X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গুনতে হয় বাড়তি টাকা

তাসকিনা ইয়াসমিন
০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১০:৪৪আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:১৪

 

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সাধারণ মানুষের জন্য অল্প খরচে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে এসব হাসপাতালে রোগী ও তার স্বজনদের সেবা পেতে গুনতে হয় সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়েও অতিরিক্ত টাকা। নয়তো সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ। হতে হয় নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও স্বজনদের থেকে পাওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসার পর ট্রলিতে উঠানো থেকেই শুরু হয় হয়রানি ও অনিয়ম। অতিরিক্ত টাকায় ট্রলি দিয়ে রোগীদের নিয়ে যেতে হয়। এছাড়া ১০ টাকার টিকেটের জন্য গুনতে হয় কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি অর্থ।
বিভিন্ন হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই অবস্থার পেছনে অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া। পাশাপাশি বাড়তি সুবিধা আদায়ে রোগী ও স্বজনদের ইচ্ছাও দুর্নীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে কয়েকজন রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নানা বিড়ম্বনা এবং ভোগান্তির শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন সাথী বেগম (২৪)। সাথী জানান, ফিস্টুলার সমস্যায় ভুগছেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসক তাকে কয়েকটি প্যাথলজি টেস্ট দিয়েছেন। তবে এগুলোর মধ্যে একটি টেস্ট করাতে নির্ধারিত ফি ৫০ টাকার জায়গায় তাকে ৮০ টাকা গুনতে হয়েছে।

একই হাসপাতালে ছেলের চিকিৎসা করাতে এসেছেন সখিনা বেগম (৪৫)। হাসপাতালে এসে দেখেন টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। এ সময় সখিনা কর্তব্যরত আনসার মোহাম্মদ তৈয়বকে ৪০ টাকা দিয়ে একটি দশ টাকার টিকিট নেন।

তবে পরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন আনসার মোহাম্মদ তৈয়ব। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি কারো থেকে টাকা নিয়্যা কিছু করি না।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার ট্রলিতে রোগী আনা নেওয়া, সিট পাওয়া, লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ এবং প্যাথলজি টেস্ট দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার ক্ষেত্রে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।

সাথী আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে এলেই বাড়তি টাকা দিতে হয়। বাড়তি টাকা না দিলে কাজ হয় না। তাই বাধ্য হয়ে দেই।

আর সখিনা বেগমের কথা হলো, ‘টাকা দিয়ে যদি তাড়াতাড়ি কাজ করাইতে পারি ক্ষতি কি!’

রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘুরে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া গেছে। রোগী ও স্বজনরা জানান, হাসপাতালগুলোতে রোগীকে ট্রলিতে উঠানো থেকে শুরু করে রোগীর ভর্তি, বেড পাওয়াসহ সবক্ষেত্রে আয়া, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনারসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অর্থ দিতে হয়। অর্থ না দিলে ট্রলিও পাওয়া যায় না। হাসপাতালে রোগীও ভর্তি করা যায় না।

রোগীরা আরও জানান, শুধু ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতেই নয়, সারা দেশেই সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে রোগীদের বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ট্রলিতে রোগীকে উঠানো থেকে শুরু করে ভর্তি করা পর্যন্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হতে হয়। এরপর যতদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র না মিলছে ততদিন এই দুর্নীতি ও অনিয়ম তাদের পিছু ছাড়ে না। রোগী ভর্তির পর হাসপাতাল থেকে দেওয়া বিনামূল্যের ওষুধ, বেড পাওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতেও বাড়তি টাকা দিতে হয়। এসবের বাইরে চিকিৎসক-নার্সের উপস্থিতি ঠিকমতো না থাকা, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, হাসপাতালের বাইরে প্যাথলজি টেস্ট করতে পাঠানো এবং অস্ত্রোপচার বাইরের হাসপাতালে করতে বলা এসব সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যা দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হচ্ছেন বঞ্চিত।

ঢামেক, সোহরাওয়ার্দী, বিএসএমএমইউ, টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে প্যাথলজি টেস্ট, চিকিৎসকের সিরিয়াল সবখানেই কর্তব্যরত আনসার দায়িত্বে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, টাকা দিলেই তাদের আচরণ বদলে যায়।

