X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

‘ঘাসও গজায় না যে গালওয়ান ভ্যালিতে’, সেটি নিয়ে কী করতে চায় ভারত বা চীন?

রঞ্জন বসু, দিল্লি
২০ জুন ২০২০, ০৯:৩১আপডেট : ২০ জুন ২০২০, ১২:৩৬

গালওয়ান নদী যেখানে শিয়কে এসে মিশছে ভারতীয় পার্লামেন্টের 'ফোকলোর' বা লোকগাথার অংশ হয়ে আছে, এমন একটা কাহিনি দিয়ে শুরু করা যাক। সেটা ১৯৬২’র ভারত-চীন যুদ্ধের মাসকয়েক আগের কথা। পূর্ব লাদাখের কারাকোরাম ঘেঁষা এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চীন ক্রমশ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলছে– আর ভারত রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়, এমনই এক ইস্যুতে পার্লামেন্টে সেদিন উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক চলছিল।

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সেই বিতর্কের একটা পর্যায়ে বলে বসেন, ‘আর তাছাড়া গোটা দুনিয়ায় এমন সৃষ্টিছাড়া জায়গা আর কোথায়ই বা আছে যেখানে একটা গাছ তো দূরে থাক– কোনও ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না? অমন জায়গা আমাদের থেকেই বা কী লাভ?’

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান পণ্ডিত নেহেরুর দলেরই নেতা, দেরাদুনের ডাকসাইটে এমপি মহাবীর ত্যাগী। নিজের মাথাভর্তি বিশাল টাকের দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলে উঠলেন, ‘এ আপনি কী বলছেন? আমার মাথাতেও তো কোনও চুল গজায় না– কিন্তু তাই বলে কি এটার কোনও দাম নেই? না কি এটা অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া যায়?’

খানিকটা রসিকতার ছলে বলা হলেও ভারত কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই টের পেয়েছিল মহাবীর ত্যাগী কী মোক্ষম কথাটাই না সেদিন বলেছিলেন। গালওয়ান ভ্যালির গুরুত্ব ভারত টের পেয়েছিল অনেক মূল্য দিয়ে। বস্তুত বাষট্টির চীন-ভারত যুদ্ধে প্রধানতম ফ্ল্যাশপয়েন্ট হয়ে উঠেছিল গালওয়ান পোস্ট, সেখানে চীনা বাহিনীর গোলাবর্ষণে ৩৬জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দেশের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

জওহরলাল নেহরু ও মহাবীর ত্যাগী

যে কোনও কারণেই হোক, পরবর্তী প্রায় ছয় দশকে চীন কিন্তু গালওয়ান ভ্যালির ওপর সেভাবে কোনও দাবিই জানায়নি, কোনও সেনা মোতায়েনও করেনি। তবে সেই পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে চলতি বছরের গ্রীষ্মে, যখন চীন গোটা গালওয়ান ভ্যালির ওপরেই নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করছে। শুধু তাই নয়, গত ১৫ জুনের রাতে এই নিস্তব্ধ উপত্যকাতেই ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘাতে ভারতের অন্তত ২০জন সেনা নিহত হয়েছেন, যদিও চীনের দিকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্পষ্ট নয়।

কারাকোরামে তৈরি হওয়া গালওয়ান নদীটি আকসাই চীনের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে মিশেছে লাদাখের শিয়ক নদীতে, যা আবার সিন্ধুর একটি প্রধান উপনদী। ঘটনাচক্রে এই গালওয়ান নদীর নামকরণও করা হয়েছিল লাদাখের এক বিখ্যাত মুসলিম অভিযাত্রী, গুলাম রসুল গালওয়ানের নামে। ভারত ও চীনের বিতর্কিত সীমান্তরেখার (এলএসি বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) কাছে এই গালওয়ানের প্রশস্ত উপত্যকাই আজ আবার দু’দেশের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত।   

কিন্তু কেন এই জনমনিষ্যিহীন, দুর্গম প্রান্তর– যেখানে বছরের প্রায় দশমাস তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে এবং শীতে তা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছে যায়– সেটিকে ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে বাংলা ট্রিবিউন দিল্লি ও দুবাইতে কথা বলেছে একাধিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্টের সঙ্গে। তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো।

জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী (ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান) জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী (ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান): গালওয়ান ভ্যালি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওর পাশ ঘেঁষেই গেছে দৌলত বেগ ওল্ডি যাওয়ার নতুন রাস্তা। গালওয়ান ভ্যালিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলেই দৌলত বেগ ওল্ডিতে আমাদের অ্যাকসেস ও ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) বজায় রাখা যাবে। আর এই দৌলত বেগ ওল্ডি-ই কিন্তু হিমালয়ের ওই অঞ্চলে প্রধান কানেক্টিং পয়েন্ট বা ট্রানজিট পয়েন্ট। সেখানে শুধু বিমান অবতরণের জন্য বিশ্বের উচ্চতম এয়ারস্ট্রিপ আছে তা-ই নয়, সিয়াচেন হিমবাহের যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ ও সেনা পৌঁছে দেওয়ার জন্যও দৌলত বেগ ওল্ডি-র গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সীমানা বিরোধেরও শুরু ওখান থেকেই। কাজেই দৌলত বেগ ওল্ডি-কে ধরে রাখতে হলে গালওয়ান ভ্যালির ওপরও কব্জা চাইই চাই।

