ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মৃতি নিয়ে পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশিদের গর্ব ও ঐতিহ্যের ঠিকানা আলতাব আলী পার্ক। ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পূর্ব লন্ডনে আনুষ্ঠানিক সফরে এই পার্কটি পরিদর্শন করবেন।
ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ এই পার্ক পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে বাঙালিপাড়ায় রাজার আনুষ্ঠানিক সফর শুরু হবে। এখানে ষাট ও সত্তর দশকে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় বাংলাদেশিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন চার্লস ও ক্যামিলা।
পরে বাংলা টাউনে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি দিয়ে রাজাকে আপ্যায়ন করা হবে। কুইন কনসোর্টকে উপহার দেওয়া হবে বাংলাদেশি ঐতিহ্যের স্মারক জামদানি শাড়ি।
আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দীন বলেছেন, ষাট ও সত্তর দশকে অগ্রজ বাংলাদেশি ও আমাদের এখানকার বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো আন্দোলন করে টিকে থাকতে হয়েছে। আজকের বাংলাদেশি কমিউনিটি সেই সংগ্রামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজার বাঙালিপাড়া সফর ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের অবদানের এক ধরনের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন।
রাজার দায়িত্ব পালন শুরুর পর বাঙালিপাড়ায় এবারই প্রথম সফরে আসছেন রাজা চার্লস। রাজা হওয়ার আগে প্রিন্স চার্লস ২০০১ সালে ইস্ট লন্ডন মসজিদ পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারও আগে ১৯৮৭ সালে ব্রিকলেনে একটি প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু, বাংলাদেশি কমিউনিটির ব্রিটেনে চার প্রজন্মের সংগ্রামের ইতিহাসের পথ বেয়ে বিভিন্ন অর্জন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের ব্রিটেনের উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে অভাবনীয় সাফল্যকে অনুপ্রাণিত করতে বুধবারের এই সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আগমনের সূচনা ঘটে গত শতকের ত্রিশের দশকে। মূলত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা কলকাতা থেকে ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিতে কাজ নিয়ে প্রথমদিকে অভিবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীকে সেই দেশে স্বাগত জানায়। ধীরে ধীরে শিক্ষা এবং চাকরির সন্ধানে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। এভাবে একসময় যুক্তরাজ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষদের একটি বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে।
লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। এসব সংগঠন অভিবাসীবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম, যেমন- ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল। বাংলাদেশিরা ছিল তাদের টার্গেট। ফলে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের ওপর সহিংস বর্ণবাদী হামলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনই একটি সহিংস বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের ৪ মে মাত্র ২৪ বছর বয়সে আলতাব আলী নামে বাংলাদেশি কর্মী নিহত হন। আলতাব আলী ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈরদরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যুক্তরাজ্য অবস্থানরত বাংলাদেশিসহ অভিবাসীরা বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। হ্যাকনি এলাকায় এই রকম আরেকটি বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে ইসহাক আলি নামে আরও একজন নিহত হন।
আলতাব আলীর মৃত্যুর ঘটনায় পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকায় অভিবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি কর্মীরা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। আলতাব আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর প্রায় ৭ হাজার মানুষ তার কফিন নিয়ে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বিক্ষোভকারীরা পূর্ব লন্ডনের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবিলম্বে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী আক্রমণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। সেই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে এক বিশাল বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পরে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, এবং বিশেষত বাঙালি অভিবাসীদের আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলা কমে আসে। ১৯৮৯ সালে বর্ণবাদী হামলার শিকার সব মানুষের স্মরণে সেইন্ট মেরি পার্কে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯৮ সালে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে ‘আলতাব আলী পার্ক’ রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে শহীদদের স্মরণে এই পার্কের ভেতরে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর ৪ মে যুক্তরাজ্যে ‘আলতাব আলী দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
বর্তমানে অনেক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চারজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এমপি প্রতিনিধিত্ব করছেন। রাজা বুধবার যে বাঙালিপাড়ায় সফরে আসছেন সেখানকার মেয়র ও কাউন্সিলরদের সিংহভাগই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
গত বছরের আট সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে প্রথাগতভাবে তার উত্তরাধীকারী হিসেবে রাজা হন চার্লস। ৬ মে তার আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক হবে। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে অভিষেক উৎসবে যোগ দেবেন চার্লস ও ক্যামিলা।
৭৪ বছর বয়সী চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জের জন্ম লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর। ১৯৯৭ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন।