X
রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫
২১ আষাঢ় ১৪৩২

টিকা নিয়ে আরও গবেষণার তাগিদ

জাকিয়া আহমেদ
০৪ আগস্ট ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২১, ১৩:২৪

গত বছরের ৮ মার্চে প্রথম দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার ঠিক ১০ দিন পর করোনাতে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই চলতি বছরের ২৭ ও ২৮ জানুয়ারিতে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে।

তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করার পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। সে টিকা দেওয়া হয়েছিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড টিকার মাধ্যমে। তবে দেশে বর্তমানে চারটি টিকা দেওয়া হচ্ছে।

সোমবার (২ আগস্ট) পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৫৩ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ৬ হাজার ৮৮৭ জন। ফাইজারের টিকা দেওয়া হয়েছে মোট ৫৩ হাজার ৪২৩ ডোজ। এ ছাড়া ২৭ লাখ ৪২ হাজার ১৮৬ ডোজ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে এখন পর্যন্ত। এরমধ্যে  প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩১২ জনকে, আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫৭ হাজার ৮৭৪ জনকে। এ পর্যন্ত মডার্নার টিকা দেওয়া হয়েছে মোট ৮ লাখ ৪৪ হাজার ২০৯ ডোজ।

সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন মোট ১ কোটি ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৬ জন।

টিকা নিয়ে শুরুটা অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো হলেও মাঝে কোভিশিল্ডের টিকার রফতানি বন্ধ করে দেওয়াতে কোভিশিল্ড টিকার দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রথম ডোজ দেওয়াদের মধ্যে থেকে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখের মত মানুষ।

তবে ইতোমধ্যে জাপান সরকার কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় বাংলাদেশকে তিন দফায় ১৬ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি টিকা দিয়েছে। আর তাতে করে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় থাকাদের সংশয় কাটছে, ইতোমধ্যেই এ টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে দেশে।

টিকা নিয়ে সংশয়ের দোলাচলে থাকাদের টিকা দিতে উদ্বুদ্ধ করতে আশার বাণী শোনাচ্ছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। ২ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) জানিয়েছে, করোনার টিকা নেওয়া ৯৮ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে যারা আগে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের শরীরে তুলনামূলক বেশি অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে বিএসএমএমইউ।

একই ধরণের আশার কথা জানাচ্ছে সরকারের রোগ, রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধী দুই ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। 

তারা আরও জানাচ্ছে, টিকা নেওয়া করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭ শতাংশ, আর না নেওয়াদের ২৩ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

আবার পুরুষদের চেয়ে নারীদের শরীরে বেশি অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে বলে আরেক গবেষণায় জানিয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকা কখনোই করোনা প্রতিরোধে একমাত্র সুরক্ষা বলয় নয়। টিকা এই রোগের জটিলতা, মৃত্যু ঝুঁকি ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কমাতে সাহায্য করে। করোনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। টিকা নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে কোনোভাবেই করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় জানাচ্ছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড টিকা নেওয়া ২০৯ জন টিকা গ্রহণকারীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে- টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৮ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে বাকি দুই শতাংশের মধ্যে যাদের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়নি, তারা জটিল রোগে আক্রান্ত, অনেক বয়স্ক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম।

বিএসএমএমইউ জানাচ্ছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ পুরুষ এবং অর্ধেকের বেশি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িত। আর তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশের আগে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। সেই সঙ্গে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানিসহ অন্যান্য রোগে ভুগছিলেন। তবে এ ধরনের রোগের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিকা গ্রহণের পর অ্যান্টিবডি তৈরিতে কোনও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি।

আর যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে সামান্য জ্বরসহ মৃদু উপসর্গের কথা জানালেও রক্ত জমাট বাঁধা বা এরকম অন্য কোনও জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গবেষণাকালীন পরিলক্ষিত হয়নি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অ্যান্টিবডির কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

অপরদিকে আইইডিসিআর জানায়, যারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত কিন্তু টিকা নেননি তাদের ৩২ শতাংশই কোভিড-১৯ আক্রান্তের পর হাসপাতালে যেতে হয়েছে অথচ টিকা গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে এটি ১০ শতাংশ ছিল। একাধিক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত টিকা নেওয়া রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণ দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি ছিল। 

আইইডিসিআর জানাচ্ছে, টিকা না নেওয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত জটিলতায় ভুগেছেন ১১ শতাংশ, যা পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৪ শতাংশ ছিল। আর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত টিকা না নেওয়া করোনা পজিটিভ রোগীদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত জটিলতার হার এবং দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারী করোনা পজিটিভ রোগীদের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে।

