X
মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
৩ আষাঢ় ১৪৩২

মুস্তাফিজ শফির সাহিত্য: মায়া তো মায়াই, যত দূরে যায়...

সালেহা চৌধুরী
২০ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩:০৮আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩:১৭

মনে আছে একবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলাম, আপনার ‘উজান’ তো পুরোটাই কবিতা। তিনি বলেছিলেন- না আমি কবিতা লিখতে পারি না। পরে কলকাতার এক কবিতার ক্যাসেটে দেখি ‘উজানে’র কিছু অংশ কবিতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মুস্তাফিজ শফির বেলায় ঘটনা অন্যরকম। তিনি গদ্য ভঙ্গিমায় কবিতা বলে যা লিখেছেন তা একেবারে নিটোল নিখুঁত কবিতা। দেখতে গদ্যের মতো কিন্তু টসটসে কবিতার রসে টইটম্বুর। যা বারবার পড়তে ভালো লাগে।

সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফিকে চিনতাম। কিন্তু এখন জানছি সাহিত্যিক মুস্তাফিজ শফিকে। কবিতার চেহারা আর গদ্যের চেহারার ভেতরে যে দেয়াল তা তিনি ভেঙে দিয়েছেন। আটত্রিশটি কবিতা আছে ‘দহনের রাত’ কাব্যগ্রন্থে।

সবগুলো গদ্যের মতো করে লেখা। প্রথম কবিতা চন্দ্রগ্রস্ত, সেখান থেকে একটু তুলে দিলাম- ‘আজ তবে দহনের রাত। ধবল জ্যোৎস্নায় গাছের ছায়ায় বাতাসেরা খেলা করে। আর কানে বাজে মায়াহরিণীর অস্ফুট পদধ্বনি, বনমোরগের আর্তনাদ। শৈশবের সেই বেহালাবাদকের কথা মনে করতে করতে এখন টের পাই প্রকৃতির ভায়োলিন। আকাশের নীল ধরবে বলে দিগন্তরেখা বরাবর ছুটত সে। এভাবেই তবে শূন্যতার কাছাকাছি যাওয়া যায়। এভাবেই পুড়ে খাক হয় বধির স্তব্ধতা।’

মনে আছে দিগন্ত ধরব বলে আমার মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা। বোকা ছেলেবেলা। বড় ভাই বলেছিলেন- রুনু এ কথা মনে রাখিস, দিগন্তকে কখনো ধরা যায় না। ও তো চিরকাল ছাব্বিশ মাইল দূর। ভাবতাম দিগন্তের ওপারেই আছে রূপকথার সব রাজারানির বাড়ি। মুস্তাফিজ শফির কবিতায়ও সেই গভীর আর্তি কিছু একটা ধরতে হবে, কিছু একটা ছুঁতে হবে। কোথায় আছে সেই সীমারেখা? মায়া মেঘ নির্জনতাতেও একই গদ্যভঙ্গি। এখানে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, জাদুবাস্তবতার অপূর্ব সমাহার। পড় তোমার প্রেমিকার নাম দিয়ে শুরু­- তারপর এসেছে দহনের রাত, মধ্যবিত্ত কবিতাগুচ্ছ, কবির বিষণ্ন বান্ধবীরা, মায়া মেঘ নির্জনতা, ব্যক্তিগত রোদ

এসব কবিতাগ্রন্থ। নামেই পরিচয়। কবিতার মতো দেখতে যেসব কবিতা সেগুলোও আছে সার্থকভাবে। আমি কি বলব, তিনি মূলত কবি? তাঁকে প্রশ্ন করে একদিন উত্তর জেনে নেব।

ব্যক্তিগত রোদ এবং অন্যান্য কবিতা বইয়ের কয়েক পঙ্ক্তি-

১. ওপারে পুড়ছো তুমি এপারে আমার ঘর
মাঝখানে অন্ধকার, শব্দহীন নিভৃত বালুচর।


২. দৃশ্যে অদৃশ্যে থাকো তুমি আত্মার চিৎকারে
করুণার বালুচরে খুঁজে নিও আহত পাখিটারে।

