X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই নিয়ে গল্প

আসাদ চৌধুরী
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:৩৬আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:৪৩

আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই নিয়ে গল্প শুধু লোক লোকান্তরই নয়, আল মাহমুদকে নিয়ে আরও গল্প করতে হবে, বুঝতে পারছি।

তখনও তাঁকে চোখে দেখিনি—শুধু তাঁর কবিতার প্রেমে পড়েছি। কিন্তু আক্ষেপ ঘুচলো ১৯৬২’র দিকে রফিক আজাদের কল্যাণে। নতুন প্রেরণাদাতা সায়ীদ ভাই তো ছিলেন। রফিক আজাদ প্রথম থেকেই ভেতরে ভেতরে দারুণ সংগঠক। প্রথমে বেরুলো বক্তব্য, সায়ীদ ভাইয়ের (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) পৃষ্ঠপোষকতায়, পরে ‘সাক্ষর’। প্রশান্ত ঘোষাল, ইমরুল চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, রণজিৎ পাল চৌধুরী—খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। পালের গোদার দায়িত্ব পালন করেছিলেন রফিক আজাদই—সে আরেক বৃত্তান্ত। প্রশান্ত ঘোষাল তিনজন কবিকে আমাদের আদর্শস্থানীয় বলে ঘোষণা করলেন সাক্ষর-এর এক লেখায়। আর এই কবিত্রয় হলেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ আর শহীদ কাদরী। আল মাহমুদের কোনো বই তখনো বেরোয়নি। প্রশান্ত একটি লেখায় প্রমাণ করলেন তিনি কতো বড় সমালোচক। এবারও রফিক আজাদের তৎপরতা। টাঙ্গালের আরেক কৃতীপুরুষ ছাপাখানার ব্যাপারে সত্যি তালেবর ব্যক্তি ছিলেন মুহম্মদ আখতার। তারই নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন একত্রিত হলাম—শিল্পী হাশেম খান, শাহজাহান সাহেব, আমার সহপাঠী হেলাল, কথাশিল্পী শহীদুর রহমান, ইত্তেফাকের সাংবাদিক শাহাবুদ্দীন সাহেব আরও কয়েকজন মিলে (মাসে দশ টাকা করে দিয়ে) একটি তহবিল গঠন করে আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই লোক লোকান্তর বের করা হলো। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল কপোতাক্ষলোক লোকান্তর কাইয়ুম চৌধুরীর দক্ষিণ হাতের পরশে চমৎকার একরঙা প্রচ্ছদে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে বেরুলো। প্রায় রাতারাতি আল মাহমুদ তরুণদের কাছে দারুণ প্রিয় হয়ে উঠলেন। মুহম্মদ আখতারের উস্কানির ফলে সিদ্ধান্ত হলো, বইটির প্রকাশনা উৎসব করতে হবে। পেছনে নাটের গুরু রফিক আজাদ তো ছিলেনই—আমার দায়িত্ব ছিল অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ বা ধন্যবাদ জাতীয় কিছু দেবার। কিন্তু মুশকিলটা বেধে গেল অন্য জায়গায়।

যে প্রেসে বইটি ছাপা হয়েছিল, শ’দুয়েক টাকা না পেলে তারা কিছুতেই বইয়ের একটি কপিও দেবে না। খবরটা পেলাম দুপুরের দিকে। এদিকে সব আয়োজন সম্পন্ন। বাংলা একাডেমির মূল ভবনের তিনতলায় একটি মিলনায়তন ছিল, অনুষ্ঠানের সভাপতি সৈয়দ আলী আহসান, প্রধান অতিথি ইত্তেফাকের তারকা সাংবাদিক সিরাজ ভাই (সিরাজুদ্দীন হোসেন), সায়ীদ ভাইও কিছু বলতে রাজি হয়েছেন। অথচ বই কোথায়?

উদ্যোক্তাদের আরও ভয় ছিল, অনুষ্ঠান শেষে অভ্যাগতদের যে চা-টা দেওয়া হবে, সেই খরচটাই বা কে দেবেন? না, আল মাহমুদের পরিবারটি খানদানি হলে কী হবে, সে সময় আর্থিক অবস্থাটাও সে রকম ছিলো না। আর আমাদের মধ্যে যারা উদ্যোগী তাদের পকেটের অবস্থাটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।

হটাৎ করে মনে পড়ে গেল মধুদার কথা। মধুর ক্যান্টিনের মধুদা, শ্রী মধুসূদন দে। মাস কয়েক আগে পূজার সময় তিনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলেন, এই সুযোগটা এখন নেওয়া যায়।

মধুদা বাকিতে সিঙ্গাড়া, সন্দেশ আর চা দিতে রাজি হলেন। কিন্তু নগদ অতোগুলো টাকা? ক্যান্টিনের ক্যাশে তখন শ’খানেক টাকাও জমা পড়েনি। বললেন, ঘণ্টা দুয়েক পরে দেবেন।

দুই ঘণ্টা পার করে দেওয়ার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলেও মনে হচ্ছিল, বেশ দীর্ঘ সময়। জানি না, কার হাত দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, অনুষ্ঠানের সামান্য আগে কিছু কপি ঠিকই চলে আসে। যাকে বলে হাতে চাঁদ।

সে সময় আল মাহমুদ পাজামার ওপর একটা প্রিন্স কোট চাপাতেন, ছিপছিপা শরীর, গলার বোতামটাও আটকাতেন। আমার ছোট বোন মাহেরু রোকেয়া হলের মাতবর মার্কা ছাত্রী। ওকে বলে দিয়েছিলাম আসার জন্য। সে দলবল নিয়েই এসেছিল। আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফুলহাতা টি-শার্ট দিয়েছিলেন আমার এক মার্কিন ছাত্র—সেটা গায়ে চাপিয়ে আমিও সাধ্যমতো স্মার্ট হয়ে হাজির হলাম। ওই পুরো অনুষ্ঠানের সংবাদটি ফটো সমেত ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল।

এরপর তো আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগদান করি সে বছরেরই শেষ মাসে, ডিসেম্বরে। লোক লোকান্তর আমি আক্ষরিক অর্থে হাতে করে বিক্রি করেছি—উপহারও দিয়েছি। একটি কবিতা আল মাহমুদ ডাক্তার চণ্ডীপদ চক্রবর্তীকে (আমার চণ্ডীদাকে) উৎসর্গ করেছিলেন। আল মাহমুদ যখন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন, আমি চণ্ডীদাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে হৈহৈ করে উঠলেন, ‘করেন। নিশ্চয়ই করা হবে।’

অর্থাৎ সংবর্ধনা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন আল মাহমুদের মামা, একই বাড়ির আজিজুর রহমান মোল্লা এম এন এ টিকিউএ। আর মহাকুমার (এখন জেলা) এসডিও ছিলেন আবুল হাসনাত মোফাজ্জল করিম—কবি মোফাজ্জল করিম।

তিতাস সাহিত্য পরিষদ (এ সম্পর্কে মুহম্মদ মুসার একটি ধারাবাহিক লেখা বেরিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি সাপ্তাহিকে) গঠিত হওয়ার সময় মোল্লা সাহেব দু’শ টাকা দিয়েছিলেন, সে সময় অনেক টাকা। আমি তিতাস সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, আর চণ্ডীদা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জামিলা খালার বাসার সামনে ফুলবাগিচা ছিল, এখন নেই, সেখানে বৈশাখের এক অপরাহ্ণে তিতাস সাহিত্য পরিষদ গঠিত হয়। আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ায় তরুণ কবিদের চঞ্চলতা এবং আনন্দকে মূল্য দিতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। প্রথমত টাকা কোথায়। ডাক্তার ফরিদুল হুদা (ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, পরে জিয়াউর রহমান সাহেবের মন্ত্রিসভার সদস্য, মওলানা ভাসানীর অন্ধভক্ত), প্রফেসর  আবদুল মোমেন, অধ্যাপক বজেন্দ্র কুমার দাস, অধ্যাপক একে লুৎফর রহমান (জাহাঙ্গীর) সবাই ভরসা দিলেন, না, অনুষ্ঠান হতেই হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্লাবের উৎসাহী সদস্য আমি। আমার অনুরোধে সেদিনের জন্য কার্ড রুম থেকে সরিয়ে ফেলা হলো। স্টেজটাকে সুন্দর করে সাজালেন সাহিত্য পরিষদের কর্মীরা। ঘাপলা এবারও। বিশিষ্ট সৈনিক (ও পরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক) অ্যাডভোকেট আলী আজম পিতৃবন্ধু। তিনি ডেকে বললেন, ‘মোল্লা সাহেব সভাপতিত্ব করলে ছেলেরা গন্ডগোল করবে। আপনি তাড়াতাড়ি অন্য ব্যবস্থা করুন। আল মাহমুদকে আমরা প্রথম সংবর্ধনা দিচ্ছি, কোনো রকমের উচ্ছৃঙ্খলতা ঘটুক আমরা চাই না। আমার মাথায় বাজ পড়লো যেন। করিম ভাই (আবুল হাসনাত মোফাজ্জল করিম) ঢাকা হলের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ইংরেজি বিভাগের স্মার্ট ছাত্র—তখনো জানতাম না তিনি কবিতে লেখেন। সমস্যার কথা বলতেই বললেন, ‘ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।’

বলা ভালো, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তখন দানা বাঁধছে, ছয় দফাকে ঘিরে দেশ একটি গনুঅভ্যুত্থানের দিকে এগোচ্ছে।

মোল্লা সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘এসডিও সাহেবকে দিয়েই অনুষ্ঠানটা চালিয়ে দেন। এতে আমাদের পরিবারের সম্মান আরও বাড়বে।’ আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি, অত্যন্ত অমায়িক এই মানুষটি, আমাকে অভিভূত করে দিলেন। তারই ছেলে হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান।

মুহাম্মদ মুসা, সে সময় মাত্র শিক্ষকতায় ঢুকেছেন, নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলে, তিতাস সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক, খুবই চাপের মধ্যে ছিলেন।

হটাৎ কারেন্ট চলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়—হ্যাজাকের ব্যবস্থা ছিল বলে বোধহয় চণ্ডীদার বাসা থেকে তালপাখা আনিয়েছিলেন, সভাপতি মোফাজ্জল করিম (প্রখ্যাত কবি, কলামিস্ট, বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) পাখার বাতাস খাচ্ছেন। শরীফ, আল মাহমুদের বড় ছেলে, বাবার কোলে ঘুমুচ্ছে, আল মাহমুদ ছেলেকে বাতাস করছেন—এই ফটোটা আমার বন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্ব প্রাণতোষ চৌধুরী কেন তুলেছিলেন তিনিই জানেন, আর এই ছবিটিই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন—সাদা-কালো আলোকচিত্র।  

অনেক কথা জমে আছে আল মাহমুদকে ঘিরে। ঢাকায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, দুই দফা চট্টগ্রামে, একাত্তরের কলকাতায়, গনকণ্ঠ’র সেই উত্তাল সময়ে, শিল্পকলা একাডেমিতে...নিউইয়র্কে, বাংলা একাডেমির ছোট্ট কক্ষে সোনালী কাবিনের যুগ, মায়াবী পর্দার যুগ, বিরামপুরের যুগ—সময় কতো দ্রুত ফুরোয়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