টিকা গ্রহণকারীরা করোনাভাইরাসের সংক্রমিত হলে তাদের আইসিইউও কম লেগেছে এবং মৃত্যুর হারও কম বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আইইডিসিআর বলছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী টিকা না নেওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৯ জনকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে যা ৩ শতাংশ। পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৩ জনকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে, যা ১ শতাংশের কম। করোনাভাইরাসের টিকা নেননি এমন আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, শতকরা হিসেবে যা ৩ শতাংশ। 

অন্যদিকে, গবেষণায় নির্বাচিতদের মধ্যে টিকা নিয়েছেন এমন একজনও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন।

এর আগে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১২০ জন প্রথম ডোজ কোভিশিল্ড টিকা গ্রহণকারীর টিকা গ্রহণের এক মাস পর ৯২ শতাংশের ও দুই মাস পর ৯৭ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সব বয়সী টিকা গ্রহণকারীর শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যান্য অসুস্থতা (কো-মরবিডিটি) থাকা বা না থাকার সঙ্গে অ্যান্ডিবডির উপস্থিতির তেমন কোনও পার্থক্য পাওয়া যায়নি। টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে যারা কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের শরীরে চার গুণ বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

‘টিকা নিয়ে যতবেশি গবেষণা হবে ততোই ভালো’ মন্তব্য করে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি জানান, যেহেতু ভাইরাসটা নতুন, তাই বেশি বেশি গবেষণা হলে বেশি তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে। তখন হয়তো এর প্রিভেনশনের মেথডও বের করা যাবে।

‘তবে করোনা প্রতিরোধে সবসময় মনে রাখতে হবে, টিকা একটিমাত্র টুলস নয়। এটা যেহেতু নতুন ভাইরাস, কোনও অ্যান্টি-ভাইরাল নাই; এটা সংক্রামক, একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়ায়। তাই সঠিকভাবে মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলা, হাত ধোয়ার মতো কাজ করার সঙ্গে টিকাকেও অন্যতম টুলস হিসেবে গ্রহণ করতে হবে’।

কারণ এর বাইরে কোনও ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই কোনও কিছু জানি না- বলেন ডা. আলমগীর।

‘‘টিকা নিলে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম, আক্রান্ত হলে সিভিয়ারিটি বা জটিলতা হবার সম্ভাবনা কম, হাসপাতালে ভর্তি হবার ‘অলমোস্ট’ দরকার নেই। আইসিইউতে যেতে হবে না, মৃত্যুঝুঁকি ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ কমে যাচ্ছে’’।

টিকা দানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আরও বড় পরিসরে এ নিয়ে গবেষণা করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, গবেষণা আরও হওয়া উচিত। আমিতো আরও দুটো গবেষণা করবো। ছয় মাস এবং এক বছর পরে। যারা গবেষণার প্রথম ধাপে ছিল তারাই থাকবেন পরবর্তী ধাপগুলোতে।

‘যাতে বুস্টার ডোজ দেওয়া লাগবে কী লাগবে না, ইমিউনিটি থাকে কিনা- না হলে আবার টিকা দিতে হবে। এটা আমার স্টাডি দিয়েই আমি সরকারকে বলতে পারবো’।

তবে স্যাম্পলিং আরও বড় হওয়া দরকার কিনা প্রশ্নে তিনি আরও বড় হওয়া দরকার বলে একমত পোষণ করেন। একইসঙ্গে জানান, কেবলমাত্র কোভিশিল্ড নয়। মডার্না, ফাইজারের টিকা নিয়েও এমন গবেষণা বিএসএমএমইউ করবে।

আমার মনে হয়, স্যাম্পলিং বড় হওয়া দরকার। আরও বড় হবে, করবো। ধীরে ধীরে আরও বড় করবো। মডার্না, ফাইজারের টিকা নেওয়াদের নিয়েও গবেষণা হবে। আমি ৩ আগস্ট ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি এ বিষয়ে- বলেন অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ।

 

/এনএইচ/
সম্পর্কিত
করোনায় আরও একজনের মৃত্যু
আরও ৬ জনের করোনা শনাক্ত
চট্টগ্রামে আরও তিন জনের করোনা শনাক্ত
সর্বশেষ খবর
শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে: খাদ্য উপদেষ্টা
শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে: খাদ্য উপদেষ্টা
গিলের রেকর্ড ছোঁয়ার দিনে ভারতের দাপট
গিলের রেকর্ড ছোঁয়ার দিনে ভারতের দাপট
৯ জনের দল নিয়েও বায়ার্নকে হারিয়ে সেমিতে পিএসজি
৯ জনের দল নিয়েও বায়ার্নকে হারিয়ে সেমিতে পিএসজি
পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিল বের হবে সকাল ১০টায়
পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিল বের হবে সকাল ১০টায়
সর্বাধিক পঠিত
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা মারা গেছেন
সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা মারা গেছেন
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
‘নতুন করে লিখতে আপত্তি নেই, তবে এটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে ভালো সংবিধানের একটি’
‘নতুন করে লিখতে আপত্তি নেই, তবে এটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে ভালো সংবিধানের একটি’