৩. বল কত আর দুঃখ পুষে রাখি
লোকে যাকে দুঃখ বলে, আমি বলি পাখি।

ব্যক্তিগত রোদের কয়েক পঙ্ক্তি। পুরো বইটাই আমি দিতে চেয়েছিলাম। কী সব সুন্দর কবিতা! মনে আছে একদিন গোলাম সারওয়ারকে বলেছিলাম- সারওয়ার, একদিন শীতের দুপুরে, রোদের ভেতরে, তোমার বাড়ির ব্যালকনিতে এক কাপ চা পান করতে ইচ্ছে হয়। অবশ্যই! উত্তর দিয়েছিল ও। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত ভালো লাগার ব্যালকনিতে রোদের ভেতর বসা হয়নি। জীবনে তো কত কিছুই হয় না। আর তাই তো দলছুট শব্দেরা কবিতায় সে খেদ লিখে রাখে। কবি তাই প্রশ্ন করেন- ‘তুমি কি নীল ঘাসফুল, মৌন তৃণ/হিমালয় থেকে নেমে আসা রহস্য নদী/নক্ষত্রের শেষে মাঠের শরীরে, শস্যের চিহ্নরেখা/তুমি কী/,আসলেই বলো তুমি কী/হিংস্র সময়ের ভিড়ে তুমি কি তবে আশা/নদী নয় নক্ষত্র নয়, এক ঝাঁক রহস্য আধার।’ সেই প্রশ্ন তুমি বলো তুমি কে? কেন তুমি স্বপ্নে আসো কেন কাঁদাও, কেন তোমাকে ধরতে চাই আমি? সেই একই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের- হে জীবন দেবতা তুমি বল তুমি কে? কবির প্রশ্ন কি কোনো উত্তর পায়? পায় না। তারপর কবি একসময় সমঝোতায় আসেন।

কবির বিষণ্ন বান্ধবীরার পাঁচ নম্বর কবিতায় যেন বুঝে ফেলা আসলে তুমি কে? তারপর কত রহস্য- শালিকের ডানায় তুমি/বেঁধেছো শাড়ির আঁচল/আমি শুধু বরুণের ডালে/দুপুরের চঞ্চল রোদ।’

আহা, কবি নিজেই তখন রোদ হয়ে এক প্রকার সমঝোতা করেন। এই পাওয়া-না পাওয়ায় মৌন-মুখর কবিতা মুস্তাফিজ শফির। আবার দহনের রাতে কবি বলেন- পূর্বজন্মে তুমি নদী ছিলে আর আমি তরঙ্গে ভাসা কচুরিপানা/হাজার বেদিনীর দাঁতে ঝিলিক দেওয়া/হাসিতে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে এখনও তুমি দুলে দুলে/ওঠো, আর আমি হাবুডুবু খেতে খেতে/ভালোবাসার নামে পাঠ করি কোন এক আশ্চর্য আখ্যান।’ সেই পাঠ রূপ পায় কবিতায়।

কবির বিষণ্ন বান্ধবীরা, মায়া মেঘ নির্জনতা, বিরহসমগ্র, পড় তোমার প্রেমিকার নামে, ব্যক্তিগত রোদ এবং অন্যান্য, মধ্যবিত্ত কবিতাগুচ্ছ, দহনের রাত- সবগুলোই এমনি মনোহর হৃদয় জাগানিয়া কবিতায় সমৃদ্ধ। সবগুলোই সুখপাঠ্য, হৃদয়ে কোথায় যেন ব্যথা জাগায়। পাতায় লেগে থাকা এক ফোঁটা শিশিরের মতো আবার জানান দেয়, আমি আছি। সহৃদয় হৃদয় সংবাদী হয়ে পত্রছত্রে কাঁপন তোলে। কেমন এক কান্নার মতো আনন্দ মেঘের মতো ছেয়ে ফেলে পাঠককে।

যদি আমি এখানে থামি তা হলে কবিতা নিয়ে একটু আলোচনা হয় বটে তবে তাঁর পুরো সাহিত্য নিয়ে নয়। আমি আর কিছু বলার আগে এবার বলতে চাই তাঁর সেই বিশেষ বইয়ের কথা, যার নাম ‘নির্বাচিত অনুসন্ধান’। বিবিধ সিরিজ প্রতিবেদন। মাদক, হাসপাতালের অপরাধী চক্র, ময়নাতদন্ত, রক্ত ব্যবসা, এইডস পরিস্থিতি, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, টানবাজার ট্র্যাজেডি ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় অনুসন্ধান। প্রতিটি বিভাজনে অনেকগুলো পর্ব। জানতে পেরেছি, তাঁরই কলমের জোরে অ্যাসিডদগ্ধ মেয়েরা প্রথমবারের মতো বিদেশে যেতে পেরেছিল চিকিৎসা করাতে। সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠ ফসল এই গ্রন্থ। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্ত নানা সব প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহায়ক পাঠ্য। যে অ্যাসিডসন্ত্রাস নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো জনমত সৃষ্টি করেছিল, তারই অন্যতম রূপকার তিনি।

বাংলাদেশের অ্যাসিড নিক্ষেপের ওপর প্রথম সিরিজ প্রতিবেদন করেন মুস্তাফিজ শফি। তখন তিনি কাজ করতেন আজকের কাগজে। এ কারণে তিনি পান- ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পুরস্কার। এর পর যখন প্রথম আলোতে কাজ করতে আসেন, লিখতে শুরু করেন ‘হাসপাতালে অপরাধী চক্র’। এই সিরিজটি লেখার ফলে আর একটি পুরস্কার পান তিনি। সেই পুরস্কারটির নাম ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ (টিআইবি) অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার। ২০০৩ সালে তাঁর কলম আবার পুরো দেশকে বিশেষ প্রবন্ধে জাগিয়ে তোলে। ওই বছর এপ্রিল মাসে তিনি  লেখেন ‘মরণ নেশা মাদক’ নামের বিশেষ সিরিজ প্রতিবেদন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম আলোর মাদকবিরোধী কর্মসূচি।

মুস্তাফিজ শফির কয়েকটি উপন্যাসের ভেতর ‘ঈশ্বরের সন্তানেরা’ আমার খুব মনে পড়ছে। সেখানে আছে আর এক সমস্যা। বৈধ আর অবৈধ সন্তানের কথা। আমরা কি পশ্চিমের দাবিতে একটি শিশুকে পৃথিবীতে আসতে দেব? না মায়ের বিয়ে হয়নি বলে তাকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলব? মুস্তাফিজ শফি এসব নিয়েও ভাবেন। তারই কলমে লেখা হয় একজন সাহসী নারীর সংগ্রাম।

জানা যায় তিনি যখন ‘প্রথম আলোর’ জন্য পোস্টমর্টেম নিয়ে তাঁর আলোচিত সিরিজটি লেখেন তখনই মাথায় আসে ‘জিন্দা লাশ অথবা রমেশ ডোম’ উপন্যাসের প্লট। প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে তিনি পোস্টমর্টেম পরীক্ষার কথা জানতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে একই নামের দুই ডোম রমেশের কাছে যা শুনেছিলেন, সেসব নিয়েই ‘জিন্দা লাশ অথবা রমেশ ডোম’ নামের এই উপন্যাস। এখানে কল্পনা আছে। সে কল্পনা বাস্তবের। সে যাই হোক রমেশ ডোম ওর নিজের ভাষায় বলেছিল- ‘লাছের বুকে ছুরি চালাইতে চালাইতে আমরা হালায় তো জিন্দা লাছ হইয়্যা গেছি। এই মর্গই আমাগো ঘর, আমাগো ছংছার।’ এই ঘর-সংসারের গল্প পাঠক নিজে পড়ে নেবেন। কথা প্রকাশ প্রকাশিত বইটি বাজারে আছে। মুস্তাফিজ শফি কবিতায় একজন আর ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসে অনবদ্য আর একজন। যখন তিনি পত্রিকা সম্পাদনা করেন তখন? উপরোক্ত এই দুই গুণাবলিতেই চমৎকার। বেশ একটু ভালো লাগা মিষ্টি স্বভাব তাঁর।

কবিতার কথা বললাম। প্রবন্ধের কথা জানালাম। উপন্যাস-গল্পের একটুখানি স্বাদ দিলাম। এখন বাকি থাকল কী? বাকি শিশুসাহিত্য। তিনি শিশুসাহিত্যে বলে দেন কোন বয়সের ছেলেমেয়েরা এগুলো পড়বে। তাঁর শিশু-কিশোর বইগুলোর নাম- ভূতের সঙ্গে পদ্য, মাথাকাটা ভূত বাহিনী, মায়াবী সেই ভূতকন্যা, ভূত কল্যাণ সমিতি ইত্যাদি। আমি বইগুলো পড়িনি। তাই বলতে পারলাম না কেমন। তবে এ কথা বলতে পারি, ভূত নিয়ে লেখা বইগুলো শিশু-কিশোররা পাঠ করে আনন্দ পাবে। প্রশ্ন, ভূত ছাড়া তিনি কি অন্য বিষয় নিয়ে লিখছেন বা লিখবেন? আশা করি, লিখবেন। বা আমার জানার বাইরে লিখে ফেলেছেন।

বিলেতের বাঙাল নামে তাঁর একটি বই আছে। বইটি পড়া হয়নি। দীর্ঘদিন বিলেতে থেকে বাঙালি-মানস খানিকটা জানি। আর আছে একাত্তরের বিজয়িনী। নামেই বোঝা যায়, এরা কারা। এবং আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব চে গুয়েভারার জীবন ‘চে’।

পুরস্কারের কথা আগেই বলেছি। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, লায়ন্স ক্লাব, ইউনেস্কোর মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড- এসবও তিনি পেয়েছেন।

মুস্তাফিজ শফির জন্ম সিলেটের বিয়ানীবাজারে। ১৯৭১ সালের ২০ জানুয়ারি।

আমি এই প্রবন্ধ শেষ করছি তাঁর কবিতার লাইন দিয়ে। ‘মায়া তো মায়াই, যত দূরে যায় তত তার দীর্ঘ হয় ছায়া।’ আজ লন্ডনের জীবনযাপনের ফাঁকে এমনি কোনো মায়ায়ই এত কিছু লেখালেখি।

লেখক: কথাশিল্পী

 

/এসএএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পর্দা থেকে দিল্লির রাস্তায় তাপসী পান্নু!
পর্দা থেকে দিল্লির রাস্তায় তাপসী পান্নু!
সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ৬ শতাধিক ফাঁদ উদ্ধার, শিকারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ৬ শতাধিক ফাঁদ উদ্ধার, শিকারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
নারী আসন বাড়ানো নিয়ে চাপাচাপি করছে সংস্কার কমিশন: ইসলামী আন্দোলন 
নারী আসন বাড়ানো নিয়ে চাপাচাপি করছে সংস্কার কমিশন: ইসলামী আন্দোলন 
দায়িত্ব নেওয়ার ৪ দিন পরই ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
দায়িত্ব নেওয়ার ৪ দিন পরই ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
সর্বাধিক পঠিত
শপথের সুযোগ নেই, পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করি: আসিফ মাহমুদ
শপথের সুযোগ নেই, পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করি: আসিফ মাহমুদ
তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি ইসরায়েলের
তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি ইসরায়েলের
ম্যাক্রোঁকে আক্রমণ ট্রাম্পের, বললেন যুদ্ধবিরতি নয়, বড় কিছু ঘটছে
ম্যাক্রোঁকে আক্রমণ ট্রাম্পের, বললেন যুদ্ধবিরতি নয়, বড় কিছু ঘটছে
জয়ের পথে ইসরায়েল: নেতানিয়াহু
জয়ের পথে ইসরায়েল: নেতানিয়াহু
রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করবে কবে
রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করবে কবে