X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

শূন্যের উপন্যাস : পাতাবাহারের পরিচয়পত্র

এমরান কবির
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৪:৫৩আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৪:৫৯

শূন্যের উপন্যাস : পাতাবাহারের পরিচয়পত্র আমাদের একজন অগ্রজ একবার আড্ডায় আচমকা এক প্রশ্ন করে বসল। আচ্ছা, তোমাদের দশকের গল্পকারদের নাম বলো তো। আড্ডায় উপস্থিত কবি-লেখকরা নাম বলতে শুরু করলো। অভীক সোবহান, আবু তাহের সরফরাজ, আহমেদ ফিরোজ, এমরান কবির, চন্দন আনোয়ার, চন্দন চৌধুরী, তৌহিন হাসান, ফারুক আহমেদ, বদরুন নাহার, মাজুল হাসান, মাদল হাসান, শুভাসিস সিনহা, রুবাইয়াৎ আহমেদ...। নাম আসতেই থাকে। অগ্রজ কবি আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে তারা গল্প বা কথাসাহিত্য চর্চা করে, কিন্তু এটা তাদের মূল পরিচয় নয়। তোমরা যাদের নাম বললে তাদের প্রধান পরিচয় হলো তারা কবি। একমাত্র তৌহিন হাসান চিত্রকলার সাথে জড়িত। নিরঙ্কুশ গল্প বা কথাসাহিত্য বা গদ্যচর্চা করে এরকম কারো নাম তোমরা বলতে পারবে? আমাদের মধ্যে তখন চিন্তার একটা সূক্ষ্ম স্রোত বয়ে যায়। আমরা মনে করবার চেষ্টা করি কে কে এভাবে কাজ করে।
সত্য কথা বলতে কী আমরা শুধু নাম হাতড়াতেই থাকলাম। বলতে পারলাম না কারো নাম। বাংলাদেশে অগ্রজ-অনুজের যে-ধরনের সম্পর্ক হয়ে থাকে আর কী। অগ্রজরা ভাবে তাদের দশকই শেষ। বাংলা সাহিত্যে যা দেবার তারাই দিয়েছে। তাদের অগ্রজরা যা পারেনি তারা সেটাও করেছে, অনুজরা যেটা করতে পারবে না কোনোদিন, তারা সেটাও করেছে। ফলে, সেই অগ্রজের বিজয়ী হাসির কাছে আমাদের মুখ শেষ পর্যন্ত নতই হয়ে গেল।
অবশ্য আমাদের কোনো কোনো যুক্তিবাজ যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের দশকে সব্যসাচী বেশি। তারা সবদিকেই সমান দক্ষ। তাই তাদের মূল পরিচয় হিসেবে আপনি শুধু কবিই বলতে পারেন না।
এসব যুক্তি কর্পুরের মতো উবে গিয়েছিল সেই অগ্রজের হাসির কাছে।
আজ সেই দশকের পুরোভাগ এবং পরবর্তী দশকের মধ্যভাগে এসেও এই প্রশ্ন আমাদেরকে আহত করে যাচ্ছে। আমাদের কাছে এখনও ওই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো যুতসই কোনো কিছু সৃষ্টি হলো না।
গল্প নিয়ে যখন এই অবস্থা তখন উপন্যাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লজ্জায় আহত হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই পাচ্ছি না। আফসোস একুশ শতকের প্রথম দশকের নিরঙ্কুশ গল্পকার বা ঔপন্যাসিক বা প্রাবন্ধিকের নাম করতে গেলে এখনো গলদঘর্ম হতে হয়। এসব দায়িত্ব কবিরাই পালন করে যাচ্ছে। (দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া।) তবে আশার কথা হলো তাদেরও আবির্ভাব এবং বিকাশ দশকের শেষ প্রান্তে এসে এবং আরো আশার কথা তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বেশি উজ্জ্বল এবং প্রতিশ্রুতিশীল; যেমন- স্বকৃত নোমান। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। সংখ্যায় এত কম কথাসাহিত্য রচিত হয়েছে যে তা বলাই বাহুল্য। একটি প্রজন্মের পনেরো বছর অতিক্রান্ত হলো (প্রকৃত পক্ষে আরো বেশি। কারণ দশকের হিসাব আক্ষরিক অর্থে ধরলেও কবি-লেখকরা আরো আগে থেকেই চর্চা শুরু করেন) অথচ আশানুরূপ কোনো কথাসাহিত্য রচিত হলো না সেই প্রজন্মের ঝুলিতে। এই দশকের কথাসাহিত্যচর্চার দৈন্যদশা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এই একটি দিকই যথেষ্ট।
চন্দন চৌধুরী (জন্মঃ ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৫) এ দশকের প্রথম উপন্যাসটি লেখেন। নীলতোয়া জোনাকী নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে।
আমরা জানি যে কোনো কিছুর সাফল্যের পেছনে থাকে নিরন্তর সাধনা ও চর্চার বিষয়টি। আমাদের চোখে শুধু ধরা পড়ে কর্মফলটিই। পেছনের সাধনা ও চর্চা বা প্রচেষ্টা অগোচরেই থাকে। চন্দন চৌধুরীর মূল পরিচয়ও কবি। পাশাপাশি তাকে গল্পচর্চা করতে দেখা যায়।
উপন্যাস তো বিশাল প্রেক্ষাপটের বিষয়। অনেক পরিকল্পনা, অনেক চরিত্র থাকে এখানে। লেখকের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বিশাল ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্র তিনি নির্মাণ করেন শুধুই তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। এতে তিনি যা যা উপস্থাপন করেন তার একটা যোগসূত্রও স্থাপন করতে হয় তাকে। ফলে এই কর্মযজ্ঞের জন্য যে বিশাল মনোসংযোগের প্রয়োজন হয় তা লেখকের কাছে নিরঙ্কুশভাবেই দাবি করে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ভেঙে পড়ে সমূহ সৌধ। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন নিরন্তর চর্চা। মূলত গল্পচর্চা করতে করতেই লেখক উপন্যাসে হাত দেবার সাহস সঞ্চয় করেন। এই চর্চা যত বেশি হবে ততই তিনি দক্ষ হয়ে উঠবেন। তিনি সূক্ষ্ম সেতুগুলো সংযোগের পারদর্শী হয়ে উঠবেন। নিয়ত কবিতা ও গল্পচর্চা করা কবি চন্দন চৌধুরীই প্রথম সাহসের পরিচয় দিলেন এই দশকের হয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখে।
উপন্যাসটি সমকালকে উপজীব্য করেই লেখা। ফলে এর প্রধান চরিত্র অনীবার্যভাবেই এ সময়ের মানুষ। কিন্তু অন্য মানুষের চেয়ে তার পার্থক্য হলো তিনি একই সঙ্গে একাধিক সত্তা ধারণ করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রেমিক। একই সঙ্গে তিনি রাজনীতিক। সমকালের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ভেতর তার যেমন জীবন-পাঠ চলে পাশাপাশি তার ভেতরে থাকে এক কোমল হৃদয় এক প্রেমিক হৃদয়ের সহাবস্থান। রাজনীতির রুক্ষ পথে যেমন সে হাঁটে তেমনি প্রেমিকার হাত ধরে হৃদয়ের সন্ধান করতেও তাকে দেখা যায়। বিজন আয়নার পরাপাঠ্যে তিনি প্রেমিকার কোমল রূপেরই সন্ধান করেন। পরক্ষণেই তাকে রাজনীতির ভেতরে প্রবেশকৃত নোংড়ামিকে পাশে নিয়ে চলতে হয়। এই দুই বিপরীতমুখী প্রেক্ষাপট তাকে একাধিক সত্তার ধারক করে তোলে। ফলে তার ভেতর চলে নিরন্তর দ্বন্দ্ব, সংঘাত। এই সংঘাতে একদিকে যেমন প্রেমিক সত্তার অকাট্য যুক্তি থাকে তেমনি রাজনৈতিক সত্তারও থাকে বিভিন্ন যুক্তি। মনের ভেতর চলতে থাকা এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রেমিক সত্তা এবার রাজনৈতিক সত্তার উপর প্রভাব ফেলতে চায়। রাজনৈতিক সত্তা এতে স্বভাবতই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। একইভাবে রাজনৈতিক সত্তা প্রেমিক সত্তার উপর প্রভাব ফেলতে চায়। এই পরস্পর প্রভাবী সত্তাগুলোর ভেতর একটি সত্তা একসময় হার মানে। প্রধান চরিত্র তার মাকে জানায় তার ভেতর আর কোনো রাজনৈতিক সত্তার অবশিষ্ট নাই।
এভাবে প্রেমিক সত্তার জয় দেখান চন্দন চৌধুরী। আমাদের নষ্ট রাজনীতির উপর তিনি এভাবেই প্রেমিক সত্তার প্রভাব দেখান। বিষয়টি প্রতীকিও। রাজনীতি যেখানে নষ্ট থেকে নষ্টতর হয়ে যাচ্ছে সেখানে প্রেমিক সত্তাই পারে নষ্ট থেকে ভালোর দিকে নিয়ে যেতে।
এতো গেল বিষয়ের ব্যাপার। চন্দন চৌধুরী খুব দক্ষভাবেই এই দুই বিপরীতমুখী সত্তার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখান। যুক্তি দেখান। যুক্তির অকাট্যতাও দেখান। শেষে জয় দেখান। এসব দেখাতে গিয়ে তিনি যে কাঠামোর আশ্রয় নেন তা আকর্ষণীয়, গতিময়। আরো যে পারিপার্শ্বিক চরিত্রের আশ্রয় নেন তারাও আমাদের পরিচিত মানুষ। ফলে তাঁর এই উপন্যাসটি হয়ে ওঠে একই সঙ্গে বিষয় ও কাঠামোর সুষম সংশ্লেষ।
চন্দন চৌধুরীর আরেকটি উপন্যাস আফগান ট্রেইল (২০১৩)। আফগানিস্তানে বন্দিশালায় আটক কয়েকজন বাংলাদেশির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এই উপন্যাসটিও তাঁর নিরন্তর সাধনা ও চর্চার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। ২৩০ দিন আটকে থাকা ব্যক্তিগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি মননে হৃদয়ে ধারণ লালন ও উপলব্ধি করেছিলেন। না করতে পারলে তাঁর হাত দিয়ে এ ধরনের উপন্যাস বের হয়ে আসত না। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে স্বয়ং তিনিই এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। আত্মীকরণের অপূর্ব ক্ষমতা না-থাকলে ও কল্পনা-মোহন না-হলে এরকম এক বিষয়ের উপন্যাস এত জীবন্ত করে লেখা সম্ভব নয়। চন্দন চৌধুরী এই কাজটিই করে দেখিয়েছেন।
এরপর আমরা হাতে গোনা কয়েকটি উপন্যাস পাই এই দশকের লেখকদের কলম থেকে। রেজা নূর-এর সন্ধ্যার ঘ্রাণ (২০০৫); সাবরিনা আনাম-এর গোধূলী বেলা (২০০৯); শাকিল আহাম্মেদ-এর মনপুতুল (২০০৯); সাগুফতা শারমীন তানিয়া (জন্মতারিখঃ ০৮ডিসেম্বর, ১৯৭৬)-র কনফেশন বক্সের ভিতর। অটাম-দিনের গান (২০১০); আবু তাহের সরফরাজ-এর জীবনপাতা; চন্দন আনোয়ার (৮ জানুয়ারি ১৯৭৮)-এর শাপিত পুরুষ (২০১০); আহমেদ ফিরোজ (১ জানুয়ারি ১৯৭৬)-এর প্রেম রোগ বিলাস (২০১০); শুভাশিস সিনহা (২৯ জানুয়ারি ১৯৭৮)-র কুলিমানুর ঘুম (২০১২); মাদল হাসান (২১ ডিসেম্বর ১৯৭৬)-এর শরীরের স্বরলিপি (২০১৪); তামের কবির (১৪ অক্টোবর ১৯৭৭)-এর একটি জলজ মুখ (২০১৪); আবু হেনা মোস্তফা এনাম-এর ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো (২০১৪)।
স্বকৃত নোমান (৮ নভেম্বর ১৯৮০) আমাদের সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কথাশিল্পী। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো : নাভি (২০০৮), ধুপকুশী (২০০৯), জলেশ্বর (২০১০), রাজনটী (২০১১), বেগানা (২০১২), হীরকডানা (২০১৩), কালকেউটের সুখ (২০১৪)।
সাগুফতা শারমীন তানিয়ার ‘কনফেশন বক্সের ভিতর। অটাম-দিনের গান’ উপন্যাসখানির নামের ভেতরই একটা বড় যতি (দাঁড়ি) প্রথমের হোচট দিতে পারে পাঠককে। একে তো বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে নামকরণ তার উপর একটি পূর্ণ যতি। পাঠক ভাবতে পারেন নামের মতো বোধহয় উপন্যাসের ভেতরেও এরকম দুই ভাষার ছড়াছড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের হেতুগত কিংবা অহেতুক যতি চিহ্ন সংবলিত নিরীক্ষার কচকচানি। কিন্তু না। তিনি এরকম আশঙ্কার পায়ে পানি ঢেলে দেন। বরং ঝরঝরে এক চমৎকার গতিময় এই উপন্যাসের ভাষা। একটি পরিবারের একাধিক প্রজন্মের বিভিন্ন নর-নারীর আত্মকথন। এই আত্মকথনের মাধ্যমেই পুরো উপন্যাসের বিস্তৃতি, এই আত্মকথনের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে ধরা হয়ে যায় কয়েক প্রজন্মের মহাসময়কে। ধরা হয়ে যায় তাদের ভাব, বিষাদ, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, সংকট, আনন্দ, বেদনা এবং অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গি ও আপন দর্শন। উত্তম পুরুষে লেখা সব নর-নারীর এরকম অভিব্যক্তি একেবারে নতুন নয় বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু এ উপন্যাসের সৌন্দর্য হলো এর নির্মেদ বর্ণনায়। যে যা বলতে চায় তা বলতে পারায়। যার যা সংকট ও মূল্যায়ন তা তার মতো করে করতে পারায়।
এরকম কাঠামোর উপন্যাস লেখার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো কথকের আত্মকথনের ভেতরে লেখকের প্রবেশ। লেখকের প্রবেশ বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন সরাসরি আখ্যানভাগে উপস্থিত হলেন তিনি। অথবা কথকের মনস্তত্ত্বের ভেতরে তিনি ঢুকে পড়লেন। যে চরিত্র যেভাবে ভাবার কথা যেভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশের কথা সেভাবে তার ভাবনা-অভিব্যক্তি প্রকাশ হলো না। ফলে লেখক ও কথকের মিলিত রসায়নে যা প্রকাশিত হলো তা হয়ে গেল অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
দুঃখের বিষয় সাগুফতা শারমীন তানিয়া-র উপন্যাসখানি এই সংঘাত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ফলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায় চরিত্রগুলোর ভেতর। পাঠক সমন্বয় ও সংযোগের জন্য শেষাবধি অপেক্ষা করে। করতে হয়। এখানে লেখকের সাফল্য যে পাঠককে অপেক্ষা করাচ্ছেন তিনি। কিন্তু অপেক্ষা শেষে পাঠককে হতাশই হতে হয়।
কথকের ভেতরে লেখক ঢুকে পড়েন হুটহাট। তাতে চরিত্রের নিরঙ্কুশ ভাবনার বিশ্বস্ততা নষ্ট হয়। চরিত্র ভাবছে একভাবে, দেখছে তার মতো করে এর ভেতর যখনই লেখক প্রবেশ করবেন তখনই চরিত্রের ভাবনা প্রভাবিত হতে বাধ্য। এই প্রভাবিত ভাবনা পাঠক চায় না। পাঠক চায় চরিত্রের অভিব্যক্তি। তাতে লেখক বা অন্য কেউ প্রবেশ করলে তাকে অনাহূতই মনে হয়। লেখক এরকম অনাহুতের মতো বহুবার উপন্যাসের ভেতরে চরিত্রের ভাবনার মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়েছেন।
লেখক হয়তো-বা যা বলতে চান তা অধিকতর স্পষ্ট করতে এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। তাতে হয়তোবা তিনি সফলও হয়ছেন। কিন্তু তিনি যে আঙ্গিক ব্যবহার করলেন সেই আঙ্গিকের সততা ও সাফল্য তাতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এই উপন্যাস নিয়ে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, ‘সাগুফতা শারমীন তানিয়া তাঁর প্রথম বইটিতেই অসামান্য পূর্ব প্রস্ততি আর শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর ভাষা নির্ভার, জড়তাহীন, শব্দসম্ভার ঈর্ষাজাগানিয়া।’ লেখকদের পূর্ব প্রস্তুতি মূলত দেখা যায় তার চর্চার ভেতরে। তানিয়াকে সেভাবে দেখা যায়নি। তাঁর ভাষা কিছু ক্ষেত্রে নির্ভার মনে হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে নয়। যেমন ঝুমু যখন তার কথাগুলো বলছে তখন নির্ভার মেদহীন প্রাঞ্জল লাগছে। কিন্তু ঝুমুর আগের প্রজন্মের একজন পুরুষ আজহারউদ্দীন আহমেদ যখন তার কথাগুলো বলছে তখন নির্ভার মনে হয়নি। এখানে মনে হয়েছে লেখক স্বয়ং উপস্থিত হয়ে আজহারউদ্দনিকে দিয়ে লেখাচ্ছেন। আজহারউদ্দীন যে-সময়ের সে-সময়ের ভাষা ও অভিব্যক্তি প্রকাশ হলেই না বিশ্বস্ত হতো। তা হয়নি। বরং এরকম ভারি ভারি শব্দের প্রয়োগ স্বল্প শিক্ষিত আজহারউদ্দীন কীভাবে করতে পারেন তা ভাবনায় ফেলে দেয়। এখানে লেখকের প্রত্যক্ষ প্রভাব খুব বেশি মাত্রায় উপস্থিত- যা কথকের কথার সততা ও বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একইরকম কথা প্রযোজ্য ঈশরাত বানু ও তার মা ফরহাত বানুর কথকতা নিয়েও। অবশ্য রঞ্জুর ডায়েরিকে খুব বিশ্বস্ত মনে হয়েছে।
লেখকের আঁকা কিছু স্কেচ পাওয়া যায় উপন্যাসের ভেতরে। কিন্তু এগুলোর কারণ কী তা বোঝা যায় না। তিনি ভূমিকায় অবশ্য জানাচ্ছেন তিনি ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে তাঁর জীবনসঙ্গীকে খুব জ্বালিয়েছেন। তা জ্বালান যত ইচ্ছে। কিন্তু স্কেচগুলো উপন্যাসের ভেতরে দিয়ে তিনি পাঠককে আরেকবার জ্বালালেন কেন তা বোঝা গেল না। এসব স্কেচ দিয়ে তিনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন তা বোধহয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানবেন না। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সাযুজ্যহীন এসব অর্থহীন স্কেচ লেখকের ছেলেমানুষির ইঙ্গিত দেয়। অথবা তিনি জানাতে চান তাঁর এই প্রতিভার কথা। তাও ভালো যে তাতে নিজের ঢোলকে একটা বাড়ি তো দেয়া হলো।
চন্দন আনোয়ারের উপন্যাস শাপিত পুরুষ। প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। হিন্দু ছেলে সুমন গাঙ্গুলী আর মুসলমান মেয়ে রিমার প্রেম বিয়ে এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা প্রতিঘটনা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কাহিনিকে উপজীব্য করে উপন্যাসখানি লিখিত। এ উপন্যাসের প্রধানতম সৌন্দর্য হচ্ছে আবেগের জায়গায় আবেগের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। তেমনি বাস্তবতার জায়গায় বাস্তবতাকেই তুলে আনা হয়েছে। আবেগের বেগ দিয়ে কখনোই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়নি।
অথচ এরকম ক্ষেত্রে লেখকরা সেই ভুলটিই করেন। নিজের বিপ্লবী চিন্তাকে তিনি বাস্তবতার উপর এমনভাবে আবেগ দিয়ে চাপিয়ে দেন যেন বাস্তবতার কোনো আঘাতই অপ্রচলকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু বিষয়টা তো উল্টো। বাস্তবতা চিরকালই বাস্তবতা। আবহমানকালের যে প্রচল- যা সমাজ স্বীকৃত ও সামাজিক অনুশাসনের অন্তর্গত তাকে আবেগের বেগ দিয়ে এবং জোরপূর্বক লেখকের কলম দিয়ে অস্বীকার করার এক প্রবণতা আমাদের লেখকদের ভেতরে রয়েছে। চন্দন আনোয়ার সে-পথে যাননি। তিনি রূঢ় বাস্তবতাকেই তুলে এনেছেন।
সুমন গাঙ্গুলী ও রিমার প্রেম হয়ে যায়। প্রেমের যা পরিণতি সাধারণভাবে আমরা ধরে নেই সেটাই তাদেরও জীবনের লক্ষ হয়ে যায়। তাদের ভেতরেও প্রধান বাঁধা ধর্ম। কারণ সুমন গাঙ্গুলী হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। আর রিমা মুসলমান সম্প্রদায়ের। দুই সম্প্রদায়ের মানব-মানবীর প্রেম হয়ে গেলেও বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের সামনে স্বাভাবিকভাবেই অনেকগুলো বাঁধা চলে আসার কথা। আসেও। তারা এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। এভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে তারা ঘর-সংসার শুরু করে। ধর্মীয়ভাবে বিয়ের যেসব আনুষ্ঠানিকতা তা তাদের করা হয়ে ওঠে না। করা হয়ে ওঠে না, কারণ সেটা তাদের ক্ষেত্রে সম্ভবও হয়ে ওঠে না।
