সুন্দরবনের প্রকৃতি, পাখির কলতান, প্রাণীবৈচিত্র্য সব পর্যটকেরই প্রিয়। কপাল ভালো থাকলে দেখা হয়ে যায় বাঘমামার সঙ্গে! এসব উপভোগের জন্য সমাপনী শিক্ষা সফরের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বেছে নেয় সুন্দরবন। আমিও ছিলাম তাদেরএকজন। বিভাগের চার শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ৬৮ জন শিক্ষার্থী সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যায় খুলনায় পৌঁছায়। পরে নির্ধারিত জাহাজে উঠে নিজেদের মতো সব গুছিয়ে নিই আমরা। জাহাজ চলতে থাকে সুন্দরবনের উদ্দেশে।
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এই স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ সবসময় প্রকৃতিপ্রেমী, বিজ্ঞানী, গবেষক ও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুরা প্রতি বছর এখানে বেড়াতে যায়।
ভূগোলবিদরা সময় ও স্থানের সঙ্গে মানুষ আর পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক চিহ্নিতকরণের চেষ্টা চালান। আমাদের শিক্ষা সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবিক জ্ঞান অর্জন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ ও চিত্তবিনোদন।
সুন্দরবনের যেসব স্থানে দর্শনার্থীরা সাধারণত ভ্রমণ করে সেগুলো হলো করমজল, হিরণ পয়েন্ট, কটকা বিচ, স্মরণখোলা, টাইগার পয়েন্ট, দুবলার চর ইত্যাদি। আমরা করমজল, কটকা, দুবলার চরসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। সুন্দরবনে ভ্রমণকালে স্থানীয় জনসাধারণ, বন বিভাগ, পর্যটকসহ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে কিছু তথ্য মিলেছে।
মৎস্য আহরণের জন্য দুবলার চর প্রসিদ্ধ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ জেলে। মাছ শিকারই তাদের প্রধান পেশা। এই চর বর্ষা মৌসুমে পানিতে প্লাবিত হয়। বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর দ্বীপটি। শুঁটকি মাছের জন্য দুবলার চরের সুনাম আছে। সাধারণত চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এখানকার শুঁটকি যায়, এমনকি বিদেশেও রফতানি হয়। এখানে কচ্ছপ, জেলিফিশসহ বিভিন্ন মাছ ও নানান প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।
সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও একইসঙ্গে বিপজ্জনক স্থান হচ্ছে হারবাড়িয়া। এটি বাঘের বাড়ি নামে পরিচিত। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর নানান বৈচিত্র্যময় প্রাণী ও পাখি দেখা যায়। খুব কাছ থেকে হরিণ দর্শন মেলে। বানর ও বন্য শূকর তো অহরহ। সুন্দরী গাছ এখানকার অন্যতম আর্কষণ। পুরো এলাকা সুন্দরী, গোলপাতাসহ বিভিন্ন উদ্ভিদে ঢাকা। এছাড়া আছে জাম ও কেওড়া বৃক্ষ। এখানকার একটি দীর্ঘ কাঠের পথ গভীর ম্যানগ্রোভ বন ঘুরে দেখতে পর্যটকদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কটকা বিচ অন্যতম। এ যেন সবুজে ঘেরা বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের সমাহার। এখানকার সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এটি বিরল ও রাজকীয় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এখানে সকাল-সন্ধ্যা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো পাখিদের কলতান কানে বাজে। এছাড়া আছে হরিণ, বাঘ ও বিভিন্ন ধরনের বানর। এখানেও সুন্দরী, গোলপাতা, কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়।
একদিনের জার্নির জন্য করমজল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ সুন্দরবনের প্রবেশপথে ও মংলা বন্দরের সবচেয়ে কাছে করমজল অবস্থিত। পাখিপ্রেমীদের জন্য এটি চমৎকার একটি জায়গা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী তো আছেই। হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র এই করমজল। এছাড়া এখানে লবণাক্ত পানির কুমির, ডুব হাঁস, বানর, সাপ, শিয়াল, নদীর ডলফিন চোখে পড়ার মতো।
এমএসসি’র শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা মূলত ভ্রমণের পাশাপাশি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ও পর্যটন শিল্পের ওপর কাজ করেছি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র দূরীকরণে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মনে হয়েছে, সঠিক পদক্ষেপ নিলে সুন্দরবন পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের জন্য এক অপার সম্ভাবনা। এমনিতেই সুন্দরবন পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সারাবছর। কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল ও ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ অবদান রাখবে পর্যটন খাত। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এই ম্যানগ্রোভ বন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে পর্যটন শিল্পে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না সুন্দরবন। এর মধ্যে অন্যতম পর্যটন শিল্প বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব, পর্যটন এলাকার অনুন্নত অবকাঠামো, স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির অভাব, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি, বাজেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ না দেওয়া, বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব।
ফলে সুন্দরবনকে পর্যটন শিল্পে সম্ভাবনাময় করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি বিনোদন, গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সুন্দরবন। যেমন: পর্যটন শিল্প বিকাশে ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। পর্যটন কেন্দ্র বিকাশে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সুন্দরবনের অধিকাংশ অংশ বাংলাদেশে, তাই এই সম্পদ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি।
সুন্দরবন ভ্রমণে বিদেশি পর্যটকদের উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। অবকাঠামোর উন্নয়ন ও টেলিফোন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন দরকার। পর্যটকদের ভ্রমণের স্থানগুলো নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন তারা আবারও আসতে আগ্রহী হয়। একইসঙ্গে খুলনায় বিমানবন্দর স্থাপন, রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করতে হবে। পর্যটকরা যেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই হোটেল বুকিং, বিমান ও ট্রেনের টিকিট পেতে পারে সেজন্য চাই উদ্যোগ।
আবাসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
ভ্রমণপিপাসুরা মূলত তিন ধরনের পরিবহন ব্যবহার করে সুন্দরবনে যায়। যেমন বাস, ট্রেন ও বিমান। ঢাকা থেকে বিমানে যশোর বিমানবন্দরে নেমে বাস অথবা ট্রেনে চেপে খুলনায় যেতে হবে। তবে অধিকাংশ মানুষ সড়কপথ বেছে নেয়। আমরাও সুন্দরবনে ভ্রমণের উদ্দেশে বাসে চড়েছি। খুলনা ও মংলায় রাতে থাকার জন্য বিভিন্ন হোটেল ও রেস্টহাউজ আছে।