সাদিক সাবান (দুবাইয়ে গাল্ফ নিউজের সাংবাদিক, কাশ্মিরি বিশ্লেষক)

সাদিক সাবান (দুবাইয়ে গাল্ফ নিউজের সাংবাদিক, কাশ্মীরি বিশ্লেষক): আমার ধারণা চীন যে এখন পুরো গালওয়ান ভ্যালির ওপর নিজেদের দাবি জানাচ্ছে, তার সঙ্গে গত বছর ভারত যে কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি লোপ করেছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর লাদাখ একটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি পায়। এরপর ভারত যে দেশের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, তাতে চীনের ‘নতুন অনেক এলাকা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল একাধিক চীনা থিঙ্কট্যাঙ্ক। এর মধ্যে সিআইসিআইআর নামে একটি থিঙ্কট্যাঙ্কও ছিল, যারা সরাসরি চীনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগের অধীন। আমার ধারণা, ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীন এখন সরাসরি কাশ্মির বিতর্কেও ঢুকতে চাইছে– যার প্রথম ধাপ হলো লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি বা প্যাংগং লেক পুরোটা কব্জা করার চেষ্টা করা।

ড শ্রীমতি চক্রবর্তী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো

শ্রীমতি চক্রবর্তী (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো):  লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে এখন সড়কপথে দৌলত বেগ ওল্ডি যেতে সময় লাগে আড়াই দিনের মতো। কিন্তু ডারবুক-শিয়ক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি পর্যন্ত যে নতুন রাস্তা ভারত বানিয়েছে, তাতে এই সময়টা কমে দাঁড়াবে মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। আর এই রাস্তাটা কিন্তু গেছে একেবারে ভারত-চীনের এলএসি বরাবর, বলা যেতে পারে সীমান্তের একেবারে প্যারালালি। এখন চীনের উদ্দেশ্য হলো, ঠিক পাশের গালওয়ান ভ্যালিটা কব্জা করতে পারলে তারা এই নতুন রাস্তাটার গুরুত্ব অনেকটাই ‘নিউট্রালাইজ’ করে দিতে পারবে। অর্থাৎ ভারতের জন্য সেটা আর তত সুরক্ষিত থাকবে না। চীনের মূল আপত্তিও হলো ভারত কেন এই রাস্তা বানাবে? যার জবাবে বলা যেতে পারে, এতদিন বানায়নি বলে ভারত কি নিজের সীমান্ত অঞ্চলে অবকাঠামো বানাবে না? আর এই রাস্তাও তো পুরোপুরি ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতরেই তৈরি হয়েছে।

মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি (ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা, স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট)

মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি (ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা, স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট): আমি কিন্তু গালওয়ান ভ্যালি নিয়ে অনেকের সঙ্গেই ভিন্নমত পোষণ করি– কারণ আমার মতে এই উপত্যকার একেবারেই কোনও স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব নেই। শুধু এটা ছাড়া, যে ভারত ও চীন দুই দেশই এখন ওই ভূখণ্ডটার দখল পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ব্যাস, গুরুত্ব বলতে এটুকুই– এছাড়া অনেকে যে সিয়াচেন বা ডারবুক-শিয়ক রোডের ক্ষেত্রে এই ভ্যালি ভারতকে সাহায্য করবে বলে বলছেন, সেগুলো একেবারে ননসেন্স। আগে থেকে দুর্গম এই উপত্যকায় সেনা পাঠানোই যেত না, লম্বা রাস্তা পেট্রল করে যেতে হত– এখন নতুন রাস্তা হওয়ার পর অ্যাকসেসটা হয়তো কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তাতে লাভটা আর কী? এক সময় গালওয়ান ভ্যালি বিখ্যাত সিল্ক রুটের অংশ ছিল, কিন্তু আজকাল তো আর কেউ হেঁটে হেঁটে বা খচ্চরের পিঠে মাল চাপিয়ে তিব্বতে রেশমের ব্যবসা করতেও যায় না, তাই না?

ফলে গালওয়ান ভ্যালির গুরুত্ব ঠিক কতটা, কেন ভারত আর চীন দুদেশই এই উপত্যকাকে কব্জা করতে চাইছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিস্তর মতভেদ আছে। কিন্তু যেটা নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই তা হলো, গালওয়ান ভ্যালি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ইতোমধ্যেই অনেক রক্ত ঝরেছে– আগামীতেও হয়তো আরও ঝরবে।

/এএ/
সম্পর্কিত
মোদির ভারতে কেমন আছেন মুসলিমরা?
চীন সফর: শি’র মন জয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন পুতিন
লোকসভা নির্বাচন: আজ থেকে বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
সর্বশেষ খবর
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
কান উৎসব ২০২৪কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভালো সড়ক কেটে ২ বছর ধরে খাল বানিয়ে রেখেছে
নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভালো সড়ক কেটে ২ বছর ধরে খাল বানিয়ে রেখেছে
গরমে সুস্থ থাকতে কোন কোন পানীয় খাবেন? ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কখন জরুরি?
গরমে সুস্থ থাকতে কোন কোন পানীয় খাবেন? ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কখন জরুরি?