X
বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
৬ আশ্বিন ১৪৩০

ডেঙ্গুতে গড়ে প্রতিদিন ১৩ মৃত্যু

সাদ্দিফ অভি
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:০০আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:৪৬

অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সেপ্টেম্বর মাসে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২৯ জন, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, হাসপাতালে ভর্তির একদিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন ৬৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন অধিকাংশ রোগী।  

দেশে ডেঙ্গু ছিল মূলত বর্ষাকালীন রোগ। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশি থাকতো এ রোগের প্রকোপ। চলতি বছর পাল্টে গেছে অতীতের সব ইতিহাস। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে এরই মধ্যে গড়েছে রেকর্ড। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হয়ে শীতকাল পর্যন্ত থাকবে। আর সরকারের জরিপ বলছে, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গত বছরের দ্বিগুণ। লার্ভা মিলছে ফ্রিজের ট্রের পানি কিংবা প্লেটের পানি ঝরানোর র‌্যাকের নিচে পর্যন্ত। তাই সবার মনে একই প্রশ্ন– ডেঙ্গু পরিস্থিতি কতদূর গড়াবে?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপে লার্ভার ঘনত্ব দ্বিগুণ

গত ২৫ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর দুই সিটিতে মশার ঘনত্ব নিয়ে বর্ষাকালীন জরিপ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ (৭৫ শতাংশ) এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও শিল্প এলাকা-বেগুনবাড়ি-তেজকুনিপাড়া)। ৪৯ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (পল্লবী ও মিরপুরের কিছু অংশ)। এছাড়া দক্ষিণ সিটির ১৯ শতাংশ এলাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০-এর বেশি। সর্বোচ্চ লার্ভার ঘনত্ব ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কাকরাইল-সিদ্ধেশ্বরী-পশ্চিম মালিবাগ) ৭৩ শতাংশ। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে (সেগুনবাগিচা-গুলিস্তান-প্রেস ক্লাব-ঢাকা মেডিক্যাল এলাকা) ৭০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এলাকায় মশার ঘনত্ব নিয়ে প্রতিবছর তিনটি জরিপ করে। জরিপের সময়কে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত পাঁচ শতাংশ বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ওই পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।

জরিপের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ঢাকার দুই সিটিতে সর্বোচ্চ এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি দেখা গেছে। উত্তর সিটির ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এ এলাকায় এডিসের লার্ভার গড় ঘনত্ব ২৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। দক্ষিণ সিটির ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এই সিটিতে এডিস মশার লার্ভার গড় ঘনত্ব ২৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বর্ষাকালীন জরিপে ঢাকা উত্তর সিটিতে ২১ শতাংশ এবং দক্ষিণে ১৯ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। ২০২০ সালে উত্তরে ১৩ এবং দক্ষিণে ১২ শতাংশ বাড়িতে, ২০২১ সালে উত্তরে ২২ এবং দক্ষিণে ১৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালে উত্তরে ১৩ এবং দক্ষিণে ১২ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।

প্রতিদিন গড়ে ১৩ মৃত্যু

গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,  ডেঙ্গু পরিস্থিতি ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালের প্রায় আড়াই গুণ বেশি রোগী জুলাইয়ে এবং দেড় গুণ বেশি রোগী পাওয়া গেছে আগস্টে। গত আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭১ হাজার ৯৭৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪২ জন। সেই হিসাবে আগস্টে গড়ে মারা গেছেন ১১ জন। সেপ্টেম্বরে এখন পর্যন্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৩ হাজার ৮৭৬ জন এবং মারা গেছেন ২২৯ জন। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন মৃত্যুবরণ করছেন।  

হাসপাতালে ভর্তির একদিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৬৩ শতাংশ

গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮৮ মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ৬৩ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির একদিনের মধ্যে যার বেশিরভাগই শক সিনড্রোমের কারণে। সব মিলিয়ে মৃত্যুবরণকারীদের ৮১ শতাংশ মারা গিয়েছেন হাসপাতালে ভর্তির ৩ দিনের মধ্যে। 

ডেঙ্গু রোগী গ্রামে গ্রামে

ময়মনসিংহ শহরে প্রায় ৩০ শতাংশ বাসাবাড়িতে এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল রয়েছে। ডেঙ্গু বিস্তার রোধে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ডে পরিচালিত জরিপের ফলাফলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আবার গত ১১ জুলাই পিরোজপুরের নেছারাবাদের বলদিয়া ইউনিয়নে ১০টি গৃহস্থালির ওপর একটি জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরমধ্যে  সাতটি বাড়িতেই এডিস লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব গৃহস্থালির ১৬টি কন্টেইনার পরিদর্শন করে আটটিতেই এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। এরপর ২৩ জুলাই পটুয়াখালীর দুমকির আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের ১০টি বাড়ির মধ্যে সাতটিতে এডিস মশার লার্ভা ধরা পড়ে। এই বাড়িগুলোতে পরিদর্শন চালানো ৩৭টি কন্টেইনারের মধ্যে ১০টিতে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করা হয়েছে।

এছাড়াও যশোর পৌরসভা এলাকায় ২০টির মধ্যে ১১টি গৃহস্থালিতে এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৌরসভার গড় ব্রুটো ইনডেক্স (এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক) ছিল ৮০।

এছাড়া গত ৫ থেকে ৯ জুলাই রাজশাহী শহরের পাঁচটি ওয়ার্ডের ৭৫টি গৃহস্থালির উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে। রাজশাহী শহরের গড় ব্রুটো ইনডেক্স ৪৬ দশমিক ৬৭।

২৩ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টিতে একটি বিস্তৃত জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এই ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতে ব্রুটো সূচক ২০ ছাড়িয়েছে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, যখন ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি হয়, তখন ধরে নেওয়া হয় এখানে এডিস মশাবাহিত রোগ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহেমদুল কবির বলেন, ডেঙ্গু এখন সারাদেশের যেকোনও জায়গায় হতে পারে। ডেঙ্গু যখন একটা সময় কোনও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে সেটাকে আমরা টার্গেট করতে পারি, এখন ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার থেকে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, কোনও বাড়িতে যখন একাধিক ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং যদি পাঁচ বছরের নিচে কোনও শিশু থাকে, তাহলে নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় সেই বাড়িতে নিয়মিতভাবে এডিস মশার প্রজনন হচ্ছে। মশাগুলো একজন থেকে আরেকজনকে কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ জন্য মশা যাতে জন্মাতে না পারে, সেই কাজটি আগে করতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেছেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গু পজিটিভ কেস ১০ গুণ এবং মৃত্যু তিন গুণ বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখানে অপরিকল্পিত নাগরায়ন, শিল্পায়ন এবং আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড, যেমন-বহুতল ভবন নির্মাণ, জলপথ রুদ্ধ করা, পুরনো গাড়ি ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে শহরগুলোকে মশার অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং আমরা সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। যেহেতু আমরা  প্রজনন এলাকা এবং মশার প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করছি, কিন্তু সেভাবে আমরা কখনোই এর প্রতিরোধ সম্পর্কে একইভাবে চিন্তা করছি না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কীটতত্ত্ববিদ এবং স্বাস্থ্যবিদের পাশাপাশি এখন আবহাওয়াবিদকে যুক্ত করতে করতে হবে। কারণ বৃষ্টি কবে থামবে সেটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন আর আশা করার কিছু নেই যে এডিস মশা কমে যাবে। এখন আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে মৃত্যু কমানো যায়।

তিনি বলেন, মৃত্যু কমাতে হলে আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এখনও অনেক জায়গায় সেটি এভেইলেবেল না। জ্বর আসার পর ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে।

/এমএস/
সম্পর্কিত
ডেঙ্গু চিকিৎসায় ভারত থেকে এলো ৫৩ হাজার ব্যাগ স্যালাইন
একদিনে ২১ মৃত্যু
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮৪৬ 
সর্বশেষ খবর
‘তারা ভাবে এটা তাদের জমিদারি’, মেয়র তাপসের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল
‘তারা ভাবে এটা তাদের জমিদারি’, মেয়র তাপসের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল
যমুনায় তিন দফা পানি বেড়ে ৫ কোটি টাকার ফসল নষ্ট
যমুনায় তিন দফা পানি বেড়ে ৫ কোটি টাকার ফসল নষ্ট
বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের কোচিং দলে শ্রীরাম
বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের কোচিং দলে শ্রীরাম
কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা স্থগিত করলো ভারত
কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা স্থগিত করলো ভারত
সর্বাধিক পঠিত
জাস্টিন ট্রুডো কি তাহলে নিজের পায়েই কুড়াল মারলেন? 
জাস্টিন ট্রুডো কি তাহলে নিজের পায়েই কুড়াল মারলেন? 
গ্রাহকের অজান্তে ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেলো কারা?
গ্রাহকের অজান্তে ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেলো কারা?
তালেবানি কালচার চাই, ওপেন কালচার চাই না: শাবি উপাচার্য
তালেবানি কালচার চাই, ওপেন কালচার চাই না: শাবি উপাচার্য
কানাডা ইস্যুতে মোদি-জয়শঙ্করের জরুরি বৈঠক
কানাডা ইস্যুতে মোদি-জয়শঙ্করের জরুরি বৈঠক
‘মামলা থেকে নাম আউট করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে’
‘মামলা থেকে নাম আউট করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে’