X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঋককবি শহীদ কাদরী

ফরিদ ছিফাতুল্লাহ
২৮ আগস্ট ২০২২, ১৩:৩১আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২২, ১৩:৩৪

তাঁর জন্ম ব্ল্যাক আউট আঁধারকালে। জন্মেই কুঁকড়ে গেছেন মাতৃজরায়ন থেকে নেমে। সোনালি পিচ্ছিল পেট তাঁকে উগড়ে দিয়েছে দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে, যেখানে নিমজ্জিত সবকিছু। রক্তচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউট আঁধারে পৃথিবীর রূপ তিনি প্রথম প্রত্যক্ষ করেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন কাঁটা-তারে ঘেরা পার্ক, তাঁবু আর সারিবদ্ধ সৈনিকের কুচকাওয়াজ। বিদেশি পতাকার নিচে শৃঙ্খলিত স্বদেশে মানুষ শীতে জড়োসড়ো। এই শীত কলোনিয়াল শীত। সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের দ্বারা আনীত শীত। নিজ বাসভূমিতে শৃঙ্খলিত স্বাধীন মননরোদ বঞ্চিত মানুষের মনোজগতের শীত। এই শীতের উত্তরাধিকার তাঁর কবিতায়। দীর্ঘ কয়েক দশকজুড়ে কখনো এই শীত তাড়াতে, কখনো এই শীতকে উপভোগ্য করে তুলতে কবিতা রচনা করে গেছেন তিনি। তাই কবিতায় তিনি কখনো শীতার্ত কখনো রৌদ্রকরোজ্জ্বল। তাঁর কবিতায় কখনো কখনো উজ্জ্বল রোদ উঠতে দেখা যায়। সে রোদের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে সহস্র বছরের বাংলা কবিতার আধুনিকতম সময় যার শুরু ধরা যায় ঈশ্বর গুপ্ত থেকে, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ হয়ে তিরিশের বাতিঘরের আলো পার হয়ে এসে পৌঁছেছে আমাদের কাছে। তাই এই কবি আমাদের এন্ড্রোমিডা অথবা প্রক্সিমা সেন্টুরাই মিল্কিওয়ের নিকটতম গ্যালাক্সি অথবা সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র। আধুনিকতার আগমনের পর রবীন্দ্রপ্রভা থেকে দূরে সরে যে আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তিরিশের দশকের কবিদের হাতে—সেই নতুন আলোকধারা পৌঁছে গেছে পরবর্তী দশকগুলোতেও। চল্লিশ-পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটে এসে এর দীপ্র প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় যে কবিদের কবিতায় তাঁদের অন্যতম একজন শহীদ কাদরী। প্রধানতম বললেও বোধ করি ভুল হবে না। তিরিশের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত বলে শহীদ কাদরী নিজেই স্বীকার করেছেন। অনেকেই অবশ্য শহীদ কাদরীর কবিতাকে বোদলেয়ারীয় বলেও মন্তব্য করেছেন। ঘুরে ফিরে কথাটি একই দাঁড়ায়। কেননা কে না জানে তিরিশের দশকে যে আধুনিকতার আগমন বাংলা কবিতায় তা বোদলেয়ার প্রভাবিতই। সৌন্দর্যের পরিব্যাপ্ত ধারণায় জীবনের অলিগলিতে পড়ে থাকা ক্লেশ, যন্ত্রণা, দুর্গন্ধ, হতাশা, কদর্যতা স্থান লাভ করে। সৌন্দর্য যে তার চিরাচরিত চেহারার বাইরেও অস্তিত্বমান সে ধারণা শিল্পে আগমন করে। সেকারণে শহীদ কাদরীকে ষাটের দশকে তিরিশের প্রতীভূ বিবেচনা করা যায়। তিরিশের সাথে ষাটের উজ্জ্বলতম সেতুবন্ধন শহীদ কাদরী। 
আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতার আধুনিক যুগ নিয়ে রচিত গ্রন্থের শিরোনাম করেন—‘ঈশ্বরগুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী’। এই শিরোনামেই শহীদ কাদরীর সেই কাব্যস্বীকৃতি মেলে। মান্নান সৈয়দের গ্রন্থের শিরোনাম থেকেই প্রতীতি মেলে শহীদ কাদরী তাঁর সময়ের প্রধানতম কবিদের একজন। এমন একজন যাকে দিয়ে একটা যুগ চিহ্নিত করা যায়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদদের পর এদেশের প্রধানতম কবি শহীদ কাদরী। এ নিয়ে সামান্য বিতর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আর যাদের কথাই বলা হোক না কেন তাঁদের কেউই শহীদ কাদরীর মতো পাঠকপ্রিয় নন—এ কথা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার যায়। এর একটা কারণ হতে পারে—শহীদ কাদরীর কবিতার আবৃত্তি উপযোগিতা। যদিও কবিতার সফলতা আবৃত্তির সফলতা দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে [আব্দুল মান্নান সৈয়দ]। কিন্তু শহীদ কাদরীর কবিতার প্রবেশমুখ অত্যন্ত মনোহর এবং পাঠক পাঠ শুরু করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তারপর কবিতার মাঝামাঝি গিয়ে পাঠক অদ্ভুত এক মায়াজাল আবিষ্কার করেন। কবিতার এই কারিকুরি শহীদ কাদরী নাটক থেকে শিখেছেন বলে স্বীকার করেছেন এক সাক্ষাৎকারে। শহীদ কাদরীর প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'উত্তরাধিকার' এবং পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে আব্দুল মান্নান সৈয়দ যে চমৎকার মন্তব্যটি করেছেন তা পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। মান্নান সৈয়দ লেখেন—‘তাঁর প্রথম বইয়ে কাদরী ছিলেন আরো ঘনবদ্ধ ও প্রগাঢ়, এখন একটু শিথিল ও বিস্তারিত; প্রথম গ্রন্থে কাদরী ছিলেন যাকে বলে 'সিরিআস' ও গম্ভীর, এখন লঘুতর ও হাস্যোদ্বেল। ফলত কাদরী সাধারণ কাব্যপাঠকমহলে আগের তুলনায় অনেক বেশি গৃহীত হয়েছেন; কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, অগ্রসর কাব্যপাঠক কাদরীর প্রাক্তন পুস্তকেই অধিকতর মুগ্ধ ও মজ্জিত’ মান্নান সৈয়দের এই গভীর নিবেশি পর্যবেক্ষণের সাথে আমরা এও যুক্ত করতে পারি যে ১৯৭৩ সালে শহীদ কাদরী তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'উত্তরাধিকার' এর জন্যই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সুতরাং মান্নান সৈয়দের পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে সম্প্রসারিতভাবে প্রতিপাদিত হয়। আরেকটি কথা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়—'উত্তরাধিকার' পরবর্তী কবিতাগুলোতে শহীদ কাদরী বড় বেশি আড়ালহীন ও সরাসরি। তাই সেই কবিতাগুলো সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরেছে সহজে। শহীদ কাদরী কি এই ব্যাপারে সচেতন ছিলেন? সম্ভবত ছিলেন। 
শহীদ কাদরী একজন বিরলপ্রজ কবি। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীকাল কবিতাচর্চা করে তাঁর কবিতার বই বেরিয়েছে মাত্র চারটি। অথচ কবিতাই তাঁর আরাধ্য ছিলো। কবিতাই শহীদ কাদরীকে শহীদ কাদরী করে তুলেছে। তিনি বলেন—‘কবিতাই আরাধ্য আমার, মানি; এবং বিব্রত তার জন্য কম কিছু নই।’ 
হাসানআল আব্দুল্লাহর সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই দ্বিধা সংকোচের কথাও তিনি বলেছেন অকপটে—‘অসংখ্য লেখা আমার মাথায় এসেছে কিন্তু আমি লিখিনি এই ভেবে যে এরা আউটস্ট্যান্ডিং কিছু না, এগুলো লিখে কিছু হবে না।’ এই দ্বিধার একটা কারণ আমি অনুমান করতে চাই। সেটি হলো, শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে শহীদ কাদরীর ব্যাপক জানাশোনা এবং উচ্চ ধারণা। বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, শহীদ কাদরী ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ এবং সকল আড্ডায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি। বন্ধু এবং অনুজেরা কখনো সখনো অগ্রজেরাও শহীদ কাদরীকে শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকরণ ও প্রবণতা, নানান তাত্বিক মতামত ও মন্তব্য প্রসঙ্গে গুরু মানতেন। সুতরাং শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে এই উচ্চ ধারণা থাকার কারণে হয়তো নিজের চিন্তাকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। আর এই বিভ্রমের কারণে আমরা তাঁর কাছ থেকে আরো বেশি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছি—এ শুধুই অনুমান।
ষাটের দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতা—দ্বিজাতিতত্ত্বের হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া—মুসলমানি জাতীয়তার গোমর ফাঁস হয়ে পড়া ইত্যাদি থেকে হতাশা সংস্কৃতিসেবীদের মধেও সঞ্চারিত হয়েছিল। এই হতাশা থেকে নতুন ধরনের শিল্পচেতনার উন্মেষ হচ্ছিল তখন। সেই সময়টায় তাই বোদলেয়ার খুব প্রাসঙ্গিক ছিল। তিরিশের দশকের কবিদের প্রভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু তবুও তিরিশ থেকে ষাট প্রোজ্জ্বলভাবে আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্য নির্মিত হয়েছে এই বাংলায় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহদের হাতে। 
'উত্তরাধিকার' কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির কথাই ধরা যাক। কবিতাটির শিরোনাম অভিনব। 'বৃষ্টি, বৃষ্টি'। কবিতার শুরুতেই রয়েছে চমক। 'সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো'। এর পর ছত্রে ছত্রে আঁকলেন বৃষ্টি ও শহরের গোপন ও প্রকাশ্য লীলা। খুব স্পষ্ট করে অনুধাবন করা যায় বোদলেয়ার-বুদ্ধদেব বসু হয়ে কাদরী হেঁটে চলেছেন ক্লেদজ কুসুমের রাস্তা ধরে।
'সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম'
একই কবিতায় দেখি—'নড়ে ওঠে টিরোনসিরসের মতন যেন প্রাচীন এ বাড়ি'। উপমার এই ঐশ্বর্য শহীদ কাদরীর কবিতাকে করেছে অনন্যতায় উদ্ভাসিত। বৃষ্টিকে রোম্যান্টিক দৃষ্টিতেই দেখা হয়ে আসছিল এতকাল। সেই পুরনো দৃষ্টি এক মুহূর্তে পাল্টে দিলেন শহীদ কাদরী। রোম্যান্টিকতা অন্তর্হিত করে নিয়ে এলেন বৃষ্টি দেখার বিপ্রতীপ শাহরিক চোখ। গেয়ে উঠলেন মানুষের একাকিত্ব আর আত্মবিলাপের গান। এ কেবল শহীদ কাদরীর কবিতাতেই পাওয়া যায়। 
কাদরীকে অনেকেই বলেন নাগরিক চৈতন্যের কবি। শামসুর রাহমানকে যেহেতু বলা হয় নাগরিক কবি। তাই তাঁর সাথে সামান্য দূরবর্তীতা নির্দেশ করতে শহীদ কাদরীকে কেউ কেউ এই অভিধায় অভিষিক্ত করেন। শহীদ কাদরীর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের এককালের রাজধানী কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। গ্রামের কিছুমাত্র ছোঁয়া তিনি পাননি। কৈশোরে চলে এসেছেন আরেক শহর ঢাকায়। মধ্যবয়সে চলে গেছেন ইউরোপ। সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার মানে সারা জীবনে গ্রামের দেখা পাননি তিনি। তাঁর জীবন যাপনও ছিলো শহুরে। কেউ একজন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন—শহীদ কাদরী গ্রামে বেমানান। বোধ করি সেকারণেই শহীদ কাদরীর কবিতার ভাষায় শহর ও শহরের মানুষই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। জীবনানন্দের ঘোরে বন্দি হতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু তবুও শহীদ কাদরীর গ্রামে যাবার সাধ ছিল—‘খুব সাধ ক'রে গিয়েছিলাম গ্রামে—একা,
হ্যাঁ, একাই—তবে এক্কেবারে উদোম একলা নয়,’
আবিদ আজাদকে উৎসর্গ করা কবিতাটিতে ঝরে পড়েছে গ্রামের জন্য তাঁর হাহাকার—
‘আমিও তো আবাল্য হা-ঘরে 
'কুটির' 'কানন' 'নদীতীর' এসবই চেয়েছিলাম।’ 
গ্রাম না থাকলেও মানুষের ক্রন্দন ছিল তাঁর কবিতায়। 
এই ক্রন্দন দেশ-কাল ভেদে পৃথিবীর সকল মানুষের অন্তর্লীন ক্রন্দনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট উৎসারণ। 
তিনি ছিলেন চিন্তায় চেতনায় প্রাগ্রসর আন্তর্জাতিকতাবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো মতবাদের অনুসারী ছিলেন না তিনি। তাঁর কবিতার রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা ছিল না। ইকবাল হাসান এই প্রসঙ্গে বলেছেন—‘কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তিক বাংলার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর শহীদ কাদরী সরাসরি কোনো মতবাদের প্রচার না করেই আমাদের এই পরিত্রাণহীন গ্রহের ভেতর যে জীবন খুব একঘেয়ে, বিরামহীন আবর্তিত হচ্ছে—তাকেও বন্দনাযোগ্য বলে ভাবতে পেরেছেন।’ নির্দিষ্ট প্রচল কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী না হলেও শহীদ কাদরীর অনেক কবিতাই প্রবলভাবে রাজনৈতিক। কেননা মানুষমাত্রই রাজনৈতিক প্রাণী। আর মানুষের হতাশা, দুর্দশা, যন্ত্রণা, সুখ, অসুখ, স্বপ্ন আর সম্ভাবনাই তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। তাঁর তুমুল জনপ্রিয় কবিতা 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা'র মতো প্রবল রাজনৈতিক কবিতা বাংলা ভাষায় কমসংখ্যক খুঁজে পাওয়া যাবে। মহৎ সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তাতে নানান আঙ্গিকে পরতে পরতে লেগে থাকে মানবিকতা, সভ্যতা, প্রজ্ঞা আর কল্যাণচিন্তার বহুমুখীনতা। 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' এমনই এক অসাধারণ সৃজন যাতে নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর করে তোলা হচ্ছে এক নারীকে। পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কারের দিনে কবি যখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী দ্বারা প্রেয়সীকে অভিবাদন করার কথা বলছেন তখন বুঝতে বাকি থাকে না পাঠককুলের যে নারীকে তাঁর যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করার সুমহান ব্রতই ঘোষিত হচ্ছে কবিতায়। এ শুধু ভাবাবেগ তাড়িত নয়। সচেতন উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা। 
রাজনীতি সচেতন না হলে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর কলম থেকে বেরুতো না—
‘হন্তারকদের প্রতি'র মতো প্রাণছোঁয়া অমর কবিতা। 
তাঁর কবিতার শব্দে, ভাষায়, ছত্রে ছত্রে রাজনৈতিক চেতনা পরিব্যাপ্ত দেখা যায়। প্রচল রাজনৈতিক চেতনার বাইরে তা। কেননা প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাদিতে তিনি মানুষের মুক্তি দেখতে পাননি। এই দিক থেকে আজও শহীদ কাদরী প্রাসঙ্গিক। থাকবেন আরো বহুকাল। জাতীয়তাবাদের সিঁড়ি ডিঙিয়ে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিকতায়। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে। 
আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায়—যেখানে মানুষের চরিত্রে কোনো নেতি নেই। ইতিবাচকতায় পূর্ণ। ক্ষুধা, শোষণ আর প্রবঞ্চনাহীন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন শহীদ কাদরী। তাঁর কবিতা 'রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন' থেকে উদ্ধৃত করা যাক— 
‘রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার? মন্ত্রীদের
কিনে দেবেন সোনালি গীটার? ব্যাঙ্কারদের 
বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার? 
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো? 
গীতবিতান ছাড়া কিছু রপ্তানি করা যাবে না বিদেশে।’
জ্ঞানশাস্ত্রসমূহ মানুষের মানবিকতাকে জাগ্রত করার মানসে উদ্ভূত হয়ে মানুষের কাঁধে চেপে বসেছে জগদ্দল পাথরের মতো। জ্ঞানের বোঝা মানুষ নিয়তই বাড়িয়ে চলেছে। জ্ঞানভার মানুষকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার যত প্রসারিত হচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে মানুষের জীবনের নানামুখি জটিলতা। নিত্যই মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে নতুন ধরনের সংকট ও ক্লেশের। আর এ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে প্রণীত হচ্ছে নিত্য নতুন বিধি-বিধান, আইন-কানুন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রসংঘ। এবং সেগুলোর নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ কেবিনেট ও বেয়নেট। কিন্তু মানুষের মুক্তি জটিলতায় নয়। মানুষের মুক্তি সারল্যে। আইনপুস্তক নয় মানুষের চাই গীতবিতান। মানুষের চাই মহৎ শিল্পচেতনা। শিল্পচেতনাই মানুষের প্রধান অবলম্বন। এ বিশ্বাসই শহীদ কাদরীকে প্ররোচিত করেছে লিখতে— 
'হ্যারিবেলাফোন্তের রেকর্ড ছাড়া অন্য কোনো আমদানি' করা যাবে না। 'প্রতিটি পুলিশের জন্যে আয়োনেস্কোর নাটক অবশ্য পাঠ্য হবে, সেনাবাহিনীর জন্যে শিল্পকলার দীর্ঘ ইতিহাস।'
এ স্বপ্নভূমিই নির্মাণের প্রফেসি প্রদান করেছেন কবি শহীদ কাদরী, বড় কবিরা যেমন করেন। অসংখ্য কবিতায় কবি কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ। পয়গম্বরের মতো উচ্চারণ করেছেন দৈববাণী—
'দ্রুত তিমিরে তলাবে
গদ্যের বদলে যারা সুললিত পদ্যে সমর্পিত—' 
কিংবা
'এই আটপৌরে পুকুরেই 
শামুকে সাজাবে তার আজীবন প্রতীক্ষিত পাড়'
অথবা তাঁর সেই বিখ্যাত 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' কবিতার— 
'ভয় নেই... আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী'।
বস্তুত কবির কাছেই পৃথিবী নিরাপদ। কবির কাছেই রয়েছে মানুষের চিরকালীন কল্যাণ। কবিই আনতে পারেন নতুন দিন। কিন্তু শহীদ কাদরীর মতো কবি খুব কি দেখা যায়!

 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