X
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২
জন্মশতবর্ষে

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুনর্পাঠ

মোস্তফা তারিকুল আহসান
১৪ আগস্ট ২০২২, ১৫:৩০আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২২, ১৫:৩০

[আগামীকাল ১৫ আগস্ট সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯২২–মৃত্যু ১০ অক্টোবর ১৯৭১)-এর জন্মশতবর্ষ। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস : লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, কদর্য এশীয়, ফাল্গুন। ছোটগল্পগ্রন্থ : নয়নচারা, জাহাজী, পরাজয়,মৃত্যু-যাত্রা, খুনী, রক্ত, খণ্ড চাঁদের বক্রতায়, সেই পৃথিবী, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প, দুই তীর, একটি তুলসী গাছের কাহিনী, পাগড়ী, কেরায়া, নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা, গ্রীষ্মের ছুটি, মালেকা, স্তন, মতিন উদ্দিনের প্রেম ইত্যাদি। নাটক : বহিপীর ,উজানে মৃত্যু, সুড়ঙ্গ, তরঙ্গভঙ্গ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই অন্যতম কথাশিল্পীকে স্মরণ করে প্রকাশ করা হলো এই প্রবন্ধটি।]

বাংলা উপন্যাস নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি; বেশিরভাগ ঔপন্যাসিক প্রচলিত ধারার উপন্যাসের আঙ্গিক গল্প এবং ধারাক্রম নিয়েই নতুন করে উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) থেকে ধরলেও আজ অবধি উপন্যাস সাহিত্য যে সময়ের ইতিহাস অতিক্রম করেছে তা নিতান্ত স্বল্পকালীন নয়, তবু এই ধারা সময়ের বিভিন্ন স্তরে নানান কুশলি কথাকোবিদ দ্বারা অসামান্য সৃষ্টিকর্মের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এমন আশা করা দুরূহ, কখনো কখনো নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। সমাজ, ইতিহাস, ধর্ম, প্রেম ইত্যকার সব অনুষঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মূলত আমাদের উপন্যাসের ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল; কথকতার বর্ণিল ক্যানভাসে রোমান্টিক প্রেমের উদ্বেল প্রবাহ কেউ কেউ উপন্যাসের দেহে প্রবাহিত করেছিলেন।

জাত্যাভিমান, স্বজাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-জাতীয়তার সাথে জীবনের রোমান্টিক আবহকে অন্বিষ্ট করে রাসায়নিক উৎপাদন হিসেবে উপন্যাসকে হাজির করেছিলেন প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯৯৪)। সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের রোমান্টিক দিকগুলোর উপস্থাপনই ছিল তাঁর প্রধান অনুষঙ্গ। তার পরের ইতিহাস, সে অনেকটা পূর্বতন ধারাকে নতুন মোড়কের মধ্যদিয়ে অভিযোজন। রবীন্দ্রনাথ কতিপয় সার্থক উপন্যাস লিখলেন; সমাজ ও ব্যক্তিক সমস্যা, কখনো-বা জাতীয়তাবাদী চেতনাকে (গোরা) সংযুক্ত করলেন উপন্যাসে। অবশ্য মানুষের অন্তর্গত বেদনা, সুখানুভূতি ও হার্দিক ক্রিয়াকলাপের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তার কোনো কোনো উপন্যাসে লক্ষণীয়।

শরৎচন্দ্র এলেন মানবীয় গুণ বা দোষের প্রবণতায় আবৃত করে প্রচুর সংখ্যক উপন্যাস নিয়ে। মানবীয় আবেগ প্রেম বিশেষ করে নারী চরিত্রের একটা মায়াবী গাঠনিক ভঙ্গি তিনি উপহার দিলেন। পাশাপাশি সামাজিক সমস্যা পুরাতন অনুক্রম হিসেবে দ্রবীভূত অবস্থায় উপন্যাসের শরীরে যুক্ত হয়ে রইল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে বিশ্লেষণধর্মিতা আছে যা রবীন্দ্রনাথ কিয়ৎপরিমাণে বঙ্কিমচন্দ্রেও ছিল তবে সে বিশ্লেষণ তদর্থে মনোবিশ্লেষণ বা মনোসমীক্ষণ নয়—ঘটনার বা উদ্দিষ্ট চরিত্রের ক্রিয়াকলাপের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা। মানুষের হার্দিক রাজ্যে অনূভূতির গাঢ় সঞ্চারণে শরৎচন্দ্রের জুড়ি নেই ঠিক সেকারণেই তিনি আজ পর্যন্ত সমান জনপ্রিয়। তিন বন্দ্যোপাধ্যায় (তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ) তিনটি স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তনা দেখালেন সত্য, কথাসাহিত্যের অঙ্গনে যোগ করলেন বিশাল অধ্যায়, তবু মনে করি যে তারাশঙ্কর ও মানিক সম্পর্কে কথা থেকে যায়। বিভূতিভূষণ প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন, প্রাত্যহিকতা, সামাজিক অনুঘটনাকে একাত্ম করলেন। তাঁর নিস্পৃহ অচৈতন্য প্রকৃতি প্রেমের একটা অভিনবত্ব থাকলেও তা সব শ্রেণির পাঠককে একইভাবে আকৃষ্ট করেছে এমন বলা যায় না। তাঁর দু-একটি উপন্যাস (অশনি সংকেত) সামাজিক চিত্রের উৎকৃষ্ট শৈল্পিক উপস্থাপনা হয়েছে নিঃসন্দেহে। মানিকের এক্সপেরিমেন্ট ছিল মূল জীবনজটিলতা নিয়ে—তিনি জীবনকে সিগমন্ড ফ্রয়েড (১৮৬৫-১৯৩৯)-এর যৌনতত্ত্ব ও কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) এর বস্তুবাদ তত্ত্বের আলোকে নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং এর সঙ্গে মানবিক প্রেমও যুক্ত করেছেন। তবে লক্ষ করার যে তাঁর গোটাকতক উপন্যাসে (পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য) এই অভীক্ষা সফলতার শিখা স্পর্শ করেছে। অন্যত্র বেশকিছু রচনায় তত্ত্বকে দাঁড় করার মতো উপন্যাসোচিত পটভূমির সাক্ষাৎ আমরা পাই না। তারাশঙ্করের উপন্যাসে একটা বিশেষ অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপন প্রিমিটিভ জীবনযাত্রার সঙ্গে নতুন জীবনের অভিক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়ের আলোকে ঘটনাবর্ত নির্মাণ লক্ষ করা যায়। জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধ যে কখনো উন্মোচিত হয়নি তা নয়; বেশ কিছু উপন্যাস (বিচারক, কবি, সপ্তপদী) জীবনের টানাপড়েন, মানবিক সমস্যা, নৈয়ায়িক বিশ্বাসের সাথে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ঘাত প্রতিঘাতও সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে। একজন মহৎ শিল্পী (এখানে ঔপন্যাসিক) আত্মসচেতন, আত্মসচেতন বলেই পারিপার্শ্বিক জীবনযাত্রা, ঘটনাক্রম সবকিছু সম্পর্কে তিনি সচেতন। শুধু সচেতন বললে উপযুক্ত বলা হয় না, সাহিত্যের এই আধুনিক ও জটিল মাধ্যমকে সঠিক গঠনে নির্মাণ করতে তাকে আরো অগ্রসর হতে হয়। শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী তাই সর্বত্রগামী, চলমান ঘটনাস্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণ, চরিত্রের মানসিক প্রাবল্য এবং অভাবিত অগ্রসরতা, নিম্নগামিতা এবং আত্মিক সংকটও তাকে ধারণ করতে হয়। ‘চোখের বালি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : সাহিত্যের নব পর্যায়ের পদ্ধতি ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাঁদের আঁতের কথা বের করে দেখানো। যদিও আমরা জানি, বঙ্কিম এমনকি রবীন্দ্রনাথও ঘটনা ছাড়া উপন্যাসের অবয়বকে দীর্ঘ করতে পারতেন না। প্রকৃতপক্ষে, ইটালীয় সাহিত্যকর্মের পরিবর্তিত পরিবর্ধিত পরীক্ষিত রূপ হিসেবে যে উপন্যাস সাহিত্যের সৃষ্টি আমাদের উপন্যাসে তার মৌল বৈশিষ্ট্য খুব বেশি নেই। তাই আন্তর্জাতিক সাহিত্যের কাছে আমাদের উপন্যাস অনেক সময় হালকা মনে হয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) যখন উপন্যাস নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হলেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর উপন্যাসের মৌলিক কাঠামো-বিন্যাস নিয়ে। ইতোমধ্যে উপরোক্ত ধারাক্রম শেষ হয়েছে, যদিও বাঙালি পাঠক সেই সব অনুষঙ্গের সাথে যুক্ত হয়ে আছেন। সত্যিকার অর্থে ওয়ালীউল্লাহ বাংলা উপন্যাস নিয়ে সফল এক এক্সপেরিমেন্ট করলেন। দীর্ঘদিন অন্ধ কুসংস্কার সংকীর্ণ ধর্মীয় বাতাবরণে আবিষ্ট মুসলমান জাতিকে সমূলে জাগিয়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন; সাদামাটা পাঠক হয়তো তাঁর উচু স্তরের এই অভিনব শিল্প প্রকরণ বুঝতে বেগ পেয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবে; চিরকালীন অন্ধবিশ্বাসের কষায় কীভাবে নিজেরা নিস্পেষিত সেটাও তারা জানত না। তিনিই প্রথম প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার আলোকে জাগিয়ে তুললেন আপন জাতিকে, যে কৌশল, যে ধ্রুপদী আঙ্গিক তিনি উপন্যাসে প্রয়োগ করলেন তা অভিনব, সার্থক। অনেকে অজ্ঞতার কারণে তাঁর উপন্যাস শুধু মুসলমানদের গালি দেবার রসদ হিসেবে ভাবলেন।

একজন আধুনিক জীবনশিল্পী হিসেবে ওয়ালীউল্লাহকে আলাদা করে চেনা যাবে। প্রচলিত ধারার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে; উপস্থাপনরীতিতে তাঁর উপন্যাস স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্মে উন্নীত হয়েছে। নিঃস্পৃহতা, আধুনিকতা, যুক্তিপরম্পরা, অত্যাধুনিক প্রায়োগিক কৌশল, নিজস্ব নৈয়ায়িক বোধ, পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য, প্রতিটি চরিত্রকে সাইকোলজিক্যাল আউটলুক থেকে নির্মোহভাবে অবলোকন, কাহিনির প্রতি পক্ষপাতহীন দৃষ্টি, নির্দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিতে প্রতিটি ঘটনাকে উপস্থাপন সর্বোপরি মনোবিশ্লেষণের অপূর্ব তীক্ষ্নতা তাঁর উপন্যাসকে আলাদা মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছে। কাহিনি এখানে মুখ্য কোনো এলিমেন্ট নয় বরং চরিত্রের আত্মজিজ্ঞাসা, সমাজ ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মনোপ্রতিন্যাস, নির্ব্যাজ স্বীকারোক্তি কিংবা দায়বদ্ধতা কখনো অর্থনৈতিক তত্ত্বের প্রামাণিক নিবন্ধের মতো ঘটনার ধারাক্রম অনুক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা পরিমাপ করে ঔপন্যাসিক তাঁর সন্দিগ্ধ নিবিড় এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। ধর্মের অপ্রভ্রংশ রূপটাই সামন্তশ্রেণি প্রধান অবলম্বন করে শোষিত অশিক্ষিত মানুষদের পণ্য করে রেখেছে, সামাজিক ধর্মীয় অনুশাসনের যাতাকলে নিষ্পেষিত এই সব চরিত্র তাই গভীর নির্বেদে ডুবে থাকে অহরহ, কখনো কাঁদে নদীর মতো।

প্রচলিত অর্থে ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের বিষয় আশয় মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে; জরা, মৃত্যু, ক্লান্তি, অসহায়ত্ব এবং সর্বোপরি নিজস্ব আত্মিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষ। তবু দুর্বল এ সব চরিত্রে জীবনের কোনো এক উষালগ্ন সূর্যের কিরণ ঝলমল করে ওঠে। সফলতাই সেখানে বড় পাওনা নয়, আত্মিক সাপোর্ট, এতটুকুন বিশ্বাস, সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকাই সেখানে বড় পাওনা।