সমস্যা হলো প্রেম যখন চলে তখন তো সবকিছুই মিষ্টি। কারণ আবেগ। বিয়ে হলে প্রথমে আবেগের আকাশ থেকে বাস্তবতার ধূলোয় নামতে হয়। তখনই দেখা যায় সমাজের চোখ তাদের উপর চোখ রাঙাচ্ছে। কারণ যা সমাজে স্বাভাবিক এবং আবহমান তার ব্যতিক্রম হলেই এই চোখ রাঙানি যে কারো উপর এসে খবরদারি করবেই। বাস্তবতার ধুলোয় নেমে ধীরে ধীরে সুমন গাঙ্গুলী ও রিমা বুঝতে পারে এখানে সম্প্রদায়গতকারণে কত বাঁধা চলে আসছে তাদের দাম্পত্য জীবনে। তারাও যেহেতু সমাজবদ্ধ মানুষ, সে কারণে সমাজকে অস্বীকারও করতে পারে না। আবার নিজেদের পরিচয় নিয়েও হীনমন্যতায় ভোগে। রিমা ভাবে আমরা না হয় মেনে নিলাম সবকিছু। মেনে নিলাম প্রেমের টানে। কিন্তু আমাদের যে পরবর্তী প্রজন্ম আসবে সে কী পরিচয় দেবে সমাজের কাছে? সে যদি তাদের এই পরিচয় নিয়ে প্রশ্নের আঙুল তোলে? এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে সে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। ওই প্রশ্নের আঙুলকে সে খুব ভয় পেতে থাকে। পেটে ধরা সন্তান যদি তাকে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখী করে তখন সে কী জবাব দেবে। সে-জন্য সে একের পর এক বাচ্চা নষ্ট করতে থাকে। সুমন গাঙ্গুলী প্রথমে মনে করে এটা প্রাকৃতিক ভাবেই হচ্ছে। এক সময় সে আবিষ্কার করে, এই কাজ রিমা ইচ্ছাকৃতভাবে করাচ্ছে। সুমনও নানাবিধ টানাপোড়েনে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। ফলে রিমার সাথে তার দাম্পত্য উষ্ণতা আগের মতো থাকে না। তার ভাবনায় চলে আসে হাজারো বিষয়। এতে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। সুমন ভাবতে থাকে রিমা এবারও এ্যাবরশন করাবে। এটা নিয়ে রিমার সাথে তুমুল ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে সুমন মনে করে চাকু দিয়ে পেট থেকে বেবি বের করে নেবে। তাহলে এ্যাবরশন বা অন্যকিছু করার সুযোগ পাবে না রিমা। কয়েকবার উদ্যোগও নেয় সে। রিমা বুঝে যায় সুমন আর স্বাভাবিক নেই। সে পালিয়ে যায় বাসা থেকে। সুমন আত্মহত্যা করে।
বিষয় হিসেবে চন্দন আনোয়ার খুব স্পর্শকাতর এবং পুরনো কিন্তু সচল এক বিষয়ও প্রেক্ষাপটকে বেছে নিয়েছেন। এরকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে নানাবিধ জটিলতা অতিক্রম করতে হয় তাও তিনি সুনিপুণভাবে দেখিয়েছেন। বিপ্লবের কচকচানি করে তথাকথিত কিছু লেখকের মতো তিনি মধুরেণ সমাপয়েতের বহুল প্রচল পথে পা বাড়াননি। ক্রমাগত মানসিক চাপে সুমন ধীরে ধীরে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীতে পরিণত হয়। একজন সিজোফ্রেনিক রোগীর যে মানসিক বৈকল্য বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয় তিনি তা চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন।
আহমেদ ফিরোজ-এর প্রেম রোগ বিলাস প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। মিডিয়া জগতের মানুষদের কথিত-অকথিত জীবনের ও প্রেমের গল্প। উপন্যাসখানিতে মিডিয়া জগতের মানুষদের যে জীবন তুলে এনেছেন লেখক আহমেদ ফিরোজ তাতে কয়েকটি দিকের প্রতিই অধিকতর আলো ফেলা হয়েছে। লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন-এর পাশাপাশি উঠে এসেছে প্রেম ও যৌনতার সাঙ্ঘর্ষিক রূপ। আর প্রধান চরিত্র পাভেলের কিছু মানবিক দিক।
গাজীপুর শ্যুটিং করতে গিয়েই নায়ক চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক পাভেল সন্ধান পায় দিয়ার। একটা দৃশ্যে অভিনয় করানোর পরই পাভেল টের পান তার সুপ্ত প্রতিভার কথা। দিয়ারও অভিনয়ের অদম্য ইচ্ছা। গরিব বাবা-মার মেয়ে দিয়ার এরকম ইচ্ছা ও তার ভেতরে পাভেলের সুপ্ত প্রতিভার আবিষ্কার দিয়ার ভাগ্যকে পাভেলের সাথে জড়িয়ে ফেলে। তার স্থান হয় পাভেলের বাড়িতে। আগে থেকে বাস করা সেবার সাথেও দিয়ার পরিচয় হয়। পাভেলের কল্যাণে তারা বিজ্ঞাপন, নাটকে অভিনয় করে। পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যায়।
উপন্যাসের এ অংশটুকু বাদ দিলে যা থাকে তা প্রেম ও যৌনতার এক সাংঘর্ষিক রূপ। সেবার সাথে পাভেলের যৌন সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। একরাতে দিয়ার সাথেও তার এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সেবা তাতে মোটেও রাগ করে না। এটা নিয়তি ও সম্ভাবনার শেষ প্রান্ত হিসেবেই সে ধরে নেয়। এর ভেতর তাদের কলেজের এক বিষণ্ন ম্যাডামকে তারা বাসায় আসতে বলে। বলে তারা পাভেলের সাথে পরিচয় করে দেবে।
মিথিলা ম্যাডাম বাসায় আসেন। পাভেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তারা। যথারীতি পাভেল তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়। সেও রাজি হয়। নাটক প্রচারের আগে মিথিলা বেঁকে বসে যে নাটক প্রচার করা যাবে না। তাতে তার সংসার ভেঙে যাবে। এদিকে সব ঠিকঠাক। এ সময়ে নাটক প্রচার না হলে তার ও প্রযোজকের আটকে যাবে অনেক টাকা।
এর ভেতরেই পাভেল ও মিথিলা জড়িয়ে যায় যৌন সম্পর্কে। মিথিলা নিয়মিত আসতে থাকে পাভেলের ফ্ল্যাটে। একদিন সে জানায় নাটকটি প্রচার হোক। পাভেল বলে তাতে যে তার সংসার ভেঙে যাবে। মিথিলা বলে, ভাঙুক। এরপর তারা প্রবল উচ্ছ্বাসে যৌনতায় মেতে ওঠে।
যতদিন দিয়া ও সেবার সাথে এই যৌন সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল পাভেল ততদিন সবকিছু যেন ঠিকই ছিল। দিয়া ও সেবা পরস্পরকে মেনে নিয়েছিল। মেনে নিয়েছিল তাদের ভেতরকার অস্বাভাবিক সম্পর্ককে। কিন্তু মিথিলার সাথে যখনই লাগামছাড়া যৌনতায় জড়িয়ে যায় পাভেল তখনই তাদের ভেতরকার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক রূপ নেয়। ত্রয়ী প্রেমের ভেতরে নতুন এক বাঁক ও মোচড় দেয় মিথিলার সম্পর্ক। ফলে এতদিনকার চাপা ক্ষোভ প্রকাশিত হয়ে যায় দিয়া ও সেবার। তারা সরাসরি মিথিলার সাথে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে। শেষে সিদ্ধান্ত হয় দিয়া ও সেবার মতো সেও পাভেলকে বিয়ে করবে এবং সবাইকে নিয়ে মিথিলার ফ্ল্যাটে উঠবে।
কিছুদিন যাবার পরেই মিথিলার মনে হতে থাকে সে ঠকেছে। তাকে ঠকানো হচ্ছে। সে দিয়া ও সেবাকে বের হয়ে যেতে বলে। পাভেল তাতে বাধা দেয়। শেষে পাভেলও বের হয়ে যায়। তারা আগের বাসায় ওঠে।
পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে সে মিডিয়া জগৎ থেকে সরে আসে। বুড়িগঙ্গার পাড় দিয়ে দিনের পর দিন হাঁটতে থাকে। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থেকে ঘুমায়। আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে সূর্যটা আড়ালে চলে গেছে। সেদিকে দু’চোখ বন্ধ করে হাঁটতে থাকে নতুন আলোর খোঁজে।
এভাবেই সমাপ্ত হয় উপন্যাসটি।
যৌনতা যখন প্রেমের খোলসে কারো জীবনে প্রবেশ করে এবং সর্বগ্রাসী রূপে উপস্থিত হয় তখন তার কী পরিণতি হতে পারে তারই এক জীবন্ত ও সমসাময়িক চিত্র তুলে এনেছেন আহমেদ ফিরোজ। এরকম সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে খুব সহজ ও সাবলিলভাবে যারা যুক্ত হতে পারে তাদের একটি অংশ হিসেবে আহমেদ ফিরোজ মিডিয়া জগতের এক নায়ক-পরিচালককে তার মূল চরিত্র হিসেবে তুলে এনেছেন। তার ভালোবাসা প্রথমে উজ্জ্বল। কিন্তু তা পরক্ষণেই রোগে পরিতাপিত। তারপর সেটা বিলাসে রূপ নেয়। এটা যখন বিলাসে রূপ নেয় তখনই তা আর স্বাভাবিক থাকে না। এই অস্বাভাবিক দিকটিই প্রগাঢ় অনুভূতির সুনিপুণ ব্যপ্তিতে লেখক তুলে এনেছেন।
যৌন মিলনের ক্ষেত্রে লেখক আহমেদ ফিরোজ যে আবহ নির্মান করেছেন তা চমৎকার শিল্প-শোভন। তিনি প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে এমন বর্ণনা দিয়েছেন- যা তার দৃশ্য ও শব্দের উপর সুকঠোর নিয়ন্ত্রণের পরিচয় দেয়। লেখকের বর্ণনা পাঠককে দৃশ্যের ভেতরে নিয়ে যায় গভীরভাবে পাশাপাশি নর-নারীর আবেগ ও অভিব্যক্তির সাথেও একাত্ম করে তোলে।
শুভাশিস সিনহার কুলিমানুর ঘুম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। আমরা জানি এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি ২০১০ সালে জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য শীর্ষ পাঁচে স্থান পেয়েছিল। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের আহ্বানে নবীন-প্রবীণ অনেক লেখকের জমাকৃত পাণ্ডুলিপি থেকে এই উপন্যাসটি নির্বাচিত হয়। তারপর উপন্যাসটি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়। একটা উপন্যাসের এতকিছুতে অন্তর্ভুক্তি একটু বাড়তি মনোযোগ দাবি করে বৈকি। প্রত্যাশাও তো বাড়িয়ে দেয়।
এই বাড়তি প্রত্যাশা পাঠককে প্রথমে অতি আগ্রহী করে তোলে। পিপাসার্তও করে তোলে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো পাঠক উপন্যাসখানি পাঠান্তে তৃপ্তিবোধই করেন। হতাশ হন না। বাড়তি প্রত্যাশা পাঠককে আশ্বস্তই করে।
মণিপুরী জনপদের এক অদ্ভুত চরিত্র এই কুলিমানু, যে নির্দ্বিধায় কথা বলতে বলতে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তাকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যায় এই উপন্যাসের কাহিনি।
শূন্যের উপন্যাস : পাতাবাহারের পরিচয়পত্র বউ আর দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সারাজীবন মানুষের দুয়ারে কাজ করে করে জীবন পার করলো কুলিমানু। তবুও তার ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। সারাজীবন অন্যের জমিতে কাজ করলো। নিজের কোনো জমি হলো না। তার আক্ষেপ একটা ফসলের পুরোটাই নিজের হলে কেমন লাগে? এই আনন্দ তার জীবনে একটিবারের জন্যও এলো না। বড় মেয়ে রত্নার বয়স আটাশ। তাদের জনপদের সামাজিক অবস্থার নিরিখে এই বয়স অনেক বেশি। উপরন্তু গায়ের রং কালো। আরো সমস্যা তাদের নিজেদের গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষেধ। মণিপুরী জনপদের ভেতরে কুলিমানু যে গোত্রের সেই গোত্রের জনসংখ্যা আবার আশি ভাগ। ফলে রত্নার বিয়েটা নিয়ে বিশাল চিন্তার রাজ্যেই হাবুডুবু খেতে হয় কুলিমানুর। ছোট মেয় রানী অসুস্থ। দিনে তার ত্রিশ টাকার অষুধ লাগে। সেই হিসেবে মাসে নয়শত টাকার অষুধ কিনতে হয়। কুলিমানুর সংসারে নয়শত টাকা মানে অনেক টাকা।
কুলিমানুর শ্যালক রিকশা চালানোর পরামর্শ দেয় তাকে। তাতে তার ব্যক্তিত্বে প্রবল ধাক্কা লাগে। সারাজীবন তো পারই করলাম। তারপরও তার সম্প্রদায়ের যে সম্মানটুকু ছিল, রিকশা চালিয়ে তাও নষ্ট করবে সে! এতোটা ব্যক্তিত্বহীন সে হতে পারবে না।
কুলিমানুর নতুন সমস্যা কথা বলতে বলতেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। সেটা নিয়ে পাড়ায় হাসাহাসি হয়। পরিবারের সদস্যরা বিব্রত হয়। কিন্তু কী করবে সে। সে চেষ্টা করে এটা এড়িয়ে চলার। পারে না।
এসবের মধ্যেও তারা স্বপ্ন দেখে। কুলিমানু শুনেছে তাদের যে আদিনিবাস ভারতের মণিপুরীতে সেখানে শুধু সুখ আর সুখ। একদিন তাদের গাঁয়ে ভারত থেকে এক গায়েন আসেন। তার পালা দেখার জন্য লোকে ম-পের ধুলোয় গড়াগড়ি দিতেও প্রস্তুত। সামনে কীর্তন আছে। ও-পাড়ার উকিল ব্রজকিশোর আর তার গোষ্ঠী সবাই মিলে একটা কীর্তন করবে। গায়েনের নাম চন্দ্রকুমার। তিনি গানের ফাঁকে ফাঁকে সংস্কৃতে অনর্গল শ্লোক বলে যেতে পারেন।
সেই গায়েনের পালা দেখতে আসে কুলিমানু ছাড়া সবাই। কুলমানু আসে না। কারণ ওই মরণের ঘুম। চন্দ্রকুমারকে কুলিমানুর বউ তপতির কাছে রাজকুমার মনে হয়। অভাব অনটন আর নানাবিধ সঙ্কটের ভেতরেও তার ভেতরের নারী সত্তা জেগে ওঠে। সে প্রবলভাবে চন্দ্রকুমারকে চায়। তার মনে পড়ে কুলিমানুর সাথে যৌনতার সময় কার নাম যেন অষ্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে কুলিমানু। আজ চন্দ্রকুমারকে দেখে কুলিমানুর ওই আচরণকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে।
পালাচলাকালীন রানী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়। তারপর থেকে তার অসুস্থতা বেড়েই চলে। তাদের আদিরাজ্য মণিপুরী নিয়ে অনেক স্বপ্ন-কল্পনা ছিল। চন্দ্রকুমারের কাছে তার খবর নিতে গেলে তিনি যা বলেন তাতে তাদের সে আশার জায়গাটিও ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ তারা চন্দ্রকুমারের কাছে জানতে পারে মণিপুরে মারামারি গোলাগুলি চলছে। পুলিশ নিরীহ মানুষকে পেটাচ্ছে, আরও নানা ভয়ঙ্কর কাণ্ড।
এরই মধ্যে এক আশার আলো নিয়ে হাজির হয় রশিদ মিয়া। তিনি কুলিমানুর কাছে প্রস্তাব করেন গামছা বানিয়ে দেয়ার। বড় মেয়ে রত্না তো বাড়িতেই থাকে। প্রতিটা গামছার বিপরীতে তিনি টাকা দেবেন। কুলিমানু খুব খুশি হয়। সব ঠিকঠাক করার পর রশিদ মিয়া কুলিমানুকে জানায় তার পাওনা টাকার কথা। কুলিমানু এবার হিসাব বুঝতে পারে। বুঝতে পারে এতে পরিশ্রমই যাবে সংসারে কোনো টাকা আসবে না।
রত্না মনে মনে লক্ষ্মীদাকে ভালোবাসে। লক্ষ্মীদাও। লক্ষ্মীদা ডাক্তারি পড়াশুনা করে। সে বলেছে ডাক্তারি পাস করা হলে সে গ্রামে হাসপাতাল দেবে। রত্নাকে সে বিয়েও করবে। এই আশায় আশায় রত্না দিনাতিপাত করতে থাকে। রানী অসুস্থ হলে অনেক সঙ্কোচ নিয়ে লক্ষ্মীদাকে ফোন করে। লক্ষ্মীদা তাকে আবারও আশার বাণী শোনায়। একদিন লক্ষ্মীদা জানায় সে এক বাঙালি মেয়ের প্রেমে পড়েছে।
এভাবে সবার আশা আর স্বপ্নের জগৎটি ধ্বংস হয়ে যায়।
শুভাশিস সিনহা নির্মোহভাবে পুরো উপন্যাসের প্রত্যেকটা পরত এঁকেছেন। নির্ভার ঝরঝরে মেদহীন এর ভাষা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের আশা আকাক্সক্ষা স্বপ্ন প্রত্যাশা প্রাপ্তি হাহাকার খুব নিপূণভাবে এঁকেছেন। তাদের জীবনের উপলব্ধিগুলো এমনভাবে বর্ণনা করেছেন- যা একেবারেই নিরেট বাস্তব। উপন্যাসের প্রত্যেক পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত-ঘাম-মাংসের এক বিপর্যস্ত জীবনের ছবি। সে ছবির মধ্য দিয়ে দেখা যায় প্রান্তবর্তী মানুষের নির্মম রূপ আর রেখা।
‘ইলিশ মাছের কাঁচা গন্ধই কুলিমানুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কুলিমানু ভাবতে থাকে না জানি রান্নার পর তার গন্ধটা কেমন ছিল।’ কিংবা ‘কুলিমানু যে ফসল ফলায় তার পুরোটাই নিজের ঘরে তোলার আনন্দটা যে কী জিনিস, এ জীবনে সে টেরই পেল না। ’ কিংবা ‘সংসার নেই বলে কাঁদার লোকেরও অভাব। তবু নীলমণির বুড়ি মা তার নাম ধরে বড় রাস্তা পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে গেল। এরপর সে-ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো।’ -এই যে ছবিগুলো তা ওই প্রন্তবর্তী মানুষেরই জীবনের বিপর্যস্ত ছবি। এই ছবি আঁকতে গিয়ে শুভাশিস সিনহা যে কাঠামোর আশ্রয় নিয়েছেন তা প্রচলিত। কিন্তু ভেতরের যে রূপ আর রেখা এঁকেছেন তা মণিপুরী সম্প্রদায়ের চিরকালীন ছবির নতুনতর বয়ান।
মাদল হাসানের শরীরের স্বরলিপি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নূরে আলম সিদ্দিক। একজন বিহারী। তার বাঙালি বন্ধু মৃদুলসহ আরো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও আড্ডার বিবরণই উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। প্রচলিত কাহিনি বা গল্প বলতে যা বুঝায় এ উপন্যাসে সেটা অনুপস্থিত। বিহারীদের পরিচয়-অস্তিত্বের প্রশ্নটিই প্রাধান্য পাওয়ার কথা এ উপন্যাসে। উপস্থাপিত হওয়ার কথা তাদের সংকটের কথা। বিহারীদের নিয়ে যখন কোনো উপন্যাসের প্লট নির্মিত হয় তখন তাদের পরিচয়-সংকটটিই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যাগুলো তো আছেই। মাদল হাসানের এই উপন্যাসখানির পটভূমি বিহারী হলেও বিষয়গুলো সিরিয়াসলি আসে না।
আড্ডাবাজ কয়েকজন তরুণ ক্রমাগত আড্ডা দিয়ে যায়। মাদল হাসান এই আড্ডার ভেতর দিয়েই তাদের সংকটটি তুলে আনার চেষ্টা চালান। কিন্তু তিনি জানেন না, আড্ডায় কিছু চিত্র, কিছু যুক্তি, কিছু হাসি ঠাট্টা ছাড়া আদতে কিছুই হয় না। এ উপন্যাসেও আড্ডার মাধ্যমে এগুলোই উঠে এসেছে। উপন্যাসের নাম ও বিষয়ের গাম্ভীর্যের সাথে কোনো সংযোগ সৃষ্টি হয়নি।
তিনি মুখবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘বিহারী সমস্যা লইয়া মহামতি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিতে চাহিয়াও চলৎশক্তিহীন হইয়া হতোদ্যম ছিলেন।’ এর মানে কী? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বিহারী সমস্যা নিয়ে লিখতে চাওয়ায় চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন? তিনি হতোদ্যম ছিলেন? থাকলে তো মাদল হাসানের কী তা বুঝা গেল না। একথাগুলোর মাধ্যমে কি মাদল হাসান বোঝাতে চান যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যা করতে পারে নাই, তিনি তা করে দেখালেন? কে কী করেছে কে কী করে নাই সেটা দিয়ে মাদল হাসানের কর্মপ্রয়াসের মূল্যায়ন হবে? যদি সেই ব্যক্তি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হন তবুও?
এ উপন্যাসের ভাষা এতই বালখিল্যপূর্ণ যে পড়তে পড়তে রাগ সপ্তমে উঠে যায়। তিনি যে আসলে কার ভাষা তুলে এনেছেন তা তিনি আর স্বয়ং আল্লাপাক জানেন। ফেরেশতারাও জানেন না। তার নিজের একটি ভাষা থাকতে পারে। সেটাও নাই। তিনি কথকের ভাষা ব্যবহার করতে পারতেন সেটাও ঠিকমত করেন নাই। কথক বলে যাচ্ছে তার মতো করে এর ভেতরেই লেখক ঢুকে পড়লেন। তার ভেতরে বিহারী সিদ্দিক ভাই ঢুকে পড়লেন তার ভেতরেই অন্য বাঙালি বন্ধুরা ঢুকে পড়লো। এতে কী হলো? কথার জট পেকে গেল। পুরো উপন্যাসজুড়ে লেখক এই কথার জটই পাকিয়েছেন।
শরীরের ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছেন এভাবে, ‘এ শরীর সময় ও সময়ার; এ শরীর মানব মানবীর, এ শরীর প্রাণ-প্রকৃতির, এ শরীর রীতি ও রীতিহীনতার, এ শরীর রাজনীতির, এ শরীর ব্রহ্মা-ের এবং দেহভা-ের।’ কিন্তু পুরো উপন্যাসজুড়ে এই শরীরের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না- যা পাওয়া গেল সেটা হলো কতিপয় তরুণের আড্ডা, হিহি হাহা, অ্যাডাল্ট কৌতুক, স্ল্যাং, ঠাট্টা তামাশা ইত্যাদি। প্রত্যেকটা অধ্যায়ের আগে সংগীতের সা রে গা, কোনোটাতে রে গা মা, তারপর গা মা পা ইত্যাদি দিয়ে শুরু। এর কারণটা কী তা এক বিরাট রহস্যের ব্যাপার। আরো বালখিল্যপণা রয়েছে প্রত্যেকটা অধ্যায়ের শুরুতে। সেটা হলো কবিতাংশ। বহু চেষ্টা করেও এর কারণ বের করা গেল না। এই কবিতাংশগুলো ব্যবহারের মাজেজা একটাই হতে পারত, সেটা হলো সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে যা বলতে চাওয়া হয়েছে কবিতাংশে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এসব ইঙ্গিত ও সংশ্লিষ্টতা খোঁজার বহু চেষ্টা করেও কোনো কিছুর হদিস পাওয়া গেল না। তিনি ব্যবহার করেছেন মীর তকী মীর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোহেল হাসান গালিব, পিয়াস মজিদ, সঞ্জীব পুরোহিত, পরাগ রিছিল, মজনু শাহ, মাদল হাসান, মাসুদ খান, সাজ্জাদ শরিফ ও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর কবিতার অংশ। নামের তালিকা থেকেও আঁচ করা যায় যে তারা একই ঘরানার। এখানে মাদল হাসান তাঁর নিজের কবিতাও ব্যবহার করেছেন। এটুকু সংযম তিনি দেখাতে পারেননি। তদুপরি উপন্যাসের ভেতরে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে তিনি কবি মাদল হাসানের বিভিন্ন কীর্তির ঢোল পিটিয়েছেন। তারা বলাবলি করছেন, মাদল হাসান মস্ত বড় কবি। তার এতগুলো বই বেরিয়েছে। তার বই প্রথম আলো শীর্ষ দশ-এ স্থান পেয়েছে। তিনি বিভিন্ন টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন, ইত্যাদি। বুঝা গেল তিনি নিজের উপন্যাসখানিও ঢোল পেটানোর কাজে ব্যবহার করতে জানেন। উপন্যাসের শেষে তিনি ‘আমাদের আহাম্মকী যৌথসাহিত্য’ নামের এক অধ্যায় সংযোজন করেছেন। সেখানে কয়েকটি কবিতা গ্রন্থস্থ হয়েছে। এখানে ‘আহাম্মকী যৌথসাহিত্য’ শব্দবন্ধটিই তার স্বেচ্ছা মূল্যায়ন হিসেবে ধরলে তাকে সম্মান জানাতেই হয়। কারণ এতক্ষণে তিনি তার নিজের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছেন। এ জন্য অভিনন্দন প্রাপ্তি তার অবধারিত।
মাদল হাসানের জানা উচিত সাহিত্য ইয়ারকির জায়গা নয়।
তামের কবিরের ‘একটি জলজ মুখ’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এই দশকের তিনিই একমাত্র লেখক যিনি মুক্তিযুদ্ধকে তার উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য করেছেন। বোধকরি একটি জলজ মুখ’ই এই দশকের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। লেখককে এ জন্য বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হয়।
পীলুর ফিরে আসা দিয়ে উপন্যাসের শুরু। এ জন্য বাড়ির সকলের মধ্যে স্বস্তি ও শান্তির একটা স্রোত বয়ে যায়। বাড়ি বলতে এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়ি। বাড়ির প্রধান কর্তা একজন পীর। অনেক শরীক। যৌথ পরিবার। তার উপর দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজন এসে এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে শান্তি, দুঃশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার মিশেলে এক অন্যরকম অবস্থা বিরাজমান সবার মনের ভেতর।
প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যারা বয়স্ক তাদের কেউ কেউ অনিশ্চয়তার আভাসই লক্ষ করেন। তাদের ভাবনা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তো প্রশিক্ষিত। পক্ষান্তরে আমাদের ছেলেরা তো খুবই সাধারণ, শান্তিপ্রিয়। তাদের সাথে পেরে উঠবে কি-না কে জানে।
তবে ধীরে ধীরে তাদের মতও পাল্টায়। বাড়ির প্রদান কর্তা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে। তার পরিবারের বিশাল সদস্যের সকলের খবর তার নেয়া হয়ে ওঠে না। কেউ কেউ যে এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে তাও তাদের অজানা থেকে যায়। বিশাল বাড়ির বিশাল সদস্যদের মধ্যে বিচিত্র সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ভেদ করে কোনো কোনো যুবক-যুবতীর মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেম ভালোবাসা। যুদ্ধ যেন তাদের ভেতর কোনো অভিঘাতই সৃষ্টি করে না।
এগুলো নিয়েই উপন্যাসটি এগিয়ে যায়। যুদ্ধও শেষ হয়ে যায় এক সময়। উপন্যাসেরও সমাপ্তি ঘটে।
সমাপ্তি ঘটে এভাবে, ‘পীলু খুব ভীতু, তাই যুদ্ধে যেতে পারেনি। এটাই মনে হয় তার জীবনের একমাত্র পরাজয়। তাই একাত্তরের নয় মাসের স্মৃতি মনে এনেই সে বড় লজ্জিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া মা, বাবা, ভাই, বোনের মুখও তার মনে পড়েছিল।
বাঙালি খুব কোমল, মমতার কাছে অনেকবারই তারা হেরেছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হারবে।’
বিষয় হিসেবে বাঙালির সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশটি বেছে নেয়ায় তামের কবির যেমন ধন্যবাদার্হ তেমনি উপন্যাসের এরকম পরিসমাপ্তি টানার জন্য তিনি কঠিন এবং কঠোর সমালোচনার যোগ্য। উদ্ধৃত অংশটুকু উপন্যাসের সমাপ্তি-স্মারক। এই অংশটুকুনই পুরো উপন্যাসকে শেষ করে দিয়েছে। এরকম নেতিবাচক মন্তব্য যদি পুরো উপন্যাসের উপসংহার হিসেবে ধরি তাহলে বলব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি এত দরদ দেখাতে গেলেন কেন? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে চেতনাকে লালন করে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে টেমপারমেন্ট ধারণ করে লেখকের এই বক্তব্য সেই টেমপারমেন্টের বিপরীতে যায়- যা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। লেখক বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা নিয়ে এত এত শব্দ খরচ করলেন কি এরকম নেতিবাচক মন্তব্য করার জন্য?
একটি জাতির সবাই একরকম হয় না। কেউ কোমল হয়, কেউ কঠোর হয়। কিন্তু সে-বিশ্লেষণে না-গিয়েও যদি মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা এসে যায় তখন এই কোমলতা ও আপনার তথাকথিত মমতা কি এর বিপরীতে যায় না? মমতার কাছে তারা হার মানল কোথায়? মমতার কাছে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা হার মেনেছে? কখনোই না। ‘ভবিষ্যতেও হয়তো হারবে’ বলতে লেখক কী বুঝাতে চাইলেন?
পীলুকে দিয়ে উপন্যাসের শুরু। পীলুকে দিয়ে শেষ। পীলুর বাড়িতে আসার খবর যেভাবে দেয়া হয়েছে, পাঠক আশা করেছিল সে মুক্তিযোদ্ধা। আসলে সে ফিরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ফিরে আসা না-বলে পালিয়ে আসা বলা ভালো। এরকম একটি পলায়নপর চরিত্রকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক একটি উপন্যাসের সূচনা এবং সমাপ্তি কীভাবে লেখক করতে পারলেন? বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক।
উপন্যাসটির নাম একটি জলজ মুখ’ই-বা কেন হলো, অনেক ভেবেও তার সুরাহা করা গেল না। কোনো তল-উপর বের করা সম্ভব হলো না।
এই দশকের উপন্যাস বা সার্বিকভাবে কথাসাহিত্যের আলোচনা করতে গেলে যার নামটি বিশেষভাবে নিতে হয় তিনি স্বকৃত নোমান। আমাদের সেই অগ্রজের প্রশ্নের মুখে আমরা যখন যুতসই কোনো নাম পাচ্ছিলাম না তখনো স্বকৃত নোমান এভাবে আবির্ভূত হননি, তিনি তখনো নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করেননি। আজ এখন সেই অগ্রজসহ অন্যান্য অগ্রজদের কাছে আমরা ভরাট কণ্ঠে স্বকৃত নোমানের নাম উচ্চারণ করতে চাই। যার শিল্পকীর্তির কথা অহঙ্কারসহ আমরা উপস্থাপন করতে পারি। কারণ তিনি ইতোমধ্যে কাথাসাহিত্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রা সংযোজন করেছেন। যার কাজ সংখ্যা ও আয়তনগত বিচারে বিপুল (তাঁর সাহিত্যচর্চার কাল নিরিখে) এবং একই সঙ্গে মানসম্মত। তিনি নিজস্ব শিল্পধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনটী উপন্যাসের জন্য ২০১২ সালে এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
স্বকৃত নোমান সমকালের ইতিবৃত্ত রচনা করেন পাশাপাশি আশ্রয় নেন ইতিহাসের। সমকাল ও ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় তার উপন্যাসের উপজীব্য। তাঁর উপন্যাসে একাঙ্গ হয়ে থাকে গ্রাম-বাংলার বিচিত্র সব মানুষ, কখনো প্রকৃতির বিপুল বৈভব হয়ে ওঠে তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। পুরাণের চরিত্ররা তার উপন্যাসে পায় ভিন্ন মাত্রা। বাস্তবতা তো আছেই। এগুলোর মধ্যে তিনি যে জিনিসটি পরম দক্ষতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন সেটি হলো কল্পনা।
তাঁর এই আশ্চর্য সুন্দর কল্পনার নান্দনিক সম্মিলন উপন্যাসকে দেয় এক বিশেষ মহিমা।
যেমন তাঁর হীরকডানা উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শমসের গাজী। যিনি আসলে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ের দক্ষিণ-পূর্ববাংলার এক বিপ্লবী। যিনি উপাধি পেয়েছিলেন ‘বাংলার বীর,’ ‘ভাটির বাঘ’। ইতিহাসের এক ঘোর সন্ধিক্ষণে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। ঔপনিবেশিকতা যখন একের-পর-এক গ্রাস করছিল তখনো এই বীর লড়াই চালিয়ে গেছেন। দুঃখজনক সত্য যে, ইংরেজ-ইতিহাস এই বীরকে আখ্যায়িত করেছে দস্যু তস্কর লুটেরা হিসেবে। এক প্রতিবাদী পুরুষের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করবার এ এক জঘন্য প্রয়াস।
ঔপনিবেশিক এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন স্বকৃত নোমান। তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার পূর্ব পুরুষের গৌরবকে কলঙ্কিত করার কী জঘণ্য অপপ্রায়াস! এই বেদনাবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বহুদিন। ইতিহাসের যে ভার আমি বহন করেছি বছরের পর বছর, এই উপন্যাসের মাধ্যমে তা খানিকটা হালকা করার চেষ্টা করেছি’।
তিনি নিজেকে হালকা করবার চেষ্টা করেছেন ঠিকই। পাশাপাশি ইতিহাসের এক দায়ও শোধ করবার প্রয়াসী হয়েছেন। কয়েকশ’ বছরের ইতিহাস যেখানে শমসের গাজীকে লুটেরা তস্কর হিসেবে জেনে আসছিল, তিনি সেই ইতিহাসের প্রকুত সুলুক সন্ধান করেছেন এবং এতদিনের লেপ্টানো কালিমা তিনি মুছে দিয়ে প্রকৃত স্বরূপ ফিরিয়ে দিয়েছেন শমসের গাজীকে। এ শুধু ‘নিজেকে হালকা করা’ নয়। পূর্ব পুরুষের কাছে উত্তরপুরুষের ঋণ শোধ। ইতিহাসের অন্ধগলিতে আলো ফেলবার দুর্মর বাসনা। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মুখে এক দলা ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে বলা দেখে যা শোষক, কে কেমন ছিল। এ যেন ইতিহাসের কলঙ্ককে প্রকৃত ইতিহাস দিয়ে মুছে দেবার দুঃসাহস। স্বকৃত নোমানের হাত দিয়েই সেটা সম্ভব হলো।
শমসের গাজী মগ পর্তুগিজ জলদস্যূদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন দুর্ধর্ষ এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হন তারা। জনজীবনে নেমে আসে শান্তি। তিনি হয়ে ওঠেন এতদঅঞ্চলের একজন জনপ্রিয় বীর। পানুয়াগড়ের নিরাপত্তা অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন তিনি। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তর পুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন বা গদাপীর তাঁর বুকে জ্বালিয়ে দেন জ্ঞানপ্রদীপ। তিনি জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সাথে জড়িয়ে পড়েন প্রেমে। কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকা-ের বিরোধিতা করে রোষানলে পড়েন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। কৃষকদের নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। শত্রুসেনা বিনাশ করতে থাকেন একের-পর-এক। হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য।
যুদ্ধে শমসের গাজীই জয়লাভ করেন। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাঁসা হয়ে পড়েন ইংরেজ বেনিয়ারা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হবার পর বেনিয়াদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় আবার। আবার শুরু হয় অন্য লড়াই। চম্পকনগরীর যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হন তিনি। পরে পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।
তাঁর মৃত্যুও অমীমাংসীত। ইংরেজ ইতিহাস তাঁকে দস্যু তস্কর ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু ভাটিবাংলার মানুষের কাছে তিনি কিংবদন্তীর মহানায়ক হিসেবে অমর হয়ে থাকেন। তাকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানান কিংবদন্তী। জোসনারাতে হীরকডানায় ভর করে জিন হয়ে জিনের সঙ্গে, পাখি হয়ে পাখির সঙ্গে উড়ে বেড়ান তিনি।
ইতিহাস কিংবদন্তী আর কল্পনার নান্দনিক সম্মিলনে মূর্ত হয়ে উঠেছে উপন্যাসটি। বর্ণিত হয়েছে বিস্মৃত সময়ের আখ্যান।
এই আখ্যান কয়েকটি বিষয়ের মীমাংসা করে দিয়েছে। এক. ইতিহাসের দায় শোধ। দুই. ইংরেজ-ইতিহাসের পাল্টা জবাব। যে জবাব একজন প্রকৃত বীরকে তাঁর প্রকৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে। যিনি একদা তস্কররূপে প্রমাণীত ছিলেন তাঁকে স্বকৃত নোমান দেখিয়েছেন অকুতোভয় বীর হিসেবে, প্রজাদরদী রাজা হিসেবে, বিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে, জ্ঞান পিপাসু হিসেবে এবং শিল্পরসিক বাঁশিওয়ালা হিসেবে। স্বকৃত নোমন ইতিহাসের গলি ঘুপচিতে ঢুকে, নানান সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে এনেছেন বিস্মৃত ইতিহাস। যে ইতিহাস কথা বলে ওঠে নিজেই।
শূন্য দশকের অধিকাংশ লেখকের উপন্যাস মাত্র একটি করে। চন্দন চৌধুরী লিখেছেন দু’টি। একমাত্র স্বকৃত নোমানের দুয়ের অধিক (সাতটি)।
কোনো বিচারই চূড়ান্ত নয়। কোনো নিরিখই নিরঙ্কুশ নয়। একদা কোনো অগ্রজের মুখের উপর যে উত্তরটি আমরা দিতে পারিনি আজ দিতে পারি অনায়াসেই। কারণ আমাদেও লেখকেরা নিয়তই সেই কথার জবাব দেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠছেন। এঁদের ভেতরেই হয়তো কেউ আরো দ্যুতিময় হয়ে উঠবেন। প্রকাশিত হবে নতুন নতুন উপন্যাস, উন্মোচিত হবে সম্ভাবনার দুয়ার। আমরা সে-ই প্রত্যাশা নিয়েই আছি। আমাদের প্রত্যাশা নিয়েই থাকতে হয়। তাতে আলো ছড়ায় চারদিকে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