X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
কাজী নজরুল ইসলাম

বিপ্লব-পুরুষ, একনিষ্ঠ সাধক

ধ্রুব সাদিক
২৭ আগস্ট ২০২২, ১২:২৭আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটিতে উল্লেখ করেছেন : ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে।’ কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটিতে বলেছেন : আজি মোরা শত বর্ষ পরে/ যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি/ পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে।'

সভ্যতার শুরু থেকে কবি এবং কবিতা মানুষের মধ্যে কৌতূহলের উদ্রেক করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের '১৪০০ সাল' শিরোনামের কবিতাদুটি মূলত কৌতূহল থেকে উদ্ধৃত করা। কেননা, আজ শতবর্ষ ধরে মানুষ উভয় কবির কবিতা সমান বিস্ময়ের সাথে পাঠ করে চলেছে। উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নি-বীণা  কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশের শতবর্ষ হতে চলছে। কবির করাচীর সৈনিক জীবনটি এই প্রেক্ষিতে অবশ্য কৌতূহলের উদ্দীপনা জাগানিয়া একটি ব্যাপার। বস্তুত, করাচীর সৈনিক জীবনই ছিলো নজরুল ইসলামের প্রতিভা বিকাশের সাজঘর। আর এই সাজঘরটিই কবিকে কবিতার বিপ্লব-পুরুষ এবং শিল্প-সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক করে তুলতে পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা।

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকমাত্রই জ্ঞাত : করাচীতে, সৈনিকের চাকুরিকালে, ১৯১৯ সালে, নজরুল ইসলামের প্রথম গল্প ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯২০ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলেও অল্পক’জন মানুষের মধ্য থেকে সৈনিক জীবনের রেশ বিরাজমান ছিলো। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগন্য। বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে নজরুল ইসলাম বসবাস শুরু করছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফফর আহমেদের সাথে; কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনে। সৈনিক জীবনের রেশ কবির মধ্যে তখনও উত্তুঙ্গ। সেই রেশ থেকে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের এক দিন বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবি একটি কবিতা লিখে ফেলেন। মনমগজে তুমুল বিদ্রোহ থেকে যে কবিতাটি কবি পেনসিল দিয়ে লিখছিলেন, ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেয়েছিলেন কি-না আমাদের ধারণারও বাইরে, যে, বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যেরই অন্যতম আলোচিত কবিতাটি তিনি লিখে ফেলেছেন। নজরুল লিখেছিলেন আসলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। ১৯২২ সালের জানুয়ারির ছয় তারিখে বিজলী পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই মানুষের মধ্যে যে সাড়া পড়েছিল তা পৃথিবীর আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে ঘটেছিল কি-না সন্দেহের অবকাশ রয়ে যায়। শুধু তাই নয়, নজরুল ইসলাম নামটি বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের অনন্য আসনে হয়ে যায় আসীন।কলকাতায় ফিরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর মূলত নজরুল হয়ে ওঠেন কবিতার বিপ্লব-পুরুষ এবং শিল্প-সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক। উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম যখন কলকাতায় ফেরেন, তখনকার সময়ের প্রবল আলোচনার বিষয় ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব। নিত্যনতুন সব ঘটনা ঘটছিল সেই সময়, সেই সব পটভূমি নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে যায় বুদ্ধদেব বসুর জ্ঞান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমলে নিয়ে। বসু জ্ঞান করেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের বিশ শতকের সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির না হলে মুক্ত হওয়া সম্ভব হতো না৷ ‘বিদ্রোহী’  কবিতার প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন : ‘মনে হলো এমন কিছু আগে কখনো পড়িনি।’ উল্লেখ করেছিলেন তিনি : 'বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্রপ্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না ‘বিদ্রোহী’  কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’

'তিনিই আর্টিস্ট, যিনি আর্ট ফুটাইয়া তুলিতে পারেন। আর্টের অর্থ সত্য প্রকাশ এবং সত্য মানেই সুন্দর; সত্য চিরমঙ্গলময়,' কবিতা-শিল্প এবং শিল্পী বিষয়ে নজরুল জ্ঞান করতেন। ১২টি কবিতার সংকলন তাঁর আর্টের সত্য প্রকাশঅগ্নি-বীণা কবিতাগ্রন্থটির প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে তথা অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, নজরুলের বয়স তখন মাত্র ২৩। বিপ্লবে বিশ্বাসী নজরুল নিজেকে জ্ঞান করতেন বারীন্দ্রকুমারের অগ্নি-পূজারী মহিমাম্বিত শিষ্য হিসেবে। শুধু তাই নয়, নিজের মাতা-পিতা কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও নয়, প্রথম কবিতাগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। গ্রন্থটির উৎসর্গে লিখেছেন : 'ভাঙা-বাঙলার রাঙা-যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু।'

নজরুল ইসলামকে নিয়ে ইতি কিংবা নেতিবাচক আলোচনার কালে, ওয়াকিবহাল থাকলেও, অদ্যাবধি খুব কম কবি, সাহিত্য-চিন্তক বা প্রাবন্ধিকের ভাবনায় করাঘাত করে না, যে, নজরুল ইসলাম অগ্নি-বীণা  বইটি কেন উৎসর্গ করেছিলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। শতবর্ষ পরও বিষয়টি এখনো সমানভাবে আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, নজরুল ইসলাম কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ বলতে জড়ভরতের গান ফাঁদাকে জ্ঞান করেননি। কল্লোলের পাঁচজনকে উল্লেখ করে বলেছেন, মা'র চেয়ে উপ-মা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশদের অত্যাচারে জর্জরিত, নিষ্পেষিত ভারতীয় উপমহাদেশের কবিতা-শিল্প-সাহিত্যের সাধকগণ যখন মৌনমিছিল এবং মিনমিনে প্রতিবাদ করছিলেন তখন, ২২/২৩ বছরের নজরুল ইসলাম দেশমাতৃকার প্রতি গভীর অনুরাগ, ভক্তি, প্রেম থেকে, মানুষের মনে লুটেরা ইংরেজদের অন্যায়-অবিচার-জুলুম এবং বন্দিদশার বিরুদ্ধে জেল-জুলুমের ভয়কে পরোয়া না-করে, ভীষণরকম ক্ষুব্ধ হয়ে, আক্রোশে ফেটে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের করে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার প্রতি তুমুল মনোযোগ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে, কলমকে বানিয়েছিলেন তিনি বিদ্রোহী ক্ষেপণাস্ত্র এবং লুটেরা ব্রিটিশদেরকে কবিতায় কবিতায় করেছিলেন বারবার অস্ত্রাঘাত। ফলে, বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে মানুষের মনে জাগিয়ে রাখতে বইটি উৎসর্গ করে তিনি একটি মহান কাজ অন্তত সাধন করেছেন।

একজন কবির মগজে শব্দ-বারুদভর্তি থাকলে পরেই আপনা হতেই, শতবছর পরেও, হৃদয়ে-মগজে আগুনের হলকা ছোটে। প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আগমণী, ধূমকেতু, রণভেরী, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী ও মোহররম কবিতাগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া, কামাল পাশা, আনোয়ার, শাত-ইল-আরব প্রভৃতি কবিতা নিয়ে তাঁর প্রথম কবিতার বইটিই এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছিলো বাঙালি পাঠকের মনে। মাত্র ২৩ বছরের একজন কবির কবিতার বোধ কতটা সুমহান ছিলো, সেটা অনুধাবনও করা যায় 'আনোয়ার' কবিতাটি পাঠ করার কালে। যেমন মনে দাগ কাটে বার্টল্ট ব্রেছটের অজেয়লিপি, নজরুল ইসলামের আনোয়ার কবিতাটি পাঠ করার কালেও ঠিক তেমনই দাগ কেটে যায়। গ্রন্থটি যে শব্দ-বারুদে ঠাসা ছিল তার প্রমাণ মেলে রক্তাম্বরধারিণী মা কবিতাটির জন্য লুটেরা ব্রিটিশদের কবিতার বইটিই বাজেয়াপ্ত করা থেকে। উল্লেখ্য, ‘বিদ্রোহী’  কবিতাটি সেই সময় নিষিদ্ধ করা হবে কি-না, সেটা নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে ছিলো নানান দ্বিধাদ্বন্দ্ব। রক্তাম্বরধারিণী মা কবিতাটির কয়েক ছত্র পাঠ করলে অগ্নি-বীণার প্রতি শোষকদের রক্তচক্ষু এবং ভীতির কারণ কিছুটা টেরও পাওয়া যায় :

'মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক কর মা,
সে চাবুক কর নভ-তড়িৎ
জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝ'রে
লালে লাল হোক শ্বেত হরিৎ।
নিদ্রিত শিবে লাথি মার আজ,
ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,
পিয়াও এবার অ-শিব গরল
নীলের সঙ্গে লাল মেশা।' [রক্তাম্বরধারিণী মা]

সাম্যের গান গেয়েছেন নজরুল এই জ্ঞান করে, যে, 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে মহীয়ান।' মর্ত্যের জীবদের বলেছেন কবি, 'অন্যের যত করিবে পীড়ন নিজে হবে তত ক্লীব।' নজরুল এও জ্ঞান করছেন, 'অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে; সর্বনির্যাতন থেকে মুক্ত করতেই মানুষের জন্ম।' নজরু‌লের ক‌বিতায় উচ্ছ্বসিত আ‌বেগ ও প্রা‌ণময়তায় ক‌বিতায় নতুন জীবনের পরাঙ্মুখ রূপরসগন্ধদশার জীবনযাত্রা খোঁজ পাওয়া যায়। তবে, এই সবই নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথের জাল ভে‌ঙে। রবীন্দ্রনা‌থের কুহক থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা কবিতাকে অন্যমাত্রায় স্থান দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। শব্দসূত্রে মুসলিম সংস্কৃতির মনন-চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর দ্যোতনার দিকে বাঙালীকে উন্মুখ করে তুলতে পেরেছিলেন তিনিই। শব্দের বাহারে কিংবা যুৎসই শব্দাঞ্জলি দিয়ে পাঠকের 'দিল ওহি মেরা ফাঁস গেয়ি' করেছেন। আবার আরবী-ফার্সী শব্দের পাশাপাশি উর্দু-হিন্দী-ইংরেজী এবং সংস্কৃত শব্দেরও ব্যবহার করেছেন। মূলত যখন যেখানে যা পেয়েছেন তা আত্মস্থ করে নতুন উদ্ভাসনে বাংলা গদ্যে-পদ্যে সংযোজন করে শব্দের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। শব্দ নিয়ে খেলেছেন ছন্দ-তাল-লয়-তানে। প্রাচ্য থেকে যেসব শব্দ তার সৃষ্টিশীলতার মধ্যদিয়ে অনুরণিত করেছেন, তাতে প্রাণের স্পর্শ প্রবাহিত করতে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন।

শুধু বাংলার বা ভারতবর্ষের কবি তথা মানুষ ভাবতে নারাজ ছিলেন নজরুল ইসলাম। সেটা জানা যায় ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর যেদিন সমগ্র বাঙালির পক্ষে অ্যালবার্ট হলে বাংলার বিশিষ্ট নাগরিকেরা নজরুল ইসলামকে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। যেখানে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, এস ওয়াজেদ আলী, অপূর্বকুমার চন্দ, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জলধর সেন প্রমুখ। সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন : 'নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি।… আজ এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।' এর প্রত্যুত্তরে নজরুল বলেছিলেন : 'আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।'

বস্তুত, নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাঙালির নানারকম প্রশ্ন থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু, সেই প্রশ্নচিহ্নগুলি স্বয়ং নজরুল ইসলামই রেখে গেছেন। তাঁর জীবন নিয়ে, উত্থান ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে, আত্মপরিচয় নিয়ে, সৃষ্টি-অভিমুখে তাঁর বিবর্তন ও তাঁর সৃষ্টি-উৎস হঠাৎ রুদ্ধ হওয়া নিয়ে। আর সব থেকে যে প্রশ্নটি আজও আমাদের সামনে সমানভাবে প্রোজ্জ্বল সেটা নজরুল ইসলামের মানবতাবাদ। এছাড়া, নজরুল ইসলাম নিজেকে অন্যান্য কবিসাহিত্যিকদের থেকে আলাদা করে অনন্য একটি স্থানে আসীন করে রেখেছেন হিন্দু-মুসলিম দুই সংস্কৃতিকে একাত্ম করার তাঁর জীবন-সমান প্রচেষ্টা দ্বারা। হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, দ্বিধাবিভক্ত জাত দুটিকে একাত্ম করার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন মূলত সরব। যার কারণে কবিকে জীবদ্দশায় কেউ কেউ 'কাফের কাজী' বলতেও ছাড়েনি।

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ রবীন্দ্রনাথের মত মহীরূহ'র অতলতলে অবগাহন না-করে নিজেদের গোত্রভুক্ত জ্ঞান করে পূজা করে। অন্যদিকে, অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানও নজরুল ইসলামকে না-জেনে, না-পড়ে, না-অনুধাবন করে, নজরুলের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবতাবাদের অতলতলে সিঞ্চন না-করে শুধু মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজেদের মতো করে আপনার জ্ঞান করে। নজরুলের পাঠকমাত্রই জ্ঞাত, যে, নজরুলের মতো এমন উদারচিন্তার মানুষ, মানুষের জন্য কল্যাণকামী মানুষ, মানবতাবাদের তরে নিবেদিত জীবন, এই উপমহাদেশে তথা পৃথিবীতেই খুব কমই জন্মলাভ করেছেন। আপাদমস্তক একজন মানবতাবাদী মানুষ নজরুল তাঁর পুরো জীবনে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। সুন্দরের ধ্যান আর তার স্তবগানই ছিল তাঁর উপাসনা, ধর্ম। যিনি উচ্চারণ করেছিলেন, যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব, তিনি কিভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত একটি গোষ্ঠীর নিগড়ে পড়ে গেলেন, এটা ভাবনার বিষয় বটে। যদিও আঁচ করা যায়, ব্যাপারটা যে হিন্দু-মুসলিম দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়গত গোষ্ঠীর একে-অন্যের বিদ্বেষমূলক অমানবিক মনোভাব এবং শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকাপ্রসূত।

স্বজ্ঞাজাত প্রজ্ঞা, অধীত জ্ঞান আর অসীম আবেগের ব্যঞ্জনা পরাধীনতা আর অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর পবিত্র ক্রোধকে যুক্ত করেছিলো কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দ্বারা। শুধু ক্রোধই নয়, প্রেম, সাম্য, মানবিকতা হৃদয়ের বেগাবেগ দিয়ে কবিতার ছত্রেছত্রে তিনি প্রকাশমান রেখেছেন। ধীমান পাঠককে মগজচোখে ধরে ফেলে তাঁর কবিতা-সাগরে ভাসমান থাকার নিমিত্তে, ক্রোধে ফুঁসে উঠতে, প্রেমে নিলীয়মান হতে, সাম্য, মানবিকতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে মানুষের জয়গানে আহবান করে। নজরুল ইসলামের কবিতার ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে অনেকেই নানান ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, মোহিতলাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, সজনীকান্ত দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্তসহ আরও বহু কবিসাহিত্যিকের নাম চলে আসে। বুদ্ধ‌দেব বসু সম্ভবত নজরুল ইসলামের ক‌বিতা সম্ব‌ন্ধে নানাভাবে আলোচনা করেছেন। কখনো ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন : 'রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।' আবার লিখেছেন : 'যে লেখা বে‌রোবার স‌ঙ্গে স‌ঙ্গেই লোক‌প্রিয় হয়, তাকে আমরা ঈষৎ স‌ন্দে‌হের চো‌খে দে‌খি। কারণ ই‌তিহাসে দেখা যায়, সেসব লেখা প্রায়শই টেকসই হয় না।' বসু আরও বলেছিলেন : 'জীবন-দর্শ‌নের গভীরতা খুঁ‌জে না পে‌‌য়ে অতঃপর ‘অসংযত, অসংবৃত, প্রগলভ’।' নজরু‌লের ক‌বিতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা চল‌তেই থাক‌বে। নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'নজরুলের কবিতা' প্রবন্ধটিতে বলেছেন, '… নজরুলের অনেক কবিতাই সেইসময় লেখা হয়। মনের উৎসাহে তিনি লিখতে প্রলুব্ধও হয়েছিলেন : নিভে যাবার আগে বাংলার সময়পর্যায় তখন বিশেষভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিল বলে। এরকম পরিবেশে হয়ত শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না, কিংবা এতেই জন্মায়, কিন্তু মননপ্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতার প্রয়োজন। নজরুলের তা ছিল না। তাই তাঁর কবিতা চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়।'

তবে, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের নজরুল ইসলামকে নিয়ে বলা কথাগুলোই জনান্তিকে উপযুক্ত : 'সে আজ বন্দী। রাজার দেওয়া লৌহ-নিগড়ে তার অন্তরের বিদ্রোহী-বীর কোন দেবতার আশীষ নির্মাল্য দেখতে পেল, তাই সাদরে বরণ করে নিল তাকে আপনার বলে। তারপর একদিন যখন বাংলার যুবক আবার জলদমন্দ্রে বাধা-বন্ধনহারা হয়ে স্বাধীনচিত্ত ভরে বাংলার চিরশ্যামল চিরঅমলিন মাতৃমূর্তি উন্মাদ আনন্দে বক্ষে টেনে নেবে, সেই শুভ আরতিলগ্নে ইমনকল্যাণ সুরে যে নহবতের রাগিনী বেজে উঠবে, তাতে হে কবি, তোমার প্রেম-বৈভব-গাথা–তোমার অন্তর-বহ্নি-ব্যথা সন্ধ্যা-রাগ রক্তে আপনি বেজে উঠবে; জননীর শ্যামবক্ষে তোমার স্মৃতি ব্যথা-ভারাতুর হয়ে সকল পূজার মাঝে বারেবারে তোমাকেই স্মরণ করিয়ে দেবে,– হে কবি, সে আজ নয়।'

বিস্ময়কর মানুষ কাজী নজরুল ইসলামের শিল্প-সাহিত্যকাল আর কতই-বা সময়ের! মাত্র ২২/২৩ বছর। দোর্দণ্ড দ্রোহ-বিদ্রোহের হলকা মগজহৃদয় থেকে উৎসরিত হয়েছে তো তখুনি হয়ে যেতেন আশ্চর্যরকম নরম এবং কোমল হৃদয়ানুভূতির মানুষ। কিন্তু যতভাবে পেরেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার। সেইসব অমূল্য দানের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম বহুকাল মানুষের কাছে চেতনাপ্রবাহের বীজপুরুষ হয়ে থাকবেন।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!