লাল সালু (১৯৪৮) উপন্যাসের ঘটনাবর্তের প্রধান উপাদান ধর্ম; এই হাতিয়ার কাঁধে নিয়ে ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে নায়ক চরিত্র মজিদ। মজিদ মূলত ঔপনিবেশিক চরিত্র। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ যেমন বাণিজ্য ও ভূখণ্ডের জন্য বিভিন্ন দেশ দখল করেছিল, তেমনি মজিদ শস্যহীন তার মাতৃভূমি ছেড়ে নিরাক পড়া এক দুপুরে মহব্বতনগরে প্রবেশ করে, একটা পুঁটলি হাতে মুখে শীর্ণ ক গাছি দাড়ি আর পেটে মুখস্থ কিছু শরিয়তি বাক্য। সৈন্যসামন্ত নেই, অস্ত্র নেই অথচ সে কুশলি সৈনিক। এ রকম মাঝবয়সী শীর্ণ, দাড়িবিশিষ্ট কৃশ ব্যক্তিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে আগে কখনো আমরা পাইনি। প্যারীচাঁদের ঠকচাচা অবশ্য এর সগোত্রীয় ছিল। ঠকচাচার কাজ ছিল মানুষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা প্রতারণার মাধ্যমে। ধর্ম সেখানে একমাত্র অবলম্বন নয়। মজিদের মতো দাপটও তার ছিল না। মজিদ গ্রামে ঢুকেই আলোড়ন তোলে, মূর্খ অশিক্ষিত অধার্মিক গ্রামবাসীদের গালি দেয়। আরব দেশ থেকে আগত পির মুর্শিদ মারফৎ পাওয়া ধর্মে আমাদের দেশের অশিক্ষিত শ্রেণি দীক্ষা লাভ করলেও ধর্মের প্রকৃত রেশম রেওয়াজ থেকে তারা অনেক দূরে ছিল। নামাজ পড়া, কেতাব পড়া, দাড়ি রাখা, পিরের মাজারে সিন্নি পাঠানো, ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করা এ সবই তাদের কাছে ধর্ম। সুতরাং, মজিদের গালি শুনে যতসব বে এলেম আনপাড়হ তারা হতচকিত হয়ে যায়। মজিদকে ঈশ্বর প্রেরিত কোনো পির পয়গম্বরের মতো মনে করে। মজিদ অবশ্য তার স্বপ্নাশ্রিত মিথ্যে গল্পটিও গ্রামবাসীদের শোনায়। মজিদের মোক্ষম তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। সমস্ত গ্রামবাসী কয়েক মুহূর্তেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, শুরু হয় মজিদের একচ্ছত্র রাজ্য শাসন, সব বাধা উপড়ে ফেলে। পির মোদাচ্ছের নামে জনৈক কাল্পনিক ব্যক্তির মাজারকে সে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। সব শক্তি তার সেখান থেকে আসে। মাছের পিঠের মতো মাজার লালসালুতে আবৃত থাকে; ঢাকা পয়সা, জমিজমা, ঘরবাড়ি, স্ত্রী, প্রতিপত্তি, সবকিছুই পায় মজিদ। উপচেপড়া ফসলের গ্রামবাসীদের মনে ধর্মের রোশনাই (?) জ্বালায় মজিদ। জঠরের ক্ষুধা মেটার পর মজিদের যৌনক্ষুধার জোয়ার আসে, বিশাল বপু বিশিষ্ট রহিমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েও মজিদ নিবৃত্ত থাকতে পারে না; অর্ধেক রাত্রে কুপির আলোয় হাসুনির মার উজ্জ্বল কাঁধ দেখে তার চোখে লোভ চকচক করে, ব্যাপারীর স্ত্রীর শাদা পা দেখে শিউরে ওঠে, অবশেষে সন্তানের অজুহাতে বালিকা জমিলাকে বিয়ে করে। নিজের উপনিবেশকে একচ্ছত্র অধিকারে রাখতে আওয়ালপুরে অবস্থিত পিরকে অতি কৌশলে হেনস্থা করে, তার কাছে পানি পড়া খেতে চাইলে বড় বউ আমেনাকে তালাক দিতে ব্যাপারীকে বাধ্য করায়; ইংরেজি স্কুল দিতে চাইলে আক্কাজকে দাড়ি না রাখার অভিযোগে বোকা বানায়, অবাধ্যতার কারণে জমিলাকে ও শেষ করে ফেলে, তহুর বাপের পরিবারকে ধ্বংস করলে বুড়ো আত্মহত্যা করে এবং নিজের প্রতাপ জাহির করার জন্য বাপ বেটাকে একসাথে নিজেই খৎনা করায়।

একটু অভিনিবিষ্ট পাঠক বুঝতে পারবেন, মজিদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সুষ্ঠু প্ল্যানমাফিক, নিশ্ছিদ্র; কোথাও ভুল হবার আশঙ্কা নেই; ধর্মীয় দুর্বলতাকে পুঁজি করে তার অভিনব সামরিক বাণিজ্য মিশন সর্বতোভাবে সার্থক। আরো আশ্চর্যের বিষয়, মজিদ জেনে শুনেই এই মিথ্যে ব্যবসায় নেমেছে; নিজে জানে সেখানে কোনো পিরের মাজার নেই। মোদাচ্ছের শব্দের অর্থ যেমন অজানা, প্রকৃত অর্থে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। হয়তো তা কোনো ভাঙা দালানের ভগ্নাবশেষ অথবা উঁচু সাধারণ ভূখণ্ড। মজিদ জানে খোদার এলেমে বুক ভরে না তলার পেট শূন্য বলে। তাই গারো পাহাড় থেকে সে মহব্বতনগর গ্রামে এসে নতুন ব্যবসা শুরু করে। দুনিয়াতে সচ্ছলভাবে দুবেলা খেয়ে বাঁচবার জন্য যে খেলা খেলতে যাচ্ছে সে খেলা সাংঘাতিক; এই খেলায় নামার সময় মজিদ অনন্যপায় হয়ে এটা করে তাও জানে, ভাবে খোদার বান্দা সে নির্বোধ ও জীবনের জন্য অন্ধ, তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ করে দেবেন।

একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, গ্রামের সব মানুষ ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞ হলেও মজিদ অজ্ঞ নয়। ধর্মের আসল পরিচয় হয়তো সে জানে। কিন্তু নিজস্ব প্রয়োজনে ধর্মকে এভাবে সে ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি তার অসহায়ত্ব, দারিদ্র্য তাকে বাধ্য করেছে এই হীন পেশায় নিয়োজিত করতে। শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব অসহায় পরাজিত মজিদ আমাদের সহানুভূতিতে ধরা পড়ে, অতি সাধারণ বেদনাদীর্ণ মজিদ হিসেবে।

ধর্ম সমাজ ও ব্যক্তিকে একটা সমীকরণে দাঁড় করার অভিনব এই প্রচেষ্টায় ঔপন্যাসিক সার্থক বলা চলে। মজিদের এই অভিযানে কোনো রোমান্টিক আবহ নেই, এমনকি ঔপন্যাসিক স্বল্পবাক। মজিদের পূর্বের কোনো শৈশব, যৌবন, পিতা-মাতা, জন্মস্মৃতি ঘটনালেখাও তিনি আমাদের বলেননি, প্রকৃত ধর্মীয় আহকামকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, অবৈধ একটা নিয়ম-নীতির বেড়াজালে মুসলমান জাতিকে মোহগ্রস্ত করা যে কত সহজ তারই উজ্জ্বল চিত্ররূপ লালসালু। লালসালু কাপড়ের অন্তরালে মোদাচ্ছের পিরের লাশ ঢাকা পড়ে আছে কি না আমরা জানি না; এতটুকু জানি ঐ সালু কাপড়ে আমাদের সব বোধ বিশ্বাস ও দৃষ্টির প্রাখর্যও ঢাকা পড়ে আছে। চেতনার অন্তলীন প্রবাহে এই উপন্যাসের ইঙ্গিতময় নির্দেশ আমাদের চোখ খুলে দেয়। ভাষার সূক্ষ্ম ইঙ্গিতময়তার গভীরতায়, আলঙ্কারিক কুশলতায় এই উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন নতুন বোধে, নতুন আলোকে, নতুন প্রগতিশীল ধারায়।

একটা যুবতী মাঝির বউয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যুবক মাস্টার আরেফ আলীর মানসিক সংকটকে কেন্দ্র করে চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) উপন্যাসটির জটিল উপস্থাপনা যেভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তি তর্ক বোধ বিবেক ও দায়বদ্ধতার নিরিখে অগ্রসর হয়েছে সে হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এই উপন্যাস একটা নতুন মাত্রাগত সাফল্যে উন্নীত হয়েছে। জীবনের সহজাত প্রবৃত্তিই হয়তো সত্যের দিকে অগ্রসরমান, অন্তরের টানে, হার্দিক মোহাচ্ছন্নতায় মানুষ অপর মানুষের দুঃখের সাথে অন্বিষ্ট হয়। মানবিক জীবনবোধ থেকে নিঃসৃত তাড়নাই সেখানে বড় প্রেরণা, অন্তঃসলিলা নদীর মতো মানবিক সূক্ষ্ম সদর্থক বোধই সেখানে বড় শক্তি; ধর্মীয় বিধিনিষেধ নয়, কিংবা উপরমহলের আরোপিত কোনো নৈয়ায়িক শৃঙ্খলাবোধের যুপকাষ্ঠে অধীর হয়েও অগ্রসর হওয়ার উদাহরণ নয়। মাঝির বউ মারা গেলে দরিদ্র যুবক শিক্ষকের কিছু এসে যায় না, সে যা করেছে তা সম্পূর্ণ নিজস্ব বোধ প্রেরণা বা একান্ত মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে; একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের নৈতিক আত্মিক দায়বদ্ধতা থেকে। আর মাঝির বউয়ের পরিচয় যাই হোক—অসৎচরিত্রা সৎচরিত্রা ধনী নির্ধন যাই হোক না কেন সবচে বড় পরিচয় সে মানুষ, পৃথিবীর এই সমাজের একজন মানুষ। সেকারণেই যুবক তার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছে স্বেচ্ছায়।

উপন্যাসে কোনো জমাটবদ্ধ কাহিনি নেই, প্রণয় কাহিনি নেই, ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যুবক শিক্ষকের বিদীর্ণ আত্মার সোপানে স্থাপিত করে ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন ঔপন্যাসিক; মৃত্যুর সাথে যুবক শিক্ষকের যে সম্পর্ক তা অস্বীকার করা সহজ ছিল; তবু সে নিজেই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ঘটনার গভীরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা কাদের মিঞার দোষ নির্দোষ এর প্রামাণিকতা, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে তার করণীয় কি এসব নিয়ে যে যুক্তি পরম্পরা মনোবিশ্লেষণ, তা গভীর-তাৎপর্যমণ্ডিত এবং সূক্ষ্ম-বোধ চেতনার দ্বারা আকীর্ণ; শব্দযোজনার ক্ষেত্রে লেখকের পরিবেশ ও চরিত্র বিশেষে পরিবর্তনশীল উপযুক্ততা প্রশংসনীয়। সতত সঞ্চারণশীল জীবন যা পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকবার অধিকার নিয়ে মানুষ জন্মায় সেই শাশ্বত অধিকারকে যুবক শিক্ষক প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।

ঔপন্যাসিকের বর্ণনা ভঙ্গিমা, নিস্পৃহতা ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের সমূহ কার্যক্রমকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে : বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়—এভাবে কাহিনির উৎসমুখ খুলে ধরেন ঔপন্যাসিক। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, হালকা কথার ফুলঝুরি দিয়ে পাঠককে মাত করার ইচ্ছেও নেই; সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন।

নায়ক চরিত্র যুবক শিক্ষক ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে তার গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে এক জুনিয়র স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করে। বাবা মারা যাবার পর আর তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গ্রামের অবস্থাপন্ন মুরুব্বি ব্যক্তি দাদা সাহেবের বাড়িতে পড়ায়; সে বাবদ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। মনিবের ছোট ভাই যুবক কাদের মিঞাকে যে কদিন আগে বিয়ে করেছে দাদা সাহেব তাকে দরবেশ হিসেবে পরিচয় দেন। অথচ, একদিন তাকেই যুবক শিক্ষক মাঝির বউকে হত্যা করতে দেখে। কিছুটা সন্দেহ হলেও নানান দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে কাদের মিঞাই যুবতীর প্রকৃত হত্যাকারী। যুবক শিক্ষক দুর্বল অভাবী, এই পরিবারের কাদের মিঞার কাছে তার দায়বদ্ধতাও রয়েছে; তাছাড়া তার মা-ভাই-বোনদের যাদেরকে সে বেতনের টাকাটা প্রায় না ছুঁয়েই পাঠিয়ে দেয় সে কারণে সেসব সময় ভীতু অসহায় হয়ে থাকে। এই যুবককে উপন্যাসের নায়ক করে ঔপন্যাসিক হয়তো এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন, মানুষ যত দুর্বল চিত্তই হোক না কেন একজন সৎ বিবেকবান মানুষ কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারে না। শত বিপদের মুখোমুখি হলেও সে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছে।

মৃত্যুকে উপজীব্য করে সামগ্রিক কাহিনি আবর্তিত হলেও কাহিনির মৌল বিষয়বস্ত মৃত্যুকে অতিক্রম করে গেছে। যুবক শিক্ষক নিজের জীবন বিপন্ন করে মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করেছে। আধুনিক শিক্ষিত, ভীতু, দুর্বল, গরিব যুবক শিক্ষকের কাছে মানুষ সবচে বড় এই সার্বজনীন বোধ ও বিশ্বাসকে সে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখানেই উপন্যাসের সার্থকতা। তাছাড়া যুবক শিক্ষকের দায়বদ্ধতা তাকে মহৎ চরিত্রে উন্নীত করেছে। পৃথিবীর সব মানুষের চেতনার সঙ্গে যুবক শিক্ষকের চেতনা একাত্ম হয়েছে।

কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৯) উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহর নিরীক্ষাধর্মিতা আরো বেশি শানিত। এখানে গঠন কৌশল, শিল্প-সৌকর্য বর্ণনাভঙ্গিমা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মৃত্যু এখানে যদিও মৌল বিষয়, তবু কুমুরডাঙ্গা গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা, ঘটনাপ্রবাহ, স্টিমার যাত্রীদের সামনে তবারক ভূইয়ার অপূর্ব কথন উপন্যাসকে আলাদা ব্যাঞ্জনা দিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, বাকাল নদী এবং নদীকেন্দ্রিক অসংখ্য মানুষের জীবনালেখ্য, তাদের জীবন-যন্ত্রণা, আশা নিরাশা ব্যর্থতাবোধ নদীর সাথে জীবন-নির্মিতি সবকিছু মিলিয়ে যেন এক মহাকাব্যিক পটভূমি তৈরি করেছে। নদীর এই কান্না প্রচলিত অর্থে কোনো কান্না নয়, তবে সাধারণ মানুষের অমোঘ জীবন যন্ত্রণা যার সঠিক এবং একমাত্র বিকল্প হয়েছে নদীর কান্না, কুমুরডাঙ্গার মানুষের জীবনচরিত তবারক ভুইয়ার মুখ থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে অনায়াস ভঙ্গিতে অগ্রসর হয়েছে তা চড়া পড়া বাকাল নদীর মতো গতিময়। স্টিমারযাত্রীরা শুনছে তবারক ভুইয়ার গল্প; ঔপন্যাসিক নিজেও শ্রোতা তিনিও উত্তম পুরুষে বলে চলেছেন (মোহাম্মদ মুস্তফার কাহিনি) অনাদিকে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব মুখনিঃসৃত কাহিনিকথা, দুই মিলে জমাটবদ্ধ উপাখ্যান শেষ পর্যন্ত একই মোহনায় গিয়ে মিলেছে। কাহিনি বিস্তার করার এই কৌশল অভিনব এবং অপূর্ব ভঙ্গিমায় গ্রন্থিত। ঔপন্যাসিকের অনুসন্ধিৎসু চোখে কুমুরডাঙ্গার মানুষ ও মোহাম্মদ মুস্তফার ব্যক্তিজীবন যেভাবে চিত্রায়ন হয়েছে যে কোনো বিদগ্ধ পাঠকের হৃদয়ে তা স্থান করে নেবে নিঃসন্দেহে।

মোহাম্মদ মুস্তফা চরিত্রে যে দুর্বলতা তা বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ করার মতো। দুশ্চরিত্র বাবার অকালমৃত্যুতে সে বিপদগামী হয়নি। বরং শত বাধা অতিক্রম করেছে একে একে এবং শেষ পর্যন্ত উচ্চ পদমর্যাদায় ছোট হাকিম আসীন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে পাঠকের মনে হতে পারে, একজন হাকিম কখনো সামান্য একটা মেয়ের আত্মহত্যার অহেতুক দায়বদ্ধতার অজুহাতে আত্মহত্যা করতে পারে না। যখন বন্ধু তসলিমকে সে আবার চিঠি লেখে বিয়ের পরবর্তী তারিখ ঠিক করার জন্য তখন পাঠক মনে করতে শুরু করে মোহাম্মদ মুস্তফা তার সমস্ত দুর্বলতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। কিন্তু দেখা গেল তেঁতুল গাছের তলে যেখানে বাল্য বয়সের একটি অদৃশ্য সীমারেখা পেরিয়ে গিয়েছিল সে গাছ থেকে মোহাম্মদ মুস্তফার নিস্প্রাণ দেহ ঝুলছে; চোখ দুটো খোলা।

ফুফাত বোন খোজোকে বিয়ের প্রস্তাব মোহাম্মদ মুস্তফা দেয়নি, প্রেমের কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে এমন ভাবার সুযোগ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল নিছক সামাজিক দায়িত্ব পালনের মতো। খোদেজার সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব পূর্বে কোনো এক সময় তার বাবা দিয়েছিল, সেই সূত্র ধরে সে এগিয়ে যায়নি, এমনকি উপন্যাসের কোথাও খোদেজা সম্পর্কে তার প্রণয়াক্রান্ত কথাবার্তা নেই। তার বিয়ের খবর শুনে খোদেজার আত্মহত্যার পরে তাকে নিয়ে, তার মৃত্যু নিয়ে চেতন অচেতনভাবে ভেবেছে, আর ধীরে ধীরে তার আবাল্য দুর্বলচিত্ত তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। মোহাম্মদ মুস্তফার মৃত্যু হয়তো খোদেজার মৃত্যুকে গুরুত্ব দিয়েছে, কিন্তু ঔপন্যাসিকের দৃষ্টি ছিল সম্ভবত অন্যখানে। মোহাম্মদ মুস্তফার জীবন চেতনা থেকে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু কখনো কম গুরুত্বের নয়—জীবনের জন্য জীবনের সংলগ্নতা, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা এবং সবকিছুর সমন্বয়ে তার তীব্র আত্মদহনের ফলশ্রুতি। ‘চাঁদের অবাবস্যার’র যুবক শিক্ষক তার জীবনকে অন্ধকার কারাগারে ঠেলে দিয়েছে একই কারণে। মৃত্যু নয় মৃত্যুর যন্ত্রণা নয় জীবনের জন্য জীবনের এই আত্মত্যাগ, মমত্ববোধ উপন্যাসকে অনেক বেশি উত্তীর্ণ করেছে। দুর্বল নায়ক চরিত্রের অকারণ আত্মাহুতি ভাবলে ঔপন্যাসিকের মৌল উদ্দেশ্যকে না বোঝার দায় ভোগ করতে হবে পাঠককে।

কুমুরডাঙ্গা মূলত নদীবিধৌত বাংলাদেশ। যারা শিক্ষা সংস্কৃতির দিকে ক্রমশ অগ্রসর হতে যাচ্ছিল, ক্রুর নিয়তির মতো বাকাল নদীর চড়া যেন তাদের সব অগ্রযাত্রাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কুমুরডাঙ্গার অসংখ্য চরিত্র, তাদের জীবনের খণ্ডচিত্র, পারস্পরিক সম্পর্ক, ঘাত প্রতিঘাত সবমিলে এক জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় যেন, যাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে এক অনপনেয় শক্তির হাতে। লালসালুতে যেমন মুসলমানদের বিবেক চড়ায় আটকে পড়েছিল। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে কুমুরডাঙ্গা এলাকাবাসীর জীবন আটকা পড়েছে বাকাল নদীর চড়ায়।

লালসালু ছাড়া পরবর্তী দুটো উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতাবোধ, অনিকেত মনোভাব, নায়ক চরিত্রের মধ্যে চিত্রিত করেছেন। পাশাপাশি এই চরিত্ররা আত্মকিত বোধ, বিশ্বাস, প্রবণতা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে অবলোকন করেছেন নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। ঔপন্যাসিকের জীবনমুখিতা, চরিত্রের অবচেতন মনের গভীর রহস্যভেদ, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে নিরীক্ষণ প্রশংসনীয়। জীবন সম্পর্কে আগ্রহ, মনোবেদনাই তাঁর উপন্যাসের মৌল বিষয়।

আপাতভাবে জমিলার শিথিল মৃতদেহ, আরেফ আলী মাস্টারের কারাবরণ, খোদেজা, মোহাম্মদ মুস্তফার আত্মহত্যা, নদীর অনবরত কান্নার ধ্বনি, শস্যহীন মাঠ, শিলাবৃষ্টির প্রচণ্ড প্রকোপে ফসলের ধ্বংসস্তূপ ইত্যাদি ঘটনাক্রম ঔপন্যাসিকের মর্বিড চেতনারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হতে পারে, তবে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত গোড়া ধর্মান্ধ মুসলমান সমাজ নিয়ে তিনি যে অভিনব শিল্পকর্ম আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাতে জরা মৃত্যুর বেদনাবিদ্ধ কাহিনির অন্তরালে গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা উপন্যাসের বিবেচনায় এটি আধুনিকতার অন্যতম উদাহরণ। তিনি জীবনকে যে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা ইউরোপীয় নভেলের আধুনিকতার সাথে তুলনীয়। সাহিত্য ও দার্শনিক নানা মতবাদ ও প্রবণতাও তাঁর উপন্যাসে অন্বিত হতে দেখা যায় এবং যার প্রয়োগে তিনি সচেতন থেকে সব সময় যাতে উপন্যাস তার নান্দনিক কাঠামো ও মূল চরিত্র না হারায়। বাংলাদেশের এবং বাংলা উপন্যাসকে তিনি নতুন মর্যাদায় উন্নীত করতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে এই বিবেচনা শুধু মুসলিম বাঙালি ঔপন্যাসিক হিসেবে নয় বরং উপন্যাসে সামগ্রিক সমন্নোতির নিরিখে। সামাজিক, ধর্মীয় জীবনের তাৎপর্যপময় রূপকল্প, ব্যক্তি জীবনের গভীরতম অন্তরদেশের রহস্যভেদ নির্মাণ, অপূর্ব মননশীল অন্তর্দৃষ্টি, তীক্ষ্ম সূক্ষ্ম যুক্তিবোধ, আত্মকিত বোধ ও বিশ্বাসের ভাষা দ্বারা উপন্যাসের শরীর গঠনের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে অনাগত দিনেও বিশিষ্ট স্থান দখল করে থাকবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ২৯তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ২৯তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু
স্বপ্নের সাদা জার্সিতে ২৫ বছর
স্বপ্নের সাদা জার্সিতে ২৫ বছর
হলের ছাদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাফ
হলের ছাদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাফ
সর্বাধিক পঠিত
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’