ঢাকা মেডিক্যালে বাবার চিকিৎসা করাতে আসা রশীদ মাহমুদ বলেন, ‘এখানকার আনসারদের আচরণ টাকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। আর খালাগুলোকে ট্রলি ধরলেই ১০০ টাকা দিতে হয়। এরচেয়ে কম দিলে তারা রোগীর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে। আমি তো রোগী নিয়ে এসেছি, বাধ্য হয়ে টাকা দেই। কারণ, আপনি চিকিৎসক ও নার্সকে টাকা ছাড়া পাবেন। তবে এর নিচের দিকে যত যাবেন, টাকা না দিলে এরা কোনও কাজ করবে না।’

রোগীদের অভিযোগের সঙ্গে একমত পোষণ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল তো মাত্র তিন-চার বছর আগেই দালালদের স্বর্গরাজ্য ছিল। একজন রোগী কোনোভাবেই সরাসরি চিকিৎসকের কাছে আসতে পারতো না। তার আগে তাকে অন্তত পাঁচ-ছয়টা ধাপ পেরিয়ে আসতে হতো। এখন এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সেই সমস্যা নেই।’

তবে এখনও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করা কর্মীদের কারণে রোগী ও স্বজনরা ভুগছেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের ৪০ ভাগ পোস্ট ফাঁকা। প্রতিদিন জরুরি বিভাগে অসংখ্য রোগী আসে। কিন্তু এত রোগী অ্যাটেন্ড করার জনবল নেই। তখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু লোক রাখতেই হয়। এক্ষেত্রে হাসপাতালের আশপাশের কিছু মানুষ হুইল চেয়ারে রোগী আনা নেওয়া করেন। এরা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। এরা কখনও হাসপাতালের হুইল চেয়ার ব্যবহার করে না। তারা সবসময় নিজস্ব চেয়ার ব্যবহার করে এবং রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো জোর করে অর্থ আদায় করে।’

তিনি আরও জানান, ‘এরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামায়। এরপর রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার পর ওয়ার্ডে ভর্তি করে। তারা রোগীদের কাছ থেকে অর্থ জোর করেই আদায় করে। রোগীভেদে তারা ১০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়।’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘যখন কোনও চিকিৎসকের নিজস্ব রোগী আসে, তখন খালারা ট্রলি নিয়ে আগায় না। কারণ, তারা তো চিকিৎসকের কাছ থেকে কোনও অর্থ নিতে পারবে না। তখন চিকিৎসক নিজেই অনেকক্ষেত্রে রোগীকে ঠেলে নিয়ে আসেন এবং নিজেই রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেন।’

তবে চিকিৎসা নিতে এসে রোগী ও স্বজনদের যে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সে বিষয়ে কিছু জানেন না শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কাছে চিকিৎসা নিতে এসে কেউ বাড়তি টাকা দিচ্ছে এমন অভিযোগ নেই। আমাদের এখানে নিজস্ব কিছু স্টাফ আছেন। এর বাইরে কিছু আয়া থাকেন। তারা থাকায় আমাদেরও উপকার হয়, আবার তারাও টুকটাক অর্থ নেয়। তবে আমি বাড়তি অর্থ নেওয়ার কোনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। এই ধরনের তথ্য পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’

রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের প্রসঙ্গে একই ধরনের বক্তব্য দেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাছির উদ্দিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কাছে কেউ এ ধরনের অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’

সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে এসে রোগী ও স্বজনদের বাড়তি টাকা খরচ এবং হাসপাতালের কর্মচারীদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘প্রথমত, এমনটি হওয়ার কথা না। এরপরও যদি আমরা কোনও অভিযোগ পাই বা খবরের কাগজে দেখি যে এমন হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমরা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলি। আর আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি, ‘আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত’ এটা যেন লিখে রাখে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন এমন পদ্ধতি চালু থাকবে যে, কাজ না করলেও বেতন পাওয়া যাবে; তখন দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রবণতা থাকবেই। আর মানুষের মধ্যেও এক ধরনের প্রবণতা থাকে- একটু বকশিশ দিলেই কাজটা বোধহয় ভালোভাবে হয়ে যাবে। তাই ভবিষ্যতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে আমরা চিন্তা করছি। আমরা যদি এমন কিছু করতে পারি যে হাসপাতালে যত রোগী আসবে তার ওপর ভিত্তি করে বাজেট দেওয়া হবে। যে যেমন কাজ করবে তেমন পাবে, তখন হয়তো অবস্থার পরিবর্তন আসতে পারে।’

/এএইচ/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই