-জায়গা থেকে উচ্ছেদ হতে হল। ওখানে পানীয় জলের সাঙ্ঘাতিক কষ্ট। লোকে বলে, ওখানে ঘরে চুরি হলে চোর নাকি আগে জলের পাত্র সরায়। তো সেখানে এত বড় একটা প্রকল্প শুরু হল, তারপরেও পানীয় জলের সঙ্কট মেটানোর কোনও চেষ্টাই হল না।’ বলেন তিলক দেবেশ্বর।

‘মানে, স্থানীয় বেলুচদের কেউ কনফিডেন্সেই নেযনি। তাদের কাছে কেউ জানতে চায়নি, গোয়াদরে এত বড় একটা গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে – তোমাদের কী চাই? এই প্রকল্পে তাদের কোনও ইনভলভমেন্ট নেই বলেই বালোচরা সিপেকের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ’, জানাচ্ছেন তিনি।

(চলবে)
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে?

 

/বিএ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার