X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইউটিউব দেখে খুলে বসছে ফিজিওথেরাপি সেন্টার!

উদিসা ইসলাম
২২ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৪৭

হাঁটতে গেলে হঠাৎ ব্যথা অনুভব করায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হাঁটুর হাঁড়ের অবস্থানগত সমস্যা চিহ্নিত হয়। ফিজিও মেডিসিনের চিকিৎসক ব্যথা কমার ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসক জানান, বাসায় গিয়েও এখন অনেক প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিয়ে থাকে। রোগী তার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতার আলোকে ঠিক করেন তেমনই এক ‘থেরাপিস্ট’কে। তিন মাসের টানা থেরাপিতে ব্যথা না কমায় রোগী আবারও চিকিৎসকের পরামর্শ নেন এবং বুঝতে পারেন, তাকে যে থেরাপিগুলো দেওয়া হচ্ছিল, সেটা যথাযথ ছিল না।

এটা ছিল রাজধানী ঢাকার ঘটনা। দেশজুড়েই এখন ফিজিওথেরাপির বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু থেরাপিস্ট ও টেকনিশিয়ানের পার্থক্য বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। অনেকে ইউটিউব দেখে, যন্ত্রপাতি কিনে এক রুমের মধ্যে খুলে বসছে থেরাপি সেন্টার। শুধু তাই নয়, আত্মীয়-স্বজনকে কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে রোগী ধরে চলছে থেরাপি দেওয়ার কাজ। এরা ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা পার সেশনে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিপরীতে রোগীর রোগ তো সারছেই না, বরং বাড়ছে ভোগান্তি।

পেশাদার থেরাপিস্টরা বলছেন, অনেকেই ভাবছে থেরাপির কাজটি খুব সহজ, কিছু যন্ত্র থাকলেই হলো। ফলে কয়েকজন মিলে সেন্টার খুলে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। এতদিন আমাদের কাউন্সিল ছিল না, আইন নীতি ছিল না বলে নানাকিছু ঘটেছে। তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিজিও মেডিসিন ও ফিজিওথেরাপিস্টদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সুযোগ নিচ্ছে একটি দুষ্টচক্র।

যে কেউ হয়ে উঠছে ফিজিওথেরাপিস্ট

চিকিৎসকরা বলছেন, কে থেরাপিস্ট আর কে নয়, এর কোনও বৈধ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা, থেরাপিস্টদের নিবন্ধন না থাকার কারণে, যে কেউ চাইলেই একটা থেরাপিসেন্টার খুলে বসতে পারছে। ধরা পড়ার ভয় ঢাকায় যেটুকু আছে, বিভাগীয় ও জেলা শহরে সেটাও নেই। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাবি করে অনেকেই থেরাপিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

দ্রুতই এদের মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা উচিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে যে টেকনিশিয়ান থাকে, একসময় তারাই সেন্টার খুলে বসে। কাউন্সিল নীতিমালা বা আইন করলে, একটা সিস্টেমের মধ্যে আসবে। একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রকম সুযোগসন্ধানীদের খবর পাওয়া যায়। কিছু যন্ত্রপাতি কিনে থেরাপি দিয়ে দেওয়া যায়, এটা ভয়াবহ। শরীরের বিভিন্ন অংশকে বুঝতে হবে। সেটা একজন বিশেষায়িত চিকিৎসকের পক্ষেই সম্ভব। ফিজিওথেরাপিস্টের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিয়েও ভাবতে হবে।’

চড়া দামে সেবা নিতে বাধ্য হন রোগীরা

বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত, বাংলাদেশেও এ সমস্যা ঘরে ঘরে। হাঁড়ের ক্ষয়, পেশির দুর্বলতা, অতিরিক্ত মেদ, বয়স্ক জনগোষ্ঠী—এ সমস্যার অন্যতম কারণ। বয়স্ক মানুষের শরীরে নানা ধরনের ব্যথা, স্ট্রোক, অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সেই সুযোগ নিয়ে থেরাপির একেকটি সেশনে যে পরিমাণ অর্থ গুনতে হয়, সেটা একজন মধ্যবিত্ত রোগীর জন্যও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।

পান্থপথে অবস্থিত একটি ফিজিওথেরাপি সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে তাদের সেবা নিশ্চিত করা হয়। প্রথমে কনসালটেন্সি ও থেরাপি মিলিয়ে এক হাজার টাকা হলেও এরপর থেকে প্রতিদিন প্রতি সেশনে ৬শ’ টাকার বিনিময়ে থেরাপি পাওয়া যায়। যদিও থেরাপিস্টদের মোট সংখ্যা বিবেচনা করে চিকিৎসকরা বলছেন, এটা প্রায় অসম্ভব। সবাইকে দক্ষ ও ফিজিওথেরাপিস্টদের দিয়ে থেরাপি দেওয়ার বাস্তবতা নেই।

বাসায় গিয়ে থেরাপি দেয়—এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। ‘ফিজিওসেবা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার তথ্যদাতা মো. রাসেল বলেন, তাদের এখানে দিনে ১৫শ’ টাকা ও মাসে ৪০ হাজার টাকার থেরাপি নেওয়ার সুব্যবস্থা আছে। বাসায় যারা যাবেন, তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন কনসালটেন্ট প্রথম দিন গিয়ে রোগী দেখে, তার উপযোগী থেরাপি কী হবে, সেটি থেরাপিস্টকে বুঝিয়ে দেবেন। এবং থেরাপিস্টরা যথেষ্ট দক্ষ। পুরো লালমাটিয়া এলাকায় তাদের হাতে থাকা নারী থেরাপিস্ট মাত্র দুজন থাকায় দ্রুত বুকিং দিতে হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।

যেহেতু রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল এখনও সক্রিয় হয়নি, সেহেতু যার যেভাবে খুশি থেরাপি সেন্টার খুলে প্রতারণা করছে উল্লেখ করে ডা. মহসীন কবীর বলেন, ‘এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিভিন্ন ডায়াগনোসিস্ট সেন্টার জড়িত। কিছু থেরাপি যন্ত্র কিনে নিলেই ফিজিওথেরাপি দেওয়া যায় বলে তারা মনে করে। তাদের মনে হয়, এটা খুব সহজ কোনও কাজ। রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল নীতিমালা হয়ে গেলে সমাধান হবে। কাউন্সিলের প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু রোগী বেড়েছে, থেরাপির চাহিদা বেড়েছে, ফলে এত রকমের সেন্টার তৈরি হয়েছে যে কে আসল চিকিৎসক, আর কে না তা বলা মুশকিল।’ সারা দেশে কতজন ফিজিওথেরাপিস্ট আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চার-পাঁচ হাজারের বেশি না। তাদের মধ্যে এক-দুই হাজার দেশের বাইরে রয়েছেন।’

ফিজিওমেডিসিন ও ফিজিওথেরাপিস্টদের দ্বন্দ্ব

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিয়ে দিন দিন নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। কারা এই পেশা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপির চিকিৎসকরা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতদের দাবি, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের কিছু চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে থাকা ফিজিওথেরাপি বিভাগগুলোর নাম পরিবর্তন করে ফিজিক্যাল মেডিসিনে রূপান্তর করেছেন। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ফিজিওথেরাপি পেশাকে নিজেদের অধীনে রাখতে ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসকরা ষড়যন্ত্র করছেন। যদিও ফিজিওমেডিসিনের চিকিৎসকরা এটা অস্বীকার করছেন। ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডাক্তার মহসীন কবীর বলেন, ‘একজন ফিজিওথেরাপিস্ট পাঁচ বছরের কোর্স করে এই পেশায় আসেন। তাদের রোগী ফিজিওমেডিসিনের চিকিৎসকরা নিয়ে নিতে চান। ফিজিওথেরাপি জনিত যেকোনও ধরনের সমস্যা ও সুচিকিৎসার জন্য এ বিষয়ের একজন কনসালটেন্টের লিখিত প্রেসক্রিপশন নিতে হবে। এরপর আপনার চিকিৎসা একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দুই পেশার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু লোক ব্যাঙের ছাতার মতো সেন্টার খুলে বসেছে। তারা এমন মানুষ দিয়ে থেরাপি দিচ্ছে, যারা প্রাথমিক বিষয়গুলোও জানে না।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
শিবনারায়ণের চোখে আলো দেখছেন মশিউর ও কালাম
আমান উল্লাহ আমানকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিলেন আপিল বিভাগ
সর্বশেষ খবর
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের নামে ফেক আইডি, মামলা করতে এসে ধরা
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের নামে ফেক আইডি, মামলা করতে এসে ধরা
শেষ হলো উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের ভোট, চলছে গণনা
শেষ হলো উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের ভোট, চলছে গণনা
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচনে বাধা নেই
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচনে বাধা নেই
কাকে ভোট দিলেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক?
কাকে ভোট দিলেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক?
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?