X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে করণীয়

ডা. রিফাত আল মাজিদ
ডা. রিফাত আল মাজিদ
২২ এপ্রিল ২০২২, ১৭:২২আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২২, ১৭:৩৫

মাদকাসক্তি অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। নিজেদের সার্কেলে কিংবা বন্ধুদের মধ্যে কেউ মাদকসেবী হলে তার থেকে অন্যরা নতুন অভিজ্ঞতা লাভের আশায় এ পথে পা বাড়ায়। আর এভাবেই তাদের মাদকের পথে যাত্রা শুরু হয়। এসব পরিস্থিতি এড়াতে প্রয়োজন সকল স্তরে সব পর্যায়ে বিশেষ সচেতনতা। যাতে করে নতুন কেউ এই পথে না যেতে পারে। আমরা সবাই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত আছি। একটি পরিবার, একটি জীবন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে মাদকের বিষাক্ত ছোবলে। মাদকাসক্তি থেকে বাঁচতে হলে এবং বাঁচাতে  হলে আগে জানতে হবে মাদকাসক্তি কী? 

নেশায় জড়িয়ে পড়া বা মাদকাসক্তি মূলত একটি  রোগ বা ব্যাধি। মেডিক্যাল সাইন্সে মাদকাসক্তিকে বলা হয় ক্রনিক রিলাক্সিং ব্রেইন ডিজিজ বা বারবার হতে পারে এমন স্নায়ুবিক রোগ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, একজন ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কিছু শর্ত আছে। প্রথমত, যেকোনো উপায়েই হোক নেশাদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে, যেটিকে ইংরেজিতে ক্রেভিং বলে। দ্বিতীয়ত, নেশাবস্তু গ্রহণের মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে দিতে  বাধ্য হয়, যেটিকে টলারেন্স বলা হয়ে থাকে। তৃতীয়, নেশা জাতীয় বস্তুর প্রতি দৈহিক এবং মানসিক নির্ভরতা গড়ে ওঠে। নেশাবস্তুটি গ্রহণ করতে না পারলে তার দৈহিক ও মানসিক অবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়।

সবচেয়ে আশংকাজনক সংবাদ হচ্ছে গোটা বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি ৩ দশমকি ৩০ শতাংশ, ১২-১৭ বছর বয়সী ১ দশমিক ৫০ ও ৭-১১ বছর বয়সীদের মধ্যে ০ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। অর্থাৎ ৭ বছরের শিশুও মাদকাসক্ত হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। সার্বিকভাবে দেখা যায়, পুরুষদের মধ্যে ৪ দশমিক ৮০ এবং নারীদের ০ দশমিক ৬০ শতাংশ মাদকাসক্ত।

মাদকাসক্তদের মধ্যে গাঁজায় আসক্ত ৪২ দশমিক ৭০, মদে ২৭ দশমিক ৫০, এমফেটামিন জাতীয় ওষুধে ১৫ দশমিক ২০, আফিম জাতীয় দ্রব্যে ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের বড়ি বা ট্যাবলেট খায় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ জরিপ থেকে আমরা বাংলাদেশের মাদকাসক্তের সার্বিক একটা ভয়াবহতার চিত্র বুঝতে পারি।

খুব আশঙ্কার ব্যাপার হলো, দেশের তরুণ কিংবা কিশোররা মাদকে বেশি আসক্ত হচ্ছে। দেশে মাদকাসক্তের প্রায় ৬৩ শতাংশ তরুণ। কিশোর বা তরুণদের ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই আমরা বলে থাকি ওদের আবেগ অনিয়ন্ত্রিত এবং বয়সটিতে বন্ধুদের প্রভাব অনেক বেশি থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই নিছক কৌতূহল এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের বশে নেশা করে। অনেকের ক্ষেত্রে সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনও হতাশা থেকে শুরু হয়। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত হয়েও অনেকে কিন্তু মাদকে ঝুঁকে পড়ে। দেশে নানা জাতীয় মাদকের সহজলভ্যতাও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ।

এছাড়া মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে পারিবারিক অনেক কারণও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। যেমন পারিবারিক কলহ দিনের পর দিন চলতে থাকলে, মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বোনদের কেউ মাদকাসক্ত, মা-বাবার সাথে শিশু-কিশোর বয়সে সন্তানের স্নেহপূর্ণ সম্পর্কের ঘাটতির কারণেও মাদকে আসক্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এখন আসা যাক তরুণরা মূলত কোন কোন মাদকে আসক্ত হয়। সাম্প্রতিক ডিএসএম-৫ বা ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিস-অর্ডারসের পঞ্চম সংস্করণে ১০টি দ্রব্যকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো অ্যালকোহল বা মদ, ক্যাফেইন, ক্যানাবিস বা গাঁজাজাতীয় দ্রব্য, হ্যাল্যুসিনোজেনস বা বিভ্রম সৃষ্টিকারী দ্রব্য (এলএসডি, বিভিন্ন ধরনের ইনহ্যাল্যান্টস অর্থাৎ যেগুলো শ্বাসের সাথে গ্রহণ করা হয়), অপিওয়েডস বা আফিম জাতীয় দ্রব্য, সিডেটিভ বা উত্তেজনা প্রশমনকারী দ্রব্য (ঘুমের ওষুধ, হিপনোটিকস বা সম্মোহক পদার্থ), অ্যানজিওলাইটিকস বা উদ্বেগ প্রশমক দ্রব্য, স্টিম্যুলেন্টস বা স্নায়ু উত্তেজক দ্রব্য (অ্যামফিটামিন জাতীয় দ্রব্য বা কোকেইন) এবং বিভিন্ন তামাকজাতীয় দ্রব্য।

তবে আশার বাণী হলো সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মধ্যদিয়ে একজন মাদকসক্তি ব্যক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারে এবং মাদক থেকে দূরে থাকতে পারে। মাদক গ্রহণজনিত রোগকে অনেক সময় ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের সাথে তুলনা করা হয়, কারণ যে ব্যক্তির একবার ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ হয় তার সারা জীবন কিছু বিধিনিষেধ বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকতে হয়। ঠিক তেমনি মাদক নির্ভরশীলতার চিকিৎসার পরেও রোগীকে কিছু বিধিনিষেধ বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকতে হয়। এর ব্যাতিক্রম ঘটলে রোগী পুনরায় মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদক নির্ভরশীলদের চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে একাধিক পদ্ধতি প্রচলিত আছে বা অনুসরণ করে থাকে। একসময় মাদক নির্ভরশীলদের চিকিৎসা ছিল বিচ্ছিন্ন। কিছু চিকিৎসা কেন্দ্র ঔষুধ নির্ভর চিকিৎসাকে গুরুত্ব প্রদান করত। আবার কোনও কোনও কেন্দ্র ঔষুধ বর্জিত পুনর্বাসন কেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসরণ করত। কাউন্সেলররা শুধু কাউন্সেলিং ভিত্তিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব প্রদান করতেন। এ সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক সময় রোগীর সমস্যা কেন্দ্রিক না থাকায় অনেকাংশেই চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয়নি। একজন মাদক নির্ভরশীলকে মাদকমুক্ত করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। কারণ একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্বিক ও পারিবারিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণের কারণে অনেকেরই আচরণ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে থাকে বিধায় তাকে মাদকমুক্ত থাকতে হলে তার আচরণ ও চিন্তা- চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন। আচরণ পরিবর্তন একটি কষ্টসাধ্য বিষয় হলেও মাদকমুক্ত থাকার সাথে আচরণ পরিবর্তন গভীরভাবে জড়িত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর চিন্তা ও আচরণ পরিবর্তনকে গুরত্বের সাথে মাদক চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এজন্য চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তির দৈহিক চিকিৎসার পাশাপাশি আচরণ পরিবর্তন, নৈতিক গুণাবলী শিক্ষা প্রদান এবং এমনভাবে সুস্থ করে তোলা যেন সে জীবনের সাধারণ সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে চিকিৎসা শুরু করলে দ্রুত সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অথবা সাইকোথেরাপি খুব উপকারী। শুরু থেকেই যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তবে দ্রুত ফল পাওয়া সম্ভব। 

লেখক

জনস্বাস্থ্য গবেষক ও চিকিৎসক 
উপ-পরিচালক, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স অ্যান্ড রিসার্চ 

/এনএ/
সম্পর্কিত
সাহরিতে রাখতে পারেন এই ৮ খাবার
পটাশিয়াম কমে যাওয়ার ৮ লক্ষণ
খেজুর খাওয়ার ১০ উপকারিতা
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা