X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবীর শেষ ব্যক্তিগত স্মৃতি

অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯ জুন ২০২২, ১৭:০১আপডেট : ১৯ জুন ২০২২, ১৭:০১

উপক্রমণিকা
আমার ফুসফুসকে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এখনও তাকে ভালো করে চিনি না। আমার লিভার এবং কিডনী সম্পর্কেও একই কথা। আমার ডান হাতটিকে আমি কতটা ভালোবাসি কিংবা বাঁ পায়ের অনামিকাটিকে, স্বাভাবিক দৈনন্দিন অবস্থায় এ ঠিক বোধগম্য নয়। এমন কিছু দীর্ঘ-লালিত ব্যক্তি-অভ্যেস আমি আমার সঙ্গে নিয়ে চলেছি যেগুলো সঙ্গে না রাখলে আমি অনেক সাধারণ চিন্তা-ভাবনাই করতে পারতাম না। অথচ, নিজের জন্মমুহূর্তের কথা ভাবলে মনে হয়, অন্ধকারে, একটা মিছিলের ভেতর জন্মেছিলাম, আমি। সন্ধের পর মিছিল শুরু হতেই লোডশেডিং হয়ে যায়। গরমে হাঁসফাঁস করা পুং স্ত্রী শিশু হাতপাখা সান্নিধ্যে বাইরে, রোয়াকে এসে দাঁড়ায়। তখনই অন্ধকারের ভেতর ফুঁড়ে মিছিলটা আসে। এবং অন্ধকার বাজিয়ে চলে যায়। সেই অন্ধকারের ভেতর জন্মাই, আমি। আমার অস্তিত্বের ভেতর বিরাট এক শূন্যতার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে এক কৃমি। ‘আমি’ এই শূন্যতার উৎস নয়, শূন্যতাই আমার সবরকম অস্তিত্বের এবং অস্তিত্বগুলির মধ্যে সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের ভিত্তি। সার্ত্র-এর ‘লা নোজে’ উপন্যাসের আঁতোয়ান রকাঁত্যাঁ-র মতো আমার আমির পেছনে লাগাতার লাথি মারছি আমিই। আমার নির্বাচনের বাধ্যতা আর স্বাধীনতাবোধ হল সেই পা যা আমির পেছনে বীভৎস উপগ্রহ চিত্রের মতো লাথি হয়ে উঠেছে

উপক্রমণীয়
পৃথিবীর জল হাওয়ায় জন্ম নেওয়ার আগেই তো আমাদের অন্তর্গত অধিভূত ও অধিদৈবতের জন্ম হয়ে গেছে। নয় কি? যখন ভ্রূণ হয়ে আছি—মস্তিষ্ক জন্মাচ্ছে না তখন? প্রাণিমাত্রকেই অধিকার করে থাকে যা—সেই মৌল রাশি ও পদার্থগুলি কি তখনই সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে না? ঠিক যে মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক কাজ শুরু করল, ঠিক যে-মুহূর্তটা, তক্ষুনি কি আমাদের জন্ম হল না? নাকি ঠিক যখন আমার মস্তিষ্ক ভাবতে শুরু করল? নাকি যেদিন মায়ের যোনি থেকে বা পেট কেটে আমার এই শরীরটা বের করে আনা হল, সেদিন? অথবা, যেদিন থেকে আমার স্মৃতি স্মরণযোগ্য হতে শুরু করল? যেদিন আমি প্রথম কিছু মনে রাখলাম? কোনটা আমার জন্মমুহূর্ত? নাকি শ্বাস নিলাম যখন, প্রথম? কিংবা যখন জাইগোট তৈরি হচ্ছে? নাকি এর কোনওটাই নয়, যখন গোনাড অঞ্চলে মুলেরিয়ান বা উলফিয়ান ডাক্‌ট থিতু হচ্ছে? আমি কোনখান থেকে শুরু করেছিলাম? আমি দৌড় শেষ করতে চলেছি, কতখানি দৌড়লাম তার কোনও রেকর্ড থাকবে না, কোথাও?

উপক্রমমাণ
শৈশবকাল, নদে জেলার গ্রাম, একচিলতে। মাঘী শীতের ভোরে, মা ডেকে তুললেন আমায়। আলো তো তখনও ফোটেনি। আমি ঘুমের সাথে আমার জাগরণের একটা মোটামুটি বন্ধুত্ব বা আপোস করিয়ে দিতে দিতে চোখ পিটপিট করছি আর কখন নিজেই এসে পড়েছি ঘরের বাইরে, উঠোনে। হ্যাঁ, খালি পায়ে। এবং পায়ের পাতা ও শরীরের প্রত্যেকটি আচ্ছাদিত ও উন্মুক্ত রোমকূপ দিয়ে প্রবেশরত শৈত্য আমাকে জানায় যে, সে আমারই অপেক্ষায় ছিল। তখনই, মা আমার হাতে ধরিয়ে দেন মাটির একটি মালসা, যাতে ধূসর বর্ণের টলটলে এক তরল। আমি দু হাতের করতলে তা ধরি। মুখের কাছে নিয়ে আসি। আমার ঘাড় থেকে মাথাও তখন আনুমানিক পঁচাশি ডিগ্রি কোণে মালসার দিকে হেলেছে। চোখ ও তার দৃষ্টি আনুভূমিক থেকে সরে পুরোটা উল্লম্ব না হলেও কিছুটা তেরছা এসে পড়েইছে মালসার দিকে। তখনই অন্ধকার আরও একটু আবছা হল। বস্তুত ভোরের সময় যেরকমটা হয়। প্রতি মুহূর্তেই একটা একটা করে অন্ধকারের টোন সরে যেতে থাকে এবং আলোর একটা করে পোঁচ পড়তে থাকে চারপাশের গায়ে। তখন, দু হাত দিয়ে মাটির মালসাটিকে মুখের কাছে এনে আমি দেখতে পাই, আরও স্পষ্ট এবং অব্যর্থভাবে বললে বলা উচিত আমি দেখে ফেলি, মালসায়, ওই ধূসর বর্ণীয় তরলে, একটি মুখের আভা। ওই একই সময়ে আমার দু ঠোঁট তখন ফাঁক হয়েছে এবং তার মাঝখানে মালসার একটি কাঁধ অবস্থান নিয়েছে, আমার জিভ ও মুখে এসে পড়েছে সেই তরলের প্রথমাংশ, উত্তর প্রথমাংশ, প্রাক্‌ দ্বিতীয়াংশ, এইভাবে ক্রমে আরও। যুগপৎ একইসাথে মালসায় ওই ধূসর বর্ণীয় তরলে ততক্ষণে আমি দেখে ফেলেছি এবং দেখছি একটি মুখের আভা। অবধারিতভাবে সে মুখ আমার শৈশব। মালসায়, প্রকৃত পানীয়? কিন্তু এখানে প্রধান এবং তীক্ষ্ণতম বিন্দুটি হল, ওই মুখ, তার আভা। সমস্যা হল, বিন্দু বিন্দু শীতের সামগ্রিকতা এবং আমার জিভ ও মুখে আসা রস, যা আমার অন্তঃস্থ প্রতিটি নালিপথকে সেই মুহূর্তে আদিম ও বনজ করে তুলেছিল; ঠিক এরকম ভোর মুহূর্তে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এবং অবশ্যই একটি মাঠ বা চর পেরিয়ে নদীতীরে দাঁড়ানো হরিণ যেভাবে মুখ নিচু করে জলে জিভ দেয়, চাটে; একইসময়ে জলে সে দেখতে পায় নিজেরই মুখ, যার ফলে শৈশবের ওই ঘটনাটিকে আমার জীবনের একটি আদিম বন্যমুহূর্তের স্মৃতি বলেই মনে হয়; আমি স্পষ্টই দেখতে পাই, রসপানরত ওই মুহূর্তে আমার দু কানের পাতা কিরকম সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়ায় এবং একটু চুমুক দিয়ে আমি পুনরায় মুখ তুলে সামনেটা ও চারপাশ দেখি, আবার তরলে ঠোঁট দিই, ঠাণ্ডায় রোমকূপগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে হরিণের চামড়ার মতোই বুটিবুটি দানাদার হয়ে উঠেছে, আমার চামড়াও শীতে অল্প চিরিক চিরিক। সেই বন্যতা আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে যদি তখন আমার পা দুটো দেখা যেত। পায়ের আঙুলগুলো মাটিতে রেখে, পাতার মাঝখান থেকে গোড়ালি অবধি আমি তখন উঁচু করে রেখেছি এবং মাঝে মাঝে খুব ধীরে অল্প ঘসঘস করে পায়ের পাতা ঘষছি। লেজ সোজা করে গুলবাঘ যেভাবে লাফানোর আগে পেছনের পা দুটো ঘষে। শীতের হিম পড়ে থাকা সারারাতের সক্ষম এবং উপযুক্ত ভেজা উঠোন আমার পায়ের আঙুলের ছাপ নিশ্চয়ই খুব পেশাদারি দক্ষতায় নিয়ে রেখেছিল সেদিন। প্রকৃতপ্রস্তাবে আমি তখন সেই মানবজন্তু যে-তার উৎস মুহূর্তেই এমন কিছু দীপ্তি ও অভিলাস টের পেয়েছিল যা আদিম এবং বন্য।

উপক্রান্ত
এতটা লেখার পর যদি বলি, আমি দেখতে পাচ্ছি বাড়ির উঠোনে মাটির মালসা হাতে রসপানরত সেই শিশু অথবা নদীতীরে ভোরের জলপানরত হরিণ, কেউই নেই। যা রয়েছে, তা আমি। এই গোটা আমি; মূর্ত-জগৎস্থিত মূর্ত-আত্মসচেতন আমির স্ব-হেতু-সত্তা। এই অনুচ্ছেদের ঠিক শেষ লাইনের পরে ডান দিকের কোণে সে জানু পেতে বসেছে। দু হাত কৃতাঞ্জলির মতো জড়ো হয়ে মুখের কাছে আনা, যেন চরণামৃত পান করছে, এইভাবে। আর, শব্দ আর লাইনের ফাঁকে শাদা অঞ্চল দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে সেই রস। যেভাবে বহুধারায় ভেঙে ঝরনা প্রস্রবিত হয় পাহাড়ের পিঠে, তাহলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্রের হার্ড কপি জমা বাধ্যতামূলক নয়
উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্রের হার্ড কপি জমা বাধ্যতামূলক নয়
খাবার না খাওয়ায় বাবার ‘চড়’, মাথায় আঘাত পেয়ে শিশুর মৃত্যু
খাবার না খাওয়ায় বাবার ‘চড়’, মাথায় আঘাত পেয়ে শিশুর মৃত্যু
স্বার্থে আঘাত করলে কঠোর জবাব দেবে ইরান: রাইসি
স্বার্থে আঘাত করলে কঠোর জবাব দেবে ইরান: রাইসি
নিত্যপণ্য আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
নিত্যপণ্য আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’