X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

লেখালেখির আনন্দ হলো ভাষার নানা সম্ভাবনা: আবদুলরাজাক গুরনাহ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
১২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৮আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৯

[১৯৯৭ সাল। আমি তখন লন্ডনে, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছি। ক্লাস শেষে সপ্তাহে দুই-একবার হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই চেরিং ক্রস রোডের পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই। সেরকমই এক বিকেলে র‌্যাকে পেয়েছিলাম আবদুলরাজাক গুরনাহ’র উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’। বিলেতের হ্যামিশ হ্যামিল্টন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত আড়াইশ’ পৃষ্ঠার বইটির কমলা রঙের প্রচ্ছদ এখনও চোখে লেগে আছে। এর কিছু দিন পরেই উপন্যাসটি পড়ে ফেলি এবং পছন্দের বইয়ের তালিকায় যুক্ত হয়। এই বইয়ের লেখককে ২৪ বছর পরে  সুইডেনের নোবেল কমিটি যে সম্মাননা জানাবে সেটা কে-ই বা জানতো! আবার স্বয়ং আবদুলরাজাক ঢাকা লিট ফেস্টে এসে হাজির হবেন সে কথা তো তখন ছিল অভাবনীয়। আর প্রকৃতির আজব খেয়ালে আমার মতো সাহিত্যের এক খুদে পাঠক, অধ্যাপক ও লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তার সামনে বসবো, সেও এক বিস্ময় বটে।

৭ জানুয়ারি ২০২৩। দুপুর ১২টা প্রায়। লিট ফেস্টের তৃতীয় দিন। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনের গ্রিন রুমে অপেক্ষা করছি। আশপাশে ক্যামেরাম্যান, পরের সেশনের দুই জন বক্তা, পত্রিকার দু-চার জন সাংবাদিক, লিট ফেস্টের কয়েকজন কর্মী। এরইমধ্যে সাক্ষাৎকার নিতে হবে। একে তো অধ্যাপক আবদুলরাজাক কথা বলেন মেপে মেপে, তার ওপর সময় বেঁধে দেওয়া আছে ১০ মিনিট! ‘এ ওয়ার্ল্ড উইথআউট এ সেন্টার’ নামের সেশন শেষেই চলে এলেন ৭৪ বছর বয়স্ক আবদুলরাজাক গুরনাহ। শব্দের কারিগরি দিকটা দেখে শুরু হয় আমাদের সামান্য কথোপকথন। কোলাহলের মধ্যেই চলে আমাদের মৃদু স্বরের ওঠানামা।]

রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী: আপনি দরিয়ার পারের মানুষ (উল্লেখ্য, আবদুলরাজাক গুরনাহর একটি উপন্যাসের নামই ‘বাই দ্য সি’)। আমরা নদীমাতৃক দেশের মানুষ। বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার অভিমত যদি জানাতেন।

আবদুলরাজাক গুরনাহ: এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তা গাড়ির জানালা দিয়ে ঢাকার কিয়দংশ। আমার পক্ষে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলাটা সম্ভব নয়।

২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ`র সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী (ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম)

রফিক-উম-মুনীর: বাংলাদেশ ঢাকাকে ছাড়িয়ে আরও অনেকটুকু, অনেক কিছু।

গুরনাহ: কিন্তু আমার কল্পনায়, আমি যখন বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবি তখন যে ছবি দেখি তাতে আছে নদী, বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন ইত্যাদি। এ যে এক ভাটি অঞ্চল তাও আসে আমার ভাবনায়। আমি এও জানি যে উত্তর দিকটা পাহাড়ি।

রফিক-উম-মুনীর:
দক্ষিণ-পূবদিকটাও পার্বত্য।

গুরনাহ: ওহ্...তা আমার অজানা।

রফিক-উম-মুনীর: ভবিষ্যতে হয়তো আপনার সুযোগ হবে বাংলাদেশ ভালো করে ঘুরে দেখার। জানতে পারবেন এ দেশ এবং এর মানুষকে।

গুরনাহ: আশা করি।

রফিক-উম-মুনীর: আমরা জানি আফ্রিকা বহু বহু ভাষার একটি মহাদেশ। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর রেখে যাওয়া ভাষাগুলো ছাড়াও রয়েছে অজস্র গোষ্ঠীর ভাষা, যার মধ্যে কিসোয়াহিলি উল্লেখযোগ্য। কারণ, এটি সম্ভবত উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে চলতি ভাষা। আফ্রিকার কোনও কোনও লেখক ঔপনিবেশিক ভাষায় না লিখে তার প্রধান বা মাতৃভাষায় লেখেন। আমি কি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি আপনার মাতৃভাষা কিসোয়াহিলিতে না লিখে ঔপনিবেশিক প্রভু ইংরেজদের রেখে যাওয়া ইংরেজিতে কেন লেখেন?

গুরনাহ: কিসোয়াহিলি আমার প্রধান ভাষা। আমি বিশ্বাস করি না যে লেখালেখি সবসময় একটি ভাষাকে বেছে নেওয়ার মতো কোনও সহজ ব্যাপার। বিশেষ করে যখন ভাষার বেলায় লেখকের সামনে অন্য কোনও বিকল্প থাকে, অন্য কোনও ভাষায় দখল থাকে… এটা একটা দিক। আমি কাউকে বলে দিতে চাই না যে এই ভাষায় লেখো, কারণ এটা তোমার ভাষা, এই মাতৃভাষায় লেখাটা তোমার অবশ্য কাজ। কেউ কেউ আছে এ ব্যাপারটাকে ভিন্নভাবে দেখে। তাদের মত এই যে প্রত্যেকেরই যার যার প্রধান বা মাতৃভাষায় লেখা উচিত। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আমার দৃষ্টিকোণটা এরকম যে কেউ চাইলেই ফরাসি বা বাংলায় লিখতে পারে। এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কারও ইচ্ছার ওপর হুকুম জারি করতে চাই না। পাশাপাশি আমি বলতে চাই যে আমার বেলায় ইংরেজি ভাষার সবক হয়েছিল স্কুলে থাকতেই, কারণ আমরা ব্রিটিশদের কলোনি ছিলাম। তখন আমি বুঝলাম যে ইংরেজি ভাষায় আমার একটা স্বাচ্ছন্দ্য আছে, আমি ভাষাটাকে এমনভাবে ব্যবহার করতে পারছি, যাতে করে আমার আনন্দ হচ্ছে, ব্যাপারটা প্রীতিকর। আমি সেই সময় ইংরেজিতে পড়ছিলামও, পড়বার জন্য সেই সময়কার জানজিবারে অতি সামান্য যা যা পাওয়া যেতো। আর পাঠের সঙ্গে তো লেখার ওতপ্রোত সম্পর্ক। তাই বলবো, পর পর কিছু ঘটনা এবং একই সঙ্গে সেই প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা ভাষার সঙ্গে এক ধরনের মিতালি আবিষ্কারের কারণে পরে যখন চিন্তা ও লেখালেখির প্রসঙ্গটা এলো, তখন আমি এক লহমায় ইংরেজিতেই ভাবতে শুরু করলাম, কেননা, এ ভাষাতেই আমার এক ধরনের জানাশোনা ও জ্ঞান ছিল। যদিও বলতেই হয়, এ ভাষাতেই লেখালেখি চালিয়ে নেবো বা কোনও কিছু প্রকাশ করবো এরকম কোনও ভাবনাই তখন কাজ করেনি।

ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসরে একটি সেশনে বক্তব্য রাখছেন আবদুলরাজাক গুরনাহ (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

রফিক-উম-মুনীর: ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস লেখার পর্বটা আরও অনেক পরের?

গুরনাহ: হ্যাঁ; স্রেফ আরাম, স্বস্তি ও আনন্দের বোধ থেকেই সেই ছোটবেলায় ইংরেজিতে লেখা শুরু করেছিলাম। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখালেখি আরও অনেক পরের ঘটনা। শুরুতে ইংরেজি ভাষার নির্বাচনটা ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার।

রফিক-উম-মুনীর: আপনি একজন ভুবনখ্যাত গল্পকথক। গল্পকথনের বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আফ্রিকায় রয়েছে মুখে মুখে গল্প বলার চল। আমরা গ্রিয়োট ঐতিহ্যের কথা জানি। মৌখিক গল্পকথনের রীতির সঙ্গে আপনার ফিকশন লেখার সম্পর্ক কতটুকু বা আপনার লেখালেখিতে এর ভূমিকা কতখানি?

গুরনাহ: হুমম ... গ্রিয়োট একটু ভিন্ন। একজন গ্রিয়োট হলেন সামষ্টিক গল্প-কিস্যার ধারক ও বাহক। তিনি একজন বিশেষ ধরনের গল্পকথক। গণমানুষের বা বলা যায় ওটা সামষ্টিক স্মৃতির ধরন। কিন্তু মৌখিক গল্পকথন হলো প্রলেতারিয়ো ধরন, যা বাড়িতে বাড়িতে ঘটে। দাদি-নানির মুখে শোনা গল্প-কিস্যা...।

রফিক-উম-মুনীর: আমরা এমন গল্প-কিস্যা শুনে বড় হয়েছি।

গুরনাহ: ঠিক তা-ই। এবং এটার সঙ্গে কোনও বিশেষ একটা জায়গার সম্পর্ক নেই। যদিও বলা দরকার টেলিভিশন যন্ত্রটা এসে সে জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে।

রফিক-উম-মুনীর: সালমান রাশদির কথা বলতে পারি, যিনি ভারতবর্ষের এই মৌখিক রীতির কথা বলেন এবং যার উপাদান তার ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসে উপস্থিত।

গুরনাহ: হ্যাঁ... আর এই যে টেলিভিশন আসার পর এ ঐতিহ্যটা যে হারিয়ে গেলো তা দুঃখের বিষয়। ছোট ছোট পরিবার যার নাম হলো নিউক্লিয়ার পরিবার... ওই টিভি এলো, আর গল্পকথনের প্রক্রিয়াটা হারিয়ে গেলো, যেখানে দেখা যেতো পরিবারের ছোটরা বসে বড়দের কাছ থেকে হাঁ করে গল্প শুনছে, বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক মহিলারা বসে বসে ছোটদের গল্প শোনাচ্ছে এরকম দৃশ্যটা মিলিয়ে গেলো। পুরুষরাও বসতো, বসে বসে আড্ডা দিতো, কিন্তু তারা ছোটদের ঠিক কাছে বসতে দিতো না। কারণ, তারা নোংরা গল্পসল্প করতো।

সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় আবদুলরাজাক গুরনাহ (ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম)

রফিক-উম-মুনীর: আমার সামান্য পাঠের ভিত্তিতে বলতে চাই যে আপনি সহজ সরলভাবে বললেও আপনার উপন্যাসের অন্তর্দেশে বয়ে যায় এক গহন নদী, যা অপরিচিত অপাংক্তেয় মামুলি কোনও ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র মূর্ত করে তোলে। এমন সব মানুষের গল্প আপনি বলেন যাদের কথা কেউ ওভাবে বলে না এবং যাদের অনেকের কথা কেউ জানেও না। এবং গল্পগুলো খণ্ড-খণ্ড... মামুলি মানুষের জীবনের টুকরো কথা। আরও থাকে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের জনপদগুলোর আন্তসম্পর্কীয় ইতিহাসের কাহিনি।

গুরনাহ: লেখালেখির আনন্দ হলো ভাষার নানা সম্ভাবনা, এর সুর ও স্বরকে নানাভাবে ধরবার চেষ্টা করা, একটা আকার দেওয়া। আর এ কাজে শৃঙ্খলা আনতে হয়। লেখালেখির আনন্দ হলো ওই প্রক্রিয়াটুকু , যা তুমি বললে।

রফিক-উম-মুনীর: আমি একটু-আধটু অনুবাদের কাজ করি। ইংরেজি ট্রান্সলেশন শব্দটি বাংলায় হলো অনুবাদ, যা সংস্কৃত থেকে এসেছে। ইংরেজিতে অনুবাদ শব্দটিকে ‘আফটারলাইফ’ শব্দ দিয়েও বলা যেতে পারে। আপনার যে উপন্যাসটি আমি এই মুহূর্তে পড়ছি তার নাম হলো ‘আফটারলাইভস’। এই নাম কেন?

গুরনাহ: কারণ এই উপন্যাসে এমন কয়েকটি মানুষের মর্মন্তুদ কাহিনি আছে, যাদের জীবনকে উপনিবেশ কীভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে গেছে তারই কথা আছে– মানে ঔপনিবেশিকোত্তরকালের জীবন, যা তাদের নতুন জীবনের কাহিনি।

রফিক-উম-মুনীর: আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আপনাকে ধন্যবাদ।

গুরনাহ: তোমাকে ধন্যবাদ

 

/ডেজএস/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বলে নজর রাখো: গর্ডন গ্রিনিজ
সাক্ষাৎকারআগের চেয়ে মহামারির আশঙ্কা বেড়েছে: সারাহ গিলবার্ট
‘স্যান্ডবক্স: ফিউচার ইজ নাও’
সর্বশেষ খবর